ট্রাম্প কি ইতিহাসের গতি বদলে দেবেন, কী করবে ইউরোপ?
Published: 8th, March 2025 GMT
কী নেশায় পেয়েছে ইউরোপকে, সে কেবল তারাই বলতে পারে। এত দিন বাইডেন প্রশাসনের কথায় উঠেবসে ইউক্রেন তেলজল জুগিয়েছে। এবার ট্রাম্পের চপেটাঘাতে ইউক্রেন ও জেলেনস্কি ক্ষতবিক্ষত হলেও ইউরোপ যেন আগের জায়গা থেকে সরছে না। যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে অপমানিত জেলেনস্কিকে বুকে টেনে নিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে নিতে ইউক্রেনকে ২২৬ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা দিয়েছেন।
এই হচ্ছে বাস্তবতা। রাশিয়ার সঙ্গে তিন বছর ধরে অসম যুদ্ধ টেনে নিয়ে যেতে ইউক্রেনের চেয়ে ইউরোপের বড় দেশগুলোর আগ্রহই বেশি। ফলে যুদ্ধটা যে কেবল ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার নয়, বরং ইউরোপ ও সামগ্রিকভাবে পশ্চিমের, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না; সবাই কমবেশি জানেন। কিন্তু ইউরোপকে বুঝতে হবে, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের থাকতে হবে। রাশিয়ার জ্বালানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তারাই যে বিপদে পড়েছে, সে কথা বুঝেও না বুঝে থাকার ভান করে তারা কত দিন পার পাবে।
বাইডেন প্রশাসনকে একধরনের পাগলামিতে পেয়ে বসেছিল। সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের হৃত সাম্রাজ্যবাদী গৌরব ফিরিয়ে আনা। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়ার মুলা ঝোলানো তারই অংশ। দেশটির কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া একধরনের রীতি।
এই ন্যাটোর সম্প্রসারণ ও শেষমেশ ইউক্রেনকে তার অন্তর্ভুক্ত করা—এ পরিকল্পনা ১৯৯৭ সালে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ম্যাগাজিন ফরেন অ্যাফেয়ার্সে অনুপুঙ্খভাবে বিবৃত করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্বিগনিভ ব্রেজিনস্কি; এমনকি সেই রচনায় তিনি দিনক্ষণ পর্যন্ত উল্লেখ করেছিলেন। ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা সেখানে বিবৃত করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এটি মার্কিন-রাশিয়া প্রক্সি যুদ্ধ—ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিয়ে যে বিবাদের সূত্রপাত।
বাইডেন প্রশাসনের তীব্র সমালোচক জেফরি ডি স্যাক্স সামরিকায়নের ঘোরতর বিরোধী। তাঁর ভাষ্য এ রকম: যুক্তরাষ্ট্রের ইস্ট কোস্টভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সের নিয়ন্ত্রণে; এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আমি পড়াচ্ছি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ বছর পড়িয়েছি; এখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যে প্রভাব, অতীতে তা কখনোই দেখা যায়নি। এ সবকিছু ঘটছে মানুষের অলক্ষ্যে; একরকম নীরব অভ্যুত্থানের মতো। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক, প্রকাশ্য রাজনীতি, সততা বা নথিপত্র প্রকাশের বালাই নেই; সবকিছুই যেন গোপনে ও কিছুটা রহস্যজনক উপায়ে ঘটেছে। অর্থনীতিবিদ হওয়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র–সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ হয় আমার। সেই সূত্রে অনেক কিছু দেখতে ও শুনতে পাই, ফলে দাপ্তরিক ভাষ্য ও সর্বব্যাপক মিথ্যার মর্মমূলে ঢুকতে পারি আমি।
এই যুদ্ধ যে হবে, সে বিষয়ে আগে থেকেই অনুমান করা গেছে বলে মনে করেন জেফরি ডি স্যাক্স। সেই ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো সম্প্রসারণে মাধ্যমে নিজ আধিপত্য বজায় রাখার যে পরিকল্পনা করেছিল, সেই পরিকল্পনার ফসল হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল হলো, ইউক্রেনকে নিজের সামরিক পক্ষপুটে নিয়ে আসা। ব্রেজিনস্কি সেই ১৯৯৭ সালে তাঁর ‘দ্য গ্লোবাল চেস বোর্ড’ শীর্ষক বইয়ে এই কৌশল প্রণয়ন করেন। তাঁর যুক্তি ছিল, ইউক্রেন ছাড়া রাশিয়া কিছুই নয়। তিনি আরও লেখেন, ইউরেশিয়ার ভৌগোলিক কেন্দ্র হচ্ছে ইউক্রেন।
১৯৯০-এর দশক থেকে মার্কিন নিরাপত্তাকাঠামোর চিন্তা ছিল পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একপক্ষীয় ব্যবস্থা কায়েম করা। অর্থাৎ মার্কিন আধিপত্য কায়েম করা। ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ও পরবর্তীকালে রুশ অর্থনীতিকে সহায়তা করার যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। এরপর জার্মানি ও তারা গর্বাচেভ ও ইয়েলেৎসিনকে যে অঙ্গীকার করেছিল, তা ভঙ্গ করে ন্যাটোর সম্প্রসারণ শুরু করে। ফলে ন্যাটো সম্প্রসারণ ও পরবর্তীকালে সেখানে ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করা—এসবই যুক্তরাষ্ট্রের খেলার কৌশল। ১৯৯০-এর দশকে এটি শুরু হয় এবং তার পরিণতি হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
মানচিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এই পরিকল্পনা আর কিছু নয়—কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার ব্রেজিনস্কির চিন্তা। ইউক্রেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, জর্জিয়া সব দেশকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সেই মেধাবী ‘নিরাপত্তা’ কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, এর মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ক্ষমতা প্রদর্শনের অবসান ঘটবে। কিন্তু তারা ঠিক রাশিয়াকে বুঝতে পারেনি, রাশিয়া কখনো পরাভব মানে না। যে হিটলার মানবসভ্যতার সব অর্জন ধ্বংস করার পাঁয়তারা করেছিলেন, সেই হিটলারের অজেয় বাহিনীকে তারাই ঠেকিয়েছে। সম্প্রতি ট্রাম্প সে কথা স্বীকার করেছেন।
ইউরোপ যেন এক ঘোরের মধ্যে আছে। যুদ্ধ থেকে তারা বেরিয়ে আসতে চায়—এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন বাস্তবতা হলো, ইউরোপ যদি এই ধারায় চলতে তাকে, তাহলে তারা একরকম একঘরে হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক তো খারাপ আগে থেকেই। আবার তার সামরিক সক্ষমতা এতটা নেই যে রাশিয়ার সঙ্গে প্রক্সি বা সরাসরি যুদ্ধে তারা লিপ্ত হতে পারে এককভাবে।ট্রাম্প ও ন্যাটোএবারের নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই জোরগলায় ট্রাম্প বলে আসছেন, ন্যাটোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বড় সিদ্ধান্ত নেবে। ন্যাটোর অর্থায়ন কমিয়ে দেওয়া বা একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। এরপর শপথ নেওয়ার পর ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর চাঁদার হার বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এসব দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ ন্যাটোর পেছনে ব্যয় করার পরামর্শ দিয়েছেন।
ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ প্রসঙ্গেও তিনি বারবার বলেছেন, ইউরোপের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে বেশি অর্থ দিচ্ছে। এই অর্থ ব্যয় নিয়ে তিনি বারবার জেলেনস্কিকে খোঁচা দিয়েছেন। বাস্তবতা হলো, বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ট্রাম্পের নেই। ফলে তিনি বিভিন্ন বহুপক্ষীয় বন্দোবস্ত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বারবার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে ইতিমধ্যে নির্বাহী আদেশে সই করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সেই সুদিন আর নেই। মাতব্বরি করার জন্য যে সামর্থ্য থাকা দরকার, সেটা তার নেই। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে চীন তাকে ধরে ফেলছে। সেই সঙ্গে সামরিকভাবে অনেক ক্ষেত্রে রাশিয়া ও চীন তার চেয়ে অগ্রগামী। এ দুই দেশের অস্ত্র নির্মাণ ব্যয় অনেক কম। সেই সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তেমন কিছু লাভ করতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ায় দীর্ঘদিন যুদ্ধে লিপ্ত ছিল তারা। শেষমেশ বাইডেন যাওয়ার আগে সিরিয়া থেকে আসাদ সরকার উৎখাত হয়। আরেক দিকে গাজার যুদ্ধের যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র দুটি যুদ্ধে লিপ্ত। এ পরিস্থিতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র যতটা উদ্গ্রীব, গাজার যুদ্ধ থামাতে অতটা নয়।
ইউরোপ কী করবে২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউরোপের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, ইউরোপের নিজস্ব কোনো পররাষ্ট্রনীতি নেই। তারা যুক্তরাষ্ট্রের পাপেট হিসেবে কাজ করছে। এ সমস্যা রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন বা ইউরোপের। সুতরাং তাদের উচিত রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করা। এখন ট্রাম্পের জমানা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে চায়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইউরোপ যেন এক ঘোরের মধ্যে আছে। যুদ্ধ থেকে তারা বেরিয়ে আসতে চায়—এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন বাস্তবতা হলো, ইউরোপ যদি এই ধারায় চলতে তাকে, তাহলে তারা একরকম একঘরে হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক তো খারাপ আগে থেকেই। আবার তার সামরিক সক্ষমতা এতটা নেই যে রাশিয়ার সঙ্গে প্রক্সি বা সরাসরি যুদ্ধে তারা লিপ্ত হতে পারে এককভাবে।
নতুন জমানারুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভাষ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার সঙ্গে রীতিমতো প্রতারণা করেছে। রাশিয়া অনেকবার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পশ্চিমারা সে কথা শোনেনি। মার্কিন সাংবাদিক টাকার কার্লসনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পুতিন আরও বলেছিন, রাশিয়া তো আর কমিউনিস্ট দেশ নয়, তারপরও পশ্চিমাদের বিদ্বেষ যেন শেষ হওয়ার নয়। সর্বশেষ সেটা তারা করেছে, সেটা হলো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে ন্যাটোর সম্প্রসারণ। এ ঘটনা যেন কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। সেই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়ার সময় তৎকালীন নেতারা প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেননি বলেও সমালোচনা করেন পুতিন।
বাস্তবতা এটাই। রাশিয়া নিজ মর্যদা নিয়ে দাঁড়াক—পশ্চিমা বিশ্ব তা কখনোই চায়নি। ফলে রুশ নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের স্বেচ্ছাবসান ঘটালেও পশ্চিমারা তাদের সহায়তা করেনি। উল্টো ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে, যার চূড়ান্ত পরিণতি এই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
ইতিহাসের সেই গতি বদলে দেওয়ার সুযোগ ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে। তিনি খ্যাপাটে; কূটনৈতিক রীতিনীতির ধার তেমন একটা ধারেন না, সবই ঠিক আছে। সর্বশেষ হোয়াইট হাউসে ডেকে নিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে যা করেছেন, তা–ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেট বা রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্রের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করতে পারেন, যে অঙ্গীকার তিনিসহ তাঁর সহযোগীরা করেছেন, সেটাই হবে বড় পাওয়া। রাশিয়াকে তিনি একভাবে আস্থায় নিয়েছেন। তার সঙ্গে যদি চীন ও ভারতকে নিয়ে বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার গোড়াপত্তন করতে পারেন, তাহলে অনেকটাই স্বস্তি। তিনি রাশিয়া বা চীনকে শত্রু মনে করেন না। যদিও নিজের হিস্যা বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ষোলো আনা সঠিক; সেখানে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কতটা পারবেন, সে প্রশ্ন রয়েই যায়। ইহুদি লবির প্রভাব তিনি কতটা কাটাতে পারেন, সেটা দেখার বিষয়।
প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন য দ ধ ইউক র ন র ভ ক ত কর ব স তবত ইউর প র ইউর প য কর ছ ন কর ছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কারের আগে নির্বাচনে জোর দেওয়া ছিল ১/১১ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল
১৯৯০ সালে কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। আর গণতন্ত্রের উল্টোপথে যাত্রা ঠেকাতে প্রয়োজন ছিল কিছু উল্লেখযোগ্য সংস্কার। সে সময় সংস্কারে জোর না দিয়ে নির্বাচন ও নির্বাচনের সময়সীমায় গুরুত্ব দেওয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভুল বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ–রাষ্ট্রদূত জন এফ ড্যানিলোভিচ।
আজ শনিবার সকালে রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় তিনি এ মন্তব্য করেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) বিআইআইএসএস’এ ‘নতুন ভোরের পথে ঢাকা: গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন গতিপথ’ শীর্ষক ওই আলোচনার আয়োজন করে। সিজিএস আয়োজিত সংলাপে অংশ নেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ রাষ্ট্রদূত জন এফ ড্যানিলোভিচ। সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্থার চেয়ারম্যান মুনিরা খান। এরপর সঞ্চালকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সাবেক দুই জ্যেষ্ঠ মার্কিন কূটনীতিক। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে অতিথিদের প্রশ্নের উত্তর দেন তারা।
সাবেক দুই জ্যেষ্ঠ মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দেশের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিশ্রুতি নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করতে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের ভূমিকা এবং নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর আলোকপাত করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন বিদেশি মিশনের কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, আন্তর্জাতিক, উন্নয়ন সংস্থা, নাগরিক সমাজের সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।
কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে প্রশ্ন করলে জন এফ ড্যানিলোভিচ বলেন, অবশ্যই ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভুল পক্ষে ছিল। তবে এরপর থেকে একটি ধারাবাহিক নীতি নিয়ে চলেছে।
২০০৭–০৮ যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা জটিল ভূমিকা পালন করেছিল, সে সময়ে কূটনীতিকরা কিভাবে কাজ করে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ২০০৭–০৮ সালে বড় ভুল করেছিল। আমি সে সময়ে বাংলাদেশে দায়িত্বে ছিলাম না। তবে আমি এটি বলতে পারি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বা অন্য কোনো মার্কিন কূটনীতিক ১/১১ এর পেছনে দায়ী নয়। আর কোনো গোপন কফি গ্রুপে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ বাংলাদেশিদের নির্দেশনা দেয়নি কি করতে হবে।
জন এফ ড্যানিলোভিচ বলেন, তবে সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গতিপথ নিয়ে অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিল, যে প্রত্যাশা তৎকালীন সরকার, সামরিক বাহিনী এবং সুশীল সমাজের ছিল।
তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি ছিল, তা লাইন বিচ্যুত হয়েছিল। আর বাংলাদেশকে সঠিক পথে আনতে কিছু মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। আমরা সংস্কারকে সহযোগিতা করেছিলাম। আমরা তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন করেছিলাম। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগে ছিলাম।
১/১১-এর বিশ্লেষণে জন এফ ড্যানিলোভিচ বলেন, পরিস্থিতির কারণে আমাদের বোঝাপড়ার ঘাটতি ছিল। আমাদের অনেকের কথা শোনার দরকার ছিল। কিন্তু আমরা তাদের কথা শুনিনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকে আর্মির জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ারদের কথায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ কি চেয়েছিল, তাতে গুরুত্ব দেয়নি। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বললেও আর্মিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এ কারণেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্র যে রকম প্রত্যাশা করেছিল বাংলাদেশ সে ধারায় যেতে পারেনি।
তিনি বলেন, আরও একটি ভুল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। সেটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নির্বাচন ও নির্বাচনের সময়সীমাতে বেশি জোর দিয়েছিল। নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যে সরকার নির্বাচিত নয়, এমন সরকার দীর্ঘ সময় শাসন করতে পারে না। তবে সে সময়ে উল্লেখযোগ্য সংস্কার প্রয়োজন ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অগ্রাধিকার সংস্কারের চেষ্টা করেছিল। তবে যখন এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে সে সরকারের এডেন্ডা হচ্ছে নির্বাচন এবং ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে প্রভাব হাড়িয়েছে।
জন এফ ড্যানিলোভিচ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সে সরকারের চুক্তি হয়েছিল গোপনে। ফলে আমরা জানি না সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কি দরকষাকষি হয়েছিল। তখন আমরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমাদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা তাদের শিক্ষা পেয়েছেন এবং সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজগুলোকে এগিয়ে নেবে। তবে আমাদের ধারণা ভুল ছিল এবং যা বলেছিল তা বিশ্বাস করেছিলাম। আর বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে অবনতি হতে দেখেছি, যার ফলে ২০২৪ এর জুলাই–আগস্ট হয়েছে। এ সময়ে অতীতের ভুল থেকে ভবিষ্যতের শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেন তিনি।