এনসিপি: তারুণ্যের উত্থান, নাকি জাসদের ছায়া
Published: 7th, April 2025 GMT
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে একদল তরুণ রাজনীতিবিদের নেতৃত্বে গঠিত এই দল মূলধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি হতাশ হয়ে বিকল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়তে চেয়েছিল। তারা মনে করত, আওয়ামী লীগ প্রকৃত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে; বরং তারা সরকার চালানোর পুরোনো পদ্ধতি চালু করেছে।
বাংলাদেশ: সামরিক শাসনের কালো অধ্যায়, জাসদের উত্থান ও পতন, রাষ্ট্র বনাম রাজনীতি—এই বইগুলো অনুসারে মহিউদ্দিন আহমদের বক্তব্য হচ্ছে, স্বাধীনতার পরের সময়টি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের একদিকে সম্ভাবনাময়, অন্যদিকে অত্যন্ত জটিল ও অস্থির একটি অধ্যায়। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী তরুণ প্রজন্ম সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে পথে নেমেছিল, কিন্তু তাদের কৌশলগত ভুল এবং বাস্তবতা বিচারের ঘাটতির কারণে সেই স্বপ্ন অনেকাংশেই ভেঙে পড়ে।
প্রায় ৫০ বছর পর, বাংলাদেশ আবারও ছাত্রদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার সংমিশ্রণে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক জাগরণের সাক্ষী হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ মূলত বৈষম্য, দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার বিরুদ্ধে ছিল। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গঠিত হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি, যার শিকড় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ‘পাঠচক্র’ ও তরুণদের রাজনৈতিক আলোচনার মধ্যে প্রোথিত।
এখানে একটি ঐতিহাসিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়—১৯৭০-এর দশকে যেমন জাসদ গঠিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের চিন্তা ও আদর্শ থেকে, তেমনি এনসিপিও উঠে এসেছে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও আদর্শগত অনুসন্ধান থেকে। এমনকি এই ধারাবাহিকতার গোড়া খুঁজলে ১৯৬০-এর দশকে সিরাজুল আলম খান ‘দাদা ভাই’-এর নেতৃত্বে গঠিত ‘নিউক্লিয়াস’ নামের গোপন আলোচনা চক্রের কথাও মনে পড়ে, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপরেখা নিয়ে চিন্তা হতো।
আরও পড়ুনবিএনপি কি তরুণ প্রজন্মের চাওয়া বুঝতে পারছে০৬ এপ্রিল ২০২৫আজকের এনসিপির তরুণ নেতারাও সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে একই রকম গভীরভাবে ভাবছেন। তবে এখানেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উঠে আসে, তাঁরা কি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন, নাকি জাসদের পথেই আবার হাঁটছেন? কারণ, ইতিহাস আমাদের শেখায়, শুধু উচ্চ আদর্শ বা রাজনৈতিক আবেগ দিয়ে নয়, একটি আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে সঠিক কৌশল, ধৈর্য এবং জনগণের বাস্তব চাহিদা বোঝার ওপর।
এই লেখায় খতিয়ে দেখতে চেষ্টা করব, জাসদ ও এনসিপির মধ্যে কী কী মিল রয়েছে, কী কী মৌলিক পার্থক্য রয়েছে এবং সেই সঙ্গে জাসদের অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান তরুণদের জন্য কী কী শিক্ষণীয় দিক থাকতে পারে।
‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ বনাম ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’
‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ অথবা ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’—এ ধরনের ধারণা শুনতে অনেক বড় কথা মনে হলেও সাধারণ মানুষ এসব বুঝতে পারে কি? ১৯৭২ সালে জাসদ যখন সমাজবদলের কথা বলেছিল, তখন তারা মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর শহরের কিছু বুদ্ধিজীবীর চিন্তার জগতে সীমাবদ্ধ ছিল। তারা চেয়েছিল শ্রেণিবিহীন সমাজ গড়তে, রাষ্ট্রব্যবস্থা একেবারে পাল্টে ফেলতে।
মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর জাসদের উত্থান ও পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি বইয়ে বলেন, জাসদ একরকম নিজেদের তাত্ত্বিক জগতে আটকে পড়েছিল, ফলে তারা জনতার আবেগ ও বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। একইভাবে বদরুদ্দীন উমরও বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকারে বাম ধারণার দলগুলোর মধ্যে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে দুর্বলতা এবং নেতৃত্বে মধ্যবিত্তের প্রাধান্য সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এ দলগুলোর মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনের অভাব ছিল, যা তাদের গণভিত্তি গড়ে তুলতে বাধা সৃষ্টি করেছে।
জাসদের মতো আজকের এনসিপি ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’-এর কথা বলছে। তারা চায় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সংবিধান পাল্টাতে এবং নতুন ধরনের সরকার গঠন করতে। কিন্তু গ্রামের কৃষক, বিদেশে কাজ করা শ্রমিক, পোশাক কারখানার শ্রমিক কিংবা শহরের রিকশাওয়ালারা এসব বুঝবেন কীভাবে? তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা তো অন্য জায়গায়—চালের দাম, কাজের নিশ্চয়তা, চিকিৎসা, বিচার পাওয়ার আশা। যাঁরা নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের কথা বলছেন, তাঁরা কি এই মানুষের ভাষায় কথা বলছেন?
রাজনৈতিক চিন্তাবিদ গ্রামসি তাঁর প্রিজন নোটবুকস বইয়ে বলেছিলেন, কোনো ‘তাত্ত্বিক ধারণা’ জনগণের জীবনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে তা কাগজে থাকবে, বাস্তবে নয়। এ ছাড়া সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দিয়ো বলেছিলেন, সমাজের বাস্তবতা না বুঝে যারা কেবল বড় বড় কথা বলে, তারা একধরনের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতি করে।
আমাদের দেশে যেখানে ধনিক শ্রেণি নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত, গরিব শ্রেণি তাত্ত্বিক রাজনৈতিক ভাষা বোঝে না আর মধ্যবিত্তের একাংশ বিভ্রান্ত, সেখানে এনসিপি কি সেই প্রয়োজনীয় ‘হোমওয়ার্ক’ শেষ করতে পেরেছে, যা জাসদ ৫০ বছর আগে করতে পারেনি। তারা কি কেবল নিজেরা নিজেদের বোঝে, নাকি সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নেওয়ার মতো ভাষা ও কৌশল তৈরি করতে পেরেছে? এবার ইতিহাসের পরিণতি কি আলাদা হবে?
‘শহরের রাজনীতি’ বনাম ‘গ্রামীণ বাস্তবতা’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, গণজাগরণ বা প্রতিরোধ আন্দোলনের উৎস শুধু শহর নয়, বরং বহু সময়েই তা উঠে এসেছে গ্রাম থেকে। ঔপনিবেশিক আমলে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা কিংবা তেভাগা আন্দোলন—সবই শুরু হয়েছিল গ্রামের মাটিতে, শোষিত কৃষক ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের হাত ধরে।
কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের রাজনীতিতে একটা প্রবণতা দেখা যায়—আন্দোলনের ভাষা, দৃষ্টি ও নেতৃত্ব ক্রমেই শহরকেন্দ্রিক। অথচ বাংলাদেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে। তাদের জীবনের সমস্যা, চাহিদা, চিন্তা—সবকিছুই শহরের মানুষের চিন্তার জগৎ থেকে অনেক ভিন্ন।
এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শহরভিত্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সময় গ্রামীণ জনগণের ‘এজেন্সি’, অর্থাৎ তাদের চিন্তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং সামাজিক শক্তিকে উপেক্ষা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়। জাসদের মতো বহু দল এই দূরত্ব কমাতে পারেনি। তারা শহরের সভা-সেমিনার আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যস্ত ছিল।
কিন্তু যাঁদের জন্য তারা সমাজ বদলাতে চেয়েছিল, সেই গ্রামের মানুষ, শ্রমিক, কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর মতো ভাষা, কর্মসূচি বা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। বিষয়টি আরও সহজভাবে তুলে ধরেছিলেন কাজী জাওয়াদ তাঁর ‘জাসদের রাজনীতি’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে, যা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালের ১৮ এপ্রিল।
বিশ্ব ইতিহাসের অনেক উদাহরণ আমাদের দেখায়, রাজনৈতিক আন্দোলন তখনই টিকে থাকে, যখন তা শহরের দেয়াল পেরিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছাতে পারে। যেমন চিলিতেও ২০১৯ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি আন্দোলন শুরু হয়। শুরুতে শহরভিত্তিক হলেও পরে তা কৃষক, শ্রমিক, নারী ও আদিবাসীদের যুক্ত করে এক বিস্তৃত গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গ্যাব্রিয়েল বোরিচ নামের এক ছাত্রনেতা পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ফলে আন্দোলনটি বিদ্রোহ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছায়, যা একটি সফল গণভিত্তিক পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
অন্যদিকে মিসরের ‘এপ্রিল ৬ আন্দোলন’ শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে, শহরের কিছু তরুণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশগ্রহণে; যদিও এটি সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, কিন্তু গ্রামের মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারেনি। ২০১১ সালের মিসরীয় বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়েল গনিম (২০১২) তাঁর রেভল্যুশন ২.
‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ বনাম ‘সামাজিক চেতনা’
জাসদ ও এনসিপির মধ্যে মূল পার্থক্য তাদের আন্দোলনের কৌশলে। জাসদের কৌশল ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম। জাসদ সশস্ত্র বিপ্লবের পথে হেঁটেছিল—পুলিশ স্টেশন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছিল এবং ১৯৭৫ সালে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল, যাতে বহু সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। এমনকি ১৯৭৪ সালের ২৫ মে জাসদপন্থী গণবাহিনী ভারতীয় হাইকমিশনের এক কর্মকর্তাকে অপহরণের চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত হন। এসব ঘটনায় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও অনাস্থা তৈরি হয়।
এই অস্থিরতার ভেতরে মানুষ শান্তির জন্য নতুন নেতৃত্ব খুঁজতে থাকে। আওয়ামী লীগ ও জাসদের হঠকারিতায় বিরক্ত জনগণ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি ও জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে সামনে নিয়ে আসে। জিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং স্থিতিশীলতার বার্তা দেন, যা তখনকার প্রেক্ষাপটে ছিল এক বড় মোড়।
আজকের এনসিপি জাসদের মতো সহিংস পথে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও সংস্কারের পথে হাঁটছে। তবে ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় ভারতের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে এনসিপির পূর্বতন রূপ ‘নাগরিক কমিটি’ ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করে। যদিও এই প্রতিবাদ রাজনৈতিকভাবে যৌক্তিক ছিল, তবে কোনো কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বড় ধরনের কূটনৈতিক উত্তেজনার জন্ম দিতে পারত।
তা ছাড়া সম্প্রতি সেনাপ্রধানকে ঘিরে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। এনসিপিঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাত্রনেতা তাঁদের বক্তব্যে সেনাপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং জনমনে বিভাজন তৈরি করে। পরে এনসিপির পক্ষ থেকে এটি ‘ব্যক্তিগত মতামত’ বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও বিষয়টি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ থেকেই যায়।
এসব ঘটনা আমাদের ১৯৭৫ সালের উত্তপ্ত পরিস্থিতির স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। হানটিংটন, জন কিনের মতো অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, মানুষ পরিবর্তন চায়, কিন্তু বিশৃঙ্খলা নয়; তারা স্থিতিশীল নেতৃত্ব চায়। তাঁদের মতে, ‘বিপ্লব’ যদি মানুষের নিরাপত্তার সঙ্গে সংযুক্ত না থাকে, তবে সেটি টেকসই হয় না।
এ বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে, বর্তমান তরুণ নেতৃত্ব কি শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতার বার্তা দিতে পারছেন? নাকি তাঁরা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলছেন? যদি এই অস্থিরতা চলতে থাকে, মানুষ আবারও কোনো বিকল্প স্থিতিশীল নেতৃত্বের দিকে তাকাবে; যেমন ১৯৭৫ সালে ঘটেছিল।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য শুধু ইতিহাসের আলোকে সতর্কবার্তা। বর্তমান তরুণ নেতৃত্ব চাইলে ভিন্ন ইতিহাস গড়তে পারেন। তবে শুধু রাজনৈতিক ট্যাগিং করে, অন্যকে খাটো করে রাজনৈতিক বাস্তবতা এড়ানো বা বদলানো যায় না। দরকার পরিণত নেতৃত্ব, যাঁরা আবেগ নয়, বাস্তবতা দিয়ে নিজেদের কাজকর্মকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, বর্তমান তরুণ নেতৃত্ব বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অনেক সমস্যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারছেন; যদিও সমস্যা সমাধানের রুপরেখা তৈরি করতে তাঁদের অনেক সময় প্রয়োজন হবে। একটা জিনিস মাথায় রাখা উচিত, তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিতে নেমেছেন। এ ক্ষেত্রে বারবার ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।
মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব স ব ধ নত র ১৯৭৫ স ল র র জন ত ব স তবত ব যবস থ এনস প র জনগণ র দ র মত ন র জন হয় ছ ল আম দ র র সময় শহর র
এছাড়াও পড়ুন:
জনআকাঙ্ক্ষার সংস্কার উদ্যোগ, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার দেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের সিংহভাগ মানুষ সংস্কারের পক্ষে। দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেশের পুলিশ, প্রশাসন, আইন, বিচার, আর্থিক খাত, নির্বাচন, গণমাধ্যম প্রভৃতি ক্ষেত্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এগুলোর ওপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেই কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে সব রাজনৈতিক দল ও সমাজের নানা পেশার মানুষের মতামত নিয়ে একটি জুলাই-আগস্ট চার্টার্ড তৈরি করা; পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সরকার এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করবে এবং মেনে চলবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে কখনও প্রকাশ্যে আবার কখনও অপ্রকাশ্যে এবং নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চলমান সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। যেমন সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটি করার অধিকার শুধু রাজনৈতিক সরকারের। সুতরাং আগে নির্বাচন দিতে হবে। কোনো কোনো মহল বলছে, যারা সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তারা দেশের নাগরিক নন। ফলে তাদের প্রস্তাবকৃত সংস্কার মানা হবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। দেশের জনগণ তা মানবে না, দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। আজ এই লেখায় মূলত আলোচনা করতে চেষ্টা করব রাষ্ট্র সংস্কারের সুফলভোগী মূলত কে বা কারা। একই সঙ্গে দেখতে চেষ্টা করব চলমান সংস্কার কার্যক্রমের প্রধান প্রধান অংশীজন কারা এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় কী কী?
প্রথম কথা হলো, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম এবং প্রধান সুবিধাভোগী এ দেশের সাধারণ জনগণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই সাধারণ জনগণ? সেই জন সাধারণ জনগণ, যারা ক্ষেত-খামারে, অফিসে, শিল্পকারখানায়, জলে ও স্থলে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কোনো রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনীর কাজ করেন না। তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অতিরিক্ত এবং ব্যক্তিগত কোনো সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশা করেন না। তারা যা প্রত্যাশা করেন তা হলো, তাদের উৎপাদিত ফসল ও শ্রমের ন্যায্য মূল্য, মানুষ হিসেবে যথাযথ সম্মান, নিজস্ব মতামত ও ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার, নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, সন্তানের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা।
অন্য যেসব অংশীজন রয়েছে, তার মধ্যে আছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি, পরিবহন সমিতি, সংঘ, ক্লাব, পেশাজীবী সংগঠন ইত্যাদি। এদের আবার নিজস্ব সুযোগ-সুবিধার আলোকে রাষ্ট্রকে দেখার এবং ব্যবহারের নজির রয়েছে। মূলত রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম বাধাগুলো এখান থেকেই আসছে। প্রথমেই আলোচনা করা যাক, রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিতে তারা কতটুকু রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে? প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব দর্শন ও কর্মপরিকল্পনা থাকে। দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আগে মুখে মুখে জনগণের কথা বললেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হয়ে ওঠেন একেকজন একেকটি এলাকার প্রধান। তাঁর কথাই আইন। তিনি যা বলবেন এলাকার লোক তা মানতে বাধ্য। না মানলে নানা মাত্রায় হামলা, মামলা ও জেল-জুলুম নেমে আসে। অন্তত স্বাধীনতা পরবর্তী বছরগুলো থেকে সর্বশেষ জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আগের অভিজ্ঞতার আলোকে এটা নিশ্চিত করে বলাই যায়। মূলত ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের আচরণ জনমতের বিরুদ্ধে যেতে থাকে। অন্যদিকে দলগুলোর ভেতরে আর গণতান্ত্রিক চর্চা না হওয়াও একটি কারণ।
অন্য যেসব অংশীজন রয়েছে যেমন– বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি বা সংঘ, তারাও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যবসায়ী স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারি দলের লেবাসে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দলগুলোও তাদের সহযোগিতা করে। কারণ এরাই দলের ফান্ডে যত চাঁদা তার সিংহভাগ সরবরাহ করেন। ফলে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জনগণের পকেট কেটে তা দেশে-বিদেশে পাচার করে আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। রাষ্ট্র সংস্কারের ফলে যদি কেউ বর্তমানে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন সেগুলো কমে যায় বা প্রশ্নের মুখে পড়ে তাহলে সেই সংস্কারের পক্ষে কেন তিনি দাঁড়াবেন! সুতরাং বাধা এখান থেকেও আসছে– হোক তা প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে।
আরও একটি অংশীজন হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা তো রাষ্ট্রের কর্মচারী। তারা কেন রাষ্ট্র সংস্কারের বিরোধী হবেন? হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী ও জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা হয় এবং তাদের প্রধান কাজ জনগণকে সেবা দেওয়া– কথাটা তাদের মাথায় নেই। তারা জনগণের সেবক না হয়ে ইতোমধ্যে জনগণের কর্তারূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তাই যেখানে রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী হয়ে এ দেশের প্রত্যেক মানুষকে স্যার বলার কথা, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো; জনগণকেই তারই টাকায় যাঁর বেতন-ভাতা হয়, তাঁকে স্যার বলতে বাধ্য হতে হয়। রাজনীতিতে যেমন জবাবদিহির অভাব ঘটেছে, তেমনি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রও অনেকটা জবাবদিহির বাইরে চলে গেছে। ফলে সমাজে দুর্নীতি বেড়েছে। ভন্ড রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ীদের মতো দেশের অর্থ পাচার করে সরকারি কর্মচারীদেরও বিদেশের বেগমপল্লিতে বাড়ি-গাড়ির তথ্য বেরিয়ে আসছে।
এখন রাষ্ট্র সংস্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশ থেকে দুর্নীতি কমানো ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সত্যি সত্যিই যদি রাষ্ট্র সেদিকে অগ্রসর হয়, তাহলে যারা এতদিন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসছেন, তাদের সেই সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে এবং জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে। কে চায় তাঁর সোনার সংসারে এমন আগুনের তাপ এসে লাগুক! সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারা এসব সংস্কার উদ্যোগে সহযোগিতা করবেন না, এটা পরিষ্কার। ইতোমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সেই আলামত দেখাও গিয়েছে। পুলিশ কাজ করছে না ঠিকমতো, প্রশাসনে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সরাকারি নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। মোট প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, তা প্রশ্নের মুখে পড়বে চলমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে। তাই এই সংস্কারে তাদের সহযোগিতা খুব যে পাওয়া যাবে তা আশা করা যায় না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিভিন্ন সমিতি, সংঘ, পেশাজীবী সংগঠন সবাই সংগঠিত এবং অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আরামের সাম্রাজ্যে বসবাস করছে। তারা কোনো কালে জনগণের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে বিশেষ কিছু করেছেন এমন নজির খুব কম। এমন পরিস্থিতিতে দেশের চলমান সংস্কার উদ্যোগে তারা পরিপূর্ণ সহযোগিতা করবেন এমনটা আশা করা ভুল। সুতরাং এ জাতির সামনে কি কোনো মুক্তির পথ নেই? কেউ কি নেই, যে এ জাতির মুক্তির ত্রাতা হয়ে উঠতে পারেন। হয়তো আছেন অথবা নেই। এর জন্য একটি শক্তিশালী জনগণকেন্দ্রিক রাজনৈতিক শক্তিই পারে এ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির পথ খুলে দিতে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা দল কোথায়? আপাতত অপেক্ষা ছাড়া ভাগ্যহত এ জাতির সামনে দ্বিতীয় বিকল্প কি দেখা যাচ্ছে?
মো. সাইফুজ্জামান: শিক্ষাবিষয়ক উন্নয়নকর্মী
shakdip@gmail.com