প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের ভূ-অর্থনৈতিক তাৎপর্য
Published: 27th, March 2025 GMT
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর চীন দ্রুত নবগঠিত ইউনূস সরকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে এবং কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারের প্রতিশ্রুতি দেয়।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর ১২ অক্টোবর দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশে আসে, যা দুই দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি, হাসিনা সরকারের পতনের পর চীনা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে সক্রিয় প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক শুরু করে এবং তাদের প্রতিনিধিদের চীনে আমন্ত্রণ জানায়, যা দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আভাস দিচ্ছে। এই ধারাবাহিক কূটনৈতিক অগ্রগতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হতে যাচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর।
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর অন্যান্য সময়ের তুলনায় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ভারতের প্রতি অসন্তুষ্ট। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা, সীমান্তে নিরপরাধ বাংলাদেশিদের নির্বিচারে হত্যা এবং ন্যায্য পানির হিস্যা না পাওয়ার কারণে জনমনে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দিন দিন বেড়ে চলছে। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে অবস্থান করছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)
এই উদ্যোগের আওতায় চীন বাংলাদেশকে মোট ৪০ বিলিয়ন ডলারের একটি প্যাকেজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মধ্যে ২৬ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য এবং ১৪ বিলিয়ন ডলার যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ থাকবে। তবে এখন পর্যন্ত চীন ৩৫টি প্রকল্পের জন্য ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি বিআরআইয়ের আওতায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ৪% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে, আসন্ন সফরে বিআরআই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
যদিও প্রধান উপদেষ্টা নিজ উদ্যোগে এ উদ্যোগের আওতায় কয়েকটি নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারেন, তবে মূল লক্ষ্য থাকবে বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন ও হস্তান্তর নিশ্চিত করা। কারণ, অনেক প্রকল্প ইতিমধ্যেই দীর্ঘসূত্রতার শিকার হয়েছে, যার ফলে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উন্নয়ন কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে।
চীনের এই বিআরআই উদ্যোগ ছাড়াও আরও তিনটি উদ্যোগ রয়েছে—গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ। এবারের সফরে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের যোগদানের সম্ভাবনা থাকলেও বাকি দুটি ইনিশিয়েটিভের বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে তেমন কোনো আগ্রহ দেখানো হয়নি। কেননা পশ্চিমা শক্তিগুলো চীনের সঙ্গে যেকোনো দেশেরই সম্পর্ক গভীর করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
চীনা ঋণে সুদের হার ও পরিশোধের সময়
প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরের আগেই চীন নীতিগতভাবে বাংলাদেশের জন্য ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। এ সিদ্ধান্তটি সম্প্রতি বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো.
আলোচনার সময় তৌহিদ হোসেন চীনকে অনুরোধ করেন যেন সুদের হার ২-৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়, প্রতিশ্রুতি ফি মওকুফ করা হয় এবং অগ্রাধিকারমূলক ক্রেতা ঋণ ও সরকারি সুবিধাজনক ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ২০ বছর থেকে ৩০ বছর করা হয়। ওয়াং ই বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সুদৃঢ় ইতিহাসের প্রশংসা করেন এবং ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধিতে নীতিগতভাবে সম্মতি জানান। তবে তিনি সুদের হার কমানোর বিষয়ে শুধু ‘বিবেচনা করার’ আশ্বাস দেন। এ ছাড়া চীন ঘোষণা করেছে যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার বজায় থাকবে।
যদিও ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত, তবে চীন সুদের হার ২-৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করতে রাজি হবে এমন সম্ভাবনা কম। কারণ, শ্রীলঙ্কাও একই সময়ে একই সুদের হারে ঋণ গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশকে কম সুদে ঋণ দিলে অন্য দেশগুলোর মধ্যেও একই দাবির ঝুঁকি তৈরি হবে, যা চীনের অর্থনৈতিক নীতিতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে বাংলাদেশ কিছু ছাড় পেলেও সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আর্থিক স্থিতিশীলতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া অধ্যাপক ইউনূস অবশ্যই এ বিষয়টি আলোচনায় তুলে ধরবেন।
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি
প্রধান উপদেষ্টার এই সফরে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। তবে এই সফরে এ বিষয়ে বড় কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। যদিও মুক্তি বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে এবং শিগগিরই আলোচনা শুরু হওয়ার কথা, তবে এখনো বিষয়টি কার্যকর আলোচনার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফলে সফরে বাস্তব অগ্রগতি আশা করা যাচ্ছে না। বরং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের প্রতিশ্রুতি ও কূটনৈতিক ভাষায় বন্ধুত্বের কথা তুলে ধরা হবে। তবে বাস্তবিক অর্থে, সফরে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি এই মুহূর্তে নাও হতে পারে।
স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা
সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা। চীন প্রস্তাব দিয়েছে যে কুনমিং শহরের চারটি হাসপাতাল বিশেষভাবে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ করা হবে। এ ছাড়া চীন ঢাকায় একটি আধুনিক ও উন্নতমানের হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনাও নিয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করবে।
এই স্বাস্থ্য খাতের উদ্যোগ কেবল চিকিৎসা–সুবিধা বৃদ্ধি নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপও। বর্তমান সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে এই উদ্যোগ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নের পাশাপাশি কূটনৈতিক অবস্থানকেও শক্তিশালী করবে। এটি বোঝাবে যে বাংলাদেশ কোনো নির্দিষ্ট দেশের ওপর নির্ভরশীল না থেকে স্বাধীনভাবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম।
পানিবণ্টন এবং আন্তসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনা
তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদ–সংক্রান্ত ইস্যু এই সফরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ তিস্তা প্রকল্পকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে, তবে এর বাস্তবায়ন এ অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে। কারণ, ভারতও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। একই সঙ্গে চীন ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণ করছে, যা নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। তবে চীন আশ্বস্ত করেছে যে এই বাঁধগুলো নিচের দিকে পানির প্রবাহে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে ন্যায্য হিস্যার অভাবে ভুগছে—হোক তা ভারতের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে বা ভবিষ্যতে চীনের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নিয়ে। ফলে এই বিষয়টি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক ইউনূস সম্ভবত চীনের নেতাদের সামনে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করবেন। তবে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন হয়তো এ বিষয়ে গভীর আলোচনা এড়িয়ে গিয়ে কম বিতর্কিত বিষয়গুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেবে। ফলে বাংলাদেশকে তার পানি অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সতর্কতার সঙ্গে কৌশল ঠিক করতে হবে, যাতে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় থাকে।
রোহিঙ্গা সংকট
চীন এবং বাংলাদেশ উভয়েই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে দেখলেও বাস্তবে এই সংকটের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে প্রত্যাবাসন দ্রুত সম্ভব না হলেও এ সফরের ইতিবাচক একটি দিক হতে পারে রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন তহবিল সংগ্রহের আলোচনা। যদি নতুন কোনো সহায়তা বা প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়, তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য বিরাজমান সংকটের মধ্যে আশার আলো হয়ে উঠতে পারে। তবে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে এবং দেখতে হবে, এসব আলোচনা সত্যিকার অর্থে কার্যকর উদ্যোগে রূপ নেয় কি না। কারণ, সংকট আরও গভীর হওয়ার আগে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হতে পারে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে সংলাপের একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যার মধ্যে আরাকান আর্মিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখলে, এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা যায়। এই সংকট মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার এবং তা নিশ্চিত করতে চীন সহায়তা করতে পারে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের সময়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে একটি ‘মানবিক সহায়তা চ্যানেল’ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কারণ, একদিকে রোহিঙ্গারা শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে, অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের ফলে সেখানে ভয়াবহ খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে একটি মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু হলে রোহিঙ্গা ও রাখাইন রাজ্যের সাধারণ মানুষের জন্য তা উপকারী হবে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পথও সহজতর হয় উঠতে পারে। তবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য চীনের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টার সফরে এ বিষয়ে সরাসরি আলোচনা না হলেও কৌশলগতভাবে এই প্রসঙ্গ সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হতে পারে।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ
আলোচনায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে, বিশেষ করে কৃষি, জ্বালানি, যোগাযোগব্যবস্থা, পানি ব্যবস্থাপনা এবং শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে কৃষি ও পোলট্রি খাতকে আধুনিকায়ন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে চীন থেকে উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি ও বাংলাদেশে চীনা প্রযুক্তিতে বীজ উৎপাদন করার বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে।
ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য
প্রধান উপদেষ্টার এই সফরে চীনের সঙ্গে চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোকে স্পষ্ট করা দরকার যে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই; বরং এই উন্নয়ন কার্যক্রম পশ্চিমা দেশগুলোর জন্যও উপকারী। কারণ, দুর্বল অবকাঠামো যেকোনো বিদেশি বিনিয়োগের প্রধান বাধা। উন্নত অবকাঠামো ছাড়া টেকসই বিনিয়োগের পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) সুযোগ তৈরি করে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো পক্ষ না নিয়ে বরং উভয়ের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করা।
বাংলাদেশ পূর্ব ও পশ্চিমের বিরোধ নিরসনের জন্য একটি নিরপেক্ষ কেন্দ্রভূমি হিসেবেও ভূমিকা রাখতে পারে, যেখানে ঢাকা আন্তর্জাতিক শান্তি সংলাপের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। তবে এই ভূমিকায় সফল হতে হলে বাংলাদেশকে দক্ষ নেতৃত্ব ও কার্যকর কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যাতে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে দেশের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা যায়।
এস কে তৌফিক হক অধ্যাপক ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
সৈয়দা লাসনা কবীর অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল দ শ র জন য ইন শ য় ট ভ প রকল প র র জন য ব ক টন ত ক র জন ত ক ভ রস ম য ভ র জন ত অবক ঠ ম ব যবস থ ক র যকর ত ৎপর য সহয গ ত পর ব শ সরক র গ রহণ ইউন স হওয় র ব ষয়ট সফর র ন নয়ন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগের সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্য মশিউর সিকিউরিটিজের (ট্রেক নং-১৩৪) বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে সমন্বিত গ্রাহক হিসাব (সিসিএ) থেকে ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং শেয়ার শেয়ার বিক্রির ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে। একক কোনো ব্রোকারেজ হাউজ হিসেবে এটাই সবচেয়ে বড় জালিয়াতি।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ব্যবস্থা নিতে মশিউর সিকিউরিটিজের পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শেয়ার ও তহবিল তছরুপের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
ব্রোকারেজ হাউজটির পরিচালক-কর্মকর্তারা যেন বিদেশ পালিয়ে যেতে না পারেন, সেজন্য দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য দুদকে জরুরি ভিত্তিতে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন স্থায়ীভাবে স্থগিত করার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটটকে (বিএফআইইউ) অবহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
মশিউর সিকিউরিটিজের বিষয়ে ইতোপূর্ব গঠিত তদন্ত কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিএসইসির একাধিক সূত্র রাইজিংবিডি ডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
আগের সরকারের আমলে আইন লঙ্ঘন করা ব্রোকারেজ হাউজগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কঠোর ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তবে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত বিএসইসি সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি থাকা ব্রোকারেজ হাউজগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট ডিএসইর পরিদর্শন দল মশিউর সিকিউরিটিজের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঘাটতি পায়। একই সঙ্গে বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর বিও হিসাবে থাকা শেয়ার বিক্রি বাবদ ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সরিয়ে ফেলার তথ্য পায় পরিদর্শন দল। পরে এসব তথ্যে উল্লেখ করে ওই বছরের গত ২৮ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ পরিদর্শন প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৯ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। কমিটির সদস্যরা হলেন—বিএসইসির উপ-পরিচালক মোহাম্মদ এমদাদুল হক, সহকারী পরিচালক মো. মারুফ হাসান, সহকারী পরিচালক অমিত কুমার সাহা, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ম্যানেজার মোহাম্মদ ইকরাম হোসাইন ও সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) ম্যানেজার শরীফ আলী ইরতেরাজ।
তদন্ত কমিটি মশিউর সিকিউরিটিজের গ্রাহকদের হিসাব, ব্যাক অফিস সফটওয়্যার, অনুমোদিত ট্রেডিং ওয়ার্ক স্টেশনের তালিকা এবং নেতিবাচক ইকুইটির অবস্থা যাচাই করে। একই মোবাইল নম্বর, ই-মেইল, ব্যাংক হিসাব দিয়ে দুটির বেশি বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে কি না এবং প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক, সিইও, অনুমোদিত প্রতিনিধি ও অন্যান্য কর্মচারীর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে কোনো লেনদেন হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হয়।
এর আগে ২০২০ সালের ২৪ জুন ক্রেস্ট সিকিউরিটিজে ১২৪ কোটি টাকা, ২০২১ সালের ১৫ জুন বানকো সিকিউরিটিজে ১২৮ কোটি টাকা, ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর তামহা সিকিউরিটিজের ১৪০ কোটি টাকা সমন্বিত গ্রাহক হিসেবে ঘাটতি পাওয়া যায়।
এদিকে, চলতি বছরের গত ১০ এপ্রিল রাজধানীর বিজয়নগরে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন মশিউর সিকিউরিটিজের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একই সঙ্গে প্রতারক প্রতিষ্ঠান মশিউর সিকিউরিটিজের পরিচালক, কর্মকর্তাসহ ডিএসই ও বিএসইসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানান তারা।
বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন, মশিউর সিকিউরিটিজ অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ক্লায়েন্টের শেয়ার বিক্রি করে এবং অনুমোদনহীন ব্যাক অফিস সফটওয়্যার ব্যবহার করে ক্লায়েন্টের ই-মেইলে জাল পোর্টফলিও পাঠায়, যা মূল পোর্টফোলিওর অনুরূপ। যাতে করে গ্রাহক বুঝতে না পারে তার পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি হয়েছে। পরবর্তীতে তারা টাকা আত্মসাৎ করে। শেয়ার বিক্রয় কিংবা ক্রয় করলে সিডিবিএল থেকে কনফার্মেশন মেসেজ আসে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে নিজেদের মোবাইল নম্বর চালিয়ে দেয় মশিউর সিকিউরিটিজ। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। এছাড়া, রেকর্ড ডেটের আগে বেশি দামে যে পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করে রেকর্ড ডেটের পর সেই পরিমাণ শেয়ার কিনে রেখে দিত। যাতে বিনিয়োগকারী বুঝতে না পারে। ফলে, বিনিয়োগকারী লভ্যাংশ পেত না এবং বিক্রি ও ক্রয়ের মূল্য পার্থকের টাকা হিসাব থেকে সরিয়ে নিত। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের পোর্টফোলিওতে রক্ষিত নগদ টাকা গ্রাহককে ফেরত না দিয়ে নিজেরা আত্মসাৎ করেছে। মশিউর সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নাকের ডগায় বসে অর্থ লোপাট করেছে, যা দুঃখজনক এবং স্পর্শকাতর। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিনিয়োগকারীদের অর্থের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দীর্ঘদিন গ্রাহকের অর্থ ও শেয়ারের প্রকৃত তথ্য আড়াল করার মাধ্যমে ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিএসইসির সিদ্ধান্ত
আইন বিভাগ, মার্কেট অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়ারিজ অ্যাফেয়ার্স বিভাগ ও এনফোর্সমেন্ট বিভাগের একটি সমন্বিত প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হলো—প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গের দায়ে এনফোর্সমেন্ট প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে। মানিলন্ডারিং ও অর্থ আত্মসাতের (প্যানেল কোড, ১৮৬০ এর সংশ্লিষ্ট ধারা ভঙ্গ) বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অভিযোগটি দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হবে। এ-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লিখিত মশিউর সিকিউরিটিজের পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন স্থায়ীভাবে স্থগিত করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি পাঠানো হবে এবং তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের লক্ষ্যে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি পাঠানো হবে। এসব বিষয়ে বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেছেন, মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। বিএসইসির তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছে। তাই, ব্রোকারেজ হাউজটির পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় ব্যবস্থা নিতে দুদকে অভিযোগ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
এ বিষয়ে জানতে মশিউর সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ঢাকা/এনটি/রফিক