ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব যেভাবে আরও বিভক্ত হচ্ছে
Published: 16th, March 2025 GMT
বিশ্ব যে মুহূর্তে ক্রমে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছে এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে, ঠিক সে মুহূর্তে ইউক্রেন যুদ্ধ এই বিভাজনকে আরও গভীর করেছে। শুরু থেকেই দুটি পক্ষ স্পষ্ট ছিল—একদিকে ছিল রাশিয়া। অন্যদিকে ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলো।
এদিকে গ্লোবাল সাউথের (এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলো) বেশির ভাগ দেশ শুধু চেয়েছে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হোক। তবে এখন বিশ্বরাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তন ইউক্রেন সংঘাতের সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
তিন বছর পার হলেও ইউরোপ, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে এখনো ইউক্রেনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় সামরিক সংঘাত হিসেবে এই যুদ্ধ ইউরোপের মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি ইউরোপের নিরাপত্তা সম্পর্কে দীর্ঘদিনের বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং শীতল যুদ্ধের সময়কার পারমাণবিক ধ্বংসের ভীতিকে আবারও সামনে এনেছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ইউক্রেনের একটি অংশ দখল করে রেখে একটি শান্তিচুক্তি করার মতোও রাশিয়ার যেকোনো ‘জয়’ ইউরোপের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ইউক্রেন যুদ্ধে ‘বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালতে’ চায় না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এই যুদ্ধকে ‘অচলাবস্থার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এই যুদ্ধে দুই পক্ষই বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করতে চান। ইউক্রেন যাতে চুক্তির শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়, সে জন্য ট্রাম্প প্রশাসন সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা প্রথমে স্থগিত করে, পরে আবার চালু করে।
ট্রাম্পের দাবি, ‘বিশ্বের মঙ্গলের জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতেই এই চুক্তি হবে।’ তবে ট্রাম্পের দাবি ঠিক নয়। ‘বিশ্বের মঙ্গল’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য নয়। ট্রাম্পের মূল পরিকল্পনা ছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাদের অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিকে দুর্বল করা, যাতে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়।
কিন্তু বাস্তবে এসব নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে দুর্বল তো করেইনি, তার বদলে এসব নিষেধাজ্ঞা চীন ও রাশিয়ার মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এটি পশ্চিমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রচুর সম্পদ ইউরোপের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে ট্রাম্প এখন ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে চান, যাতে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক ও কৌশলগত মনোযোগ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (ইন্দো-প্যাসিফিক) কেন্দ্রীভূত করতে পারে। কারণ তাঁর মতে, আমেরিকার আসল প্রতিপক্ষ হলো চীন।
ট্রাম্পের আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলেছিলেন, একমাত্র চীনই যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে বিশ্বশক্তি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখনো এক লাখের বেশি মার্কিন সেনা ইউরোপে মোতায়েন রয়েছে। তাই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের সঙ্গে একপক্ষীয় নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে না। ইউরোপকে এখন নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। তিনি মনে করেন, ইউরোপ নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নিলে যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মকভাবে চীনকে প্রতিহত করার দিকে মনোযোগ দিতে পারবে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, ইউরোপ কি নিজের নিরাপত্তা রক্ষা করতে সক্ষম? পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক মনে করেন, ইউরোপের অর্থনৈতিক শক্তি যথেষ্ট, জনসংখ্যাও কম নয়। তাঁর ভাষায়, ‘৫০ কোটি ইউরোপীয় নাগরিক ৩০ কোটি আমেরিকানের কাছে ১৪ কোটি রাশিয়ানের বিরুদ্ধে সুরক্ষা চাচ্ছে।’
আসল সমস্যা হলো, ইউরোপ এখনো নিজেকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে ভাবতে পারছে না। ফলে তারা সঠিক কৌশল নির্ধারণ করতে পারছে না।
ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও ইউরোপের বড় একটি দুর্বলতা রয়েছে।
ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুট উল্লেখ করেছেন, ইউরোপের সামরিক শিল্প এই পর্যায়ের শক্তিশালী নয়, যা ইউক্রেনকে পর্যাপ্ত অস্ত্র সরবরাহ করতে পারে। এ জন্য রুটসহ ইউরোপের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চাইছেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহ চালিয়ে যাবে, আর ইউরোপ তার খরচ বহন করবে।
যদি ট্রাম্প প্রশাসন এটি না মেনে নেয়, তাহলে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পরিকল্পিত ‘ইচ্ছুক দেশগুলোর জোট’ (কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং) গঠন করা কঠিন হয়ে পড়বে। এটি ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
এদিকে গ্লোবাল সাউথের (উন্নয়নশীল দেশগুলোর) জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের কারণে খাদ্য ও জ্বালানির দাম অনেক বেড়েছে। এটি ছোট ও দুর্বল দেশগুলোর জন্য মারাত্মক সমস্যা তৈরি করেছে। বিশেষ করে যেসব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম, সেসব দেশের জন্য সমস্যাটি বেশি তৈরি করেছে।
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এর একটি ভালো উদাহরণ। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শেষ করে দেয়। ফলে দেশটিতে তেল, খাদ্য, ওষুধ ও বিদ্যুতের তীব্র সংকট তৈরি হয়। এই অর্থনৈতিক ধাক্কা সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে, ফলে দেশটির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
এ কারণেই বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ চায় যুদ্ধ যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার মাধ্যমে শেষ হোক, এমনকি এর জন্য যদি ইউক্রেনের কিছু এলাকা রাশিয়ার দখলে থাকে, তা–ও মেনে নিতে হবে।
২০২৩ সালের পর থেকে শান্তিচুক্তির দাবি আরও জোরালো হয়েছে। এমনকি ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তাদের নিজস্ব স্বাধীন অবস্থান নিচ্ছে।
তবে এখনো ইউক্রেন ও ইউরোপ বিশ্বাস করে, শক্তির মাধ্যমে শান্তি অর্জন করা সম্ভব। ইউক্রেনের প্রতিরোধ প্রশংসনীয় আর আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রাশিয়ার অবৈধ দখলদারির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুদ্ধ এখন স্থবির অবস্থায় পৌঁছেছে। আর বিশ্বজুড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব বাড়ছে।
১৯৫০-৫৩ সালের কোরিয়ান যুদ্ধের মতো একই ভুল যেন না হয়, যেখানে দুই বছরের সামরিক অচলাবস্থার পর অস্ত্রবিরতি হয়েছিল। তাই সব পক্ষের উচিত বাস্তবসম্মত চিন্তা করা এবং যুদ্ধ শেষ করার জন্য দ্রুত আলোচনায় বসা।
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বার্লিনের রবার্ট বোশ একাডেমির ফেলো
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন য দ ধ ইউক র ন র ইউর প র দ র বল শ ষ কর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়লেই মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়বে না
আমাদের বিকাশের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা শিক্ষার নিম্নমান। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের ভাবতে হচ্ছে, আমরা কি অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ শ্রমশক্তির ওপর ভর করেই চলব? এমনকি আমাদের দেশের ভালো ব্যবস্থাপকের কাজও কি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের কাছে চলে যাবে?
স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অভিমুখে যাত্রা করছে বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম থাকবে দেশের। তবে সে পথ যে খুব বেশি মসৃণ হবে না, তা বোঝা যায় শিক্ষার মান ও শিক্ষায় বিনিয়োগের মাত্রা দেখে।
শিক্ষার পরিবেশ বিচারে সাক্ষরতার হার আর মানসম্পন্ন শিক্ষা ভিন্ন বিষয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী, সাক্ষরতার হার দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ৯, ১৯৭১ সালে যা ছিল ১৬ দশমিক ৮। অর্থাৎ দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। শিক্ষায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশই এখন কর্মক্ষম। এ কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে দরকার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলাদক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও মানসম্পন্ন শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষায় বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কম। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম বারবার পরিবর্তন। তৃতীয়ত, একমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাব। চতুর্থত, শিক্ষা প্রশাসনে ন্যূনতম জবাবদিহির অভাব। শিক্ষকদের দুষ্ট রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার।
ইউনেসকোর পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ এবং বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে বরাদ্দ ১২ শতাংশের ওপর উঠছে না। জিডিপির বিপরীতে এ খাতে বরাদ্দ ক্রমেই কমছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা মোট জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ বা মোট জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া দেশগুলো মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে কোনো আপস করেনি। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অনেক দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বেশি।
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম হওয়ায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন হচ্ছে না, তেমনি বেহাল কারিকুলামের। বারবার পরিবর্তন হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম। একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় তখনই বিশ্বসেরার তালিকায় নাম লেখাতে পারে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা শক্তিশালী হয়। বিনিয়োগ কম ও কর্তাব্যক্তিদের উৎসাহের অভাব থাকায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অনেক পিছিয়ে।
দেশের শিক্ষা খাতে সিংহভাগ ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে ব্যয় হয় যৎসামান্যই। কিছুটা থাকলেও গবেষণায় নিবেদিত লোক পাওয়া যায় না। বিশ্বব্যাপীই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল ভালোভাবে ও পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে পেরেছে, তারাই উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেছে।
বাংলাদেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে আরও প্রায় এক যুগ আগে, অর্থাৎ ২০১২ সালে। ২০৪০ সালে আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। তবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা শেষ হবে ২০৫০ সালে।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশই এখন কর্মক্ষম। এ কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে দরকার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা।
এ জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়াতে হবে। শুধু সাক্ষরতার হার বাড়ালেই হবে না; মানসম্মত ও কর্মমুখী শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
কর্মক্ষম প্রত্যেক মানুষের জন্য আনুষ্ঠানিক খাত অথবা অনানুষ্ঠানিক খাতে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে শিক্ষায় বারবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কারণে আমরা আন্তর্জাতিক মান থেকেও পিছিয়ে পড়ছি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রাথমিক পর্যায়ে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে অন্তত ১১ ধরনের। ধরনভেদে প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমেও রয়েছে ভিন্নতা।
স্বাধীনতার এত বছর পরও ইংরেজি, বাংলা আর মাদ্রাসাশিক্ষার মধ্যে আমরা ন্যূনতম সমন্বয় সাধন করতে পারিনি। অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো আমাদের দেশেও জিডিপির তুলনায় শিক্ষা খাতে স্বল্প বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি নিয়ে অনেকেই নিয়মিতভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করছেন। তাঁরা এখানে যথার্থই বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলেন।
স্বল্প রাজস্ব আয়ের দেশে এটা তো অবশ্যই বিরাট সমস্যা। তবে এটাও বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, বরাদ্দের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বরাদ্দের টাকার গুণগত ব্যবহার এবং ব্যবহারে ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ। শিক্ষা খাত যেখানে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে বিবেচিত হয়, সেই জাতি তার অগ্রগতিকে বেশি দিন ধরে রাখতে পারে না।
● মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক