শেক্‌সপিয়ারের রাজকুমার হ্যামলেট সংশয়বাদী। সেই কারণে সে বলেছে, ‘টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন।’ ‘টু বি’ মানে ‘বেঁচে থাকা’ আর ‘নট টু বি’ মানে ‘মৃত্যু’। কোনটা সে বেছে নেবে, সেটিই তার সামনে বিরাট প্রশ্ন।

যেহেতু মৃত্যুই শেষ পরিণতি, তাই সংকটময় পরিস্থিতিতে বাস্তবতা মেনে নিয়ে মৃত্যুর কাছে সঁপে দেওয়াই ঠিক হবে; নাকি যেকোনো উপায়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে, তা হ্যামলেট ঠিক করে উঠতে পারেনি। তার মনে দ্বিধা থেকে গেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মাফিয়া সর্দারের মতো করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে ডেকে নিয়ে ক্যামেরার সামনে যাচ্ছেতাই অপমান করে তাঁকে প্রকারান্তরে ‘বাড়ি থেকে বের করে’ দিয়েছেন।

এরপর জেলেনস্কি সম্ভবত হ্যামলেটের ‘টু বি অর নট টু বি’ দশায় পড়েছেন।

আরও পড়ুনআসুন, ইউক্রেন যুদ্ধের মূল (খল) নায়কের সঙ্গে পরিচিত হই২০ মার্চ ২০২২

ট্রাম্প ইউক্রেনকে অস্ত্রপাতি দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে সরাসরি পুতিনের পক্ষ নিয়েছেন। এখন জেলেনস্কির সামনে দুটি পথ, তাঁকে একটি বেছে নিতে হবে।

পয়লা নম্বর পথ হলো ‘টু বি’র পথ। অর্থাৎ ট্রাম্প ও পুতিনের চাপিয়ে দেওয়া সব শর্ত মেনে নিয়ে শান্তিচুক্তি নামক দাসখতে সই করে ইউক্রেনের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা।

দ্বিতীয় পথ হলো ‘নট টু বি’র পথ। অর্থাৎ কিনা, ‘জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে, যে ডরে ভীরু সে মূঢ়, শত ধিক্ তারে!’ টাইপের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে লড়তে লড়তে মর্যাদাকর মৃত্যুকে বেছে নেওয়া। অর্থাৎ প্রায় অবধারিতভাবে এই যুদ্ধে হেরে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলা।

জেলেনস্কি অবশেষে ট্রাম্প ও পুতিনের শর্তানুসারে যুদ্ধবিরতির দিকেই হাঁটলেন। অর্থাৎ এক প্রকার বাধ্য হলেন।

ইউক্রেনের সামনে ঢাল হিসেবে যে যুক্তরাষ্ট্র এত দিন ছিল, সেই ঢাল ট্রাম্প সরিয়ে নিয়েছেন।

ইউরোপ যদিও বলছে, তারা দ্রুত সাহায্য বাড়িয়ে সেই ঢাল সরবরাহ করবে; কিন্তু তাদের আশ্বাসের ওপর ভরসা কম।

তাই ঢালবিহীন নিধিরাম সর্দার জেলেনস্কির পক্ষে সুপার পাওয়ার রাশিয়ার বিরুদ্ধে কতক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব, ‘দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন’।

দুগিনের ‘টু বি অর নট টু ‍বি’

মোটাদাগে বোঝা যাচ্ছে, ইউক্রেন তথা ইউরোপ এই যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে।

এখন ট্রাম্পের চাপে পড়ে জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি চুক্তি করলেন। সামনে হয়তো দেখা যাবে, এই বিশাল এলাকা স্থায়ীভাবে রাশিয়াকে লিখে–পড়ে দিতে হবে।

কিন্তু ইউক্রেনের ভূখণ্ড হাতিয়ে নিতে পারলে কি রাশিয়া এখানেই থেমে যাবে? পুতিন কি এখানেই যুদ্ধ শেষ করবেন? নিজের দেহের পাঁচ ভাগের এক ভাগ কেটে রাশিয়াকে দিয়েও কি ইউক্রেন নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে?

মনে হয় না। কারণ, যে ব্যক্তিকে কেউ বলেন, ‘পুতিনের মগজ’, কেউ বলেন, ‘পুতিনের রাসপুটিন’; সেই রুশ রাজনৈতিক দার্শনিক আলেকসান্দর দুগিনের দর্শন পুরোপুরি যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে নয়।

দুগিন বলেছেন, ‘কে থাকবে, আর কে নাই হয়ে যাবে, তার একমাত্র ফয়সালাকারী হলো যুদ্ধ।.

..যুদ্ধ এমন এক মেটাফিজিক্যাল বিষয়, যা কোনো কিছুকে নাই করতে দিতে পারে; আবার নাই হয়ে থাকা কোনো কিছুকে নতুন করে অস্তিত্ব দিতে পারে।’

আরও পড়ুনদুগিনের তত্ত্ব: গাজা ইস্যুতে মুসলিম বিশ্ব কি ঘুরে দাঁড়াবে?১৭ জানুয়ারি ২০২৪

গত বছরের আগস্টে জিওপলিটিকা ডট আরইউ ওয়েবসাইটে দুগিন ‘ওয়ার অ্যাফেক্টস দ্য ভেরি নেচার অব এক্সিস্ট্যান্স-ইট ইজ ওয়ার দ্যাট ডিসাইডস হোয়াট এক্সিস্টস অ্যান্ড হোয়াট ডাজ নট’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে এসব কথা লিখেছেন।

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের উক্তি সামনে এনে দুগিন বলেছেন, ‘যুদ্ধ একজনকে প্রভু বানায়, আরেকজনকে দাসে পরিণত করে।...বিজয়ীদের বিচার করা হয় না, বিচার হয় পরাজিতদের। বিজয়ী প্রভু হয়ে যায় এবং তাই তার অস্তিত্ব থাকে। পরাজিত হয় অস্তিত্বহীন হয়ে যায়, নয়তো দাসে পরিণত হয়; আর দাসত্ব নাই হয়ে যাওয়া বা অস্তিত্বহীনতার চেয়েও নিকৃষ্ট।’

ওই নিবন্ধে দুগিন লিখেছেন, ‘আজকের জার্মানি বা জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, ফলে এখন তারা পশ্চিমাদের দাস। কার্যত তাদের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই।’

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রসঙ্গ টেনে দুগিন লিখেছেন, ‘শীতল যুদ্ধের পর গর্বাচেভ, ইয়েলেৎসিন ও উদারপন্থী সংস্কারকদের কারণে রাশিয়া পরাজিতদের দলে পড়ে। যাঁরা এই বিশ্বাসঘাতকদের সমর্থন করেছিলেন এবং ম্যাকডোনাল্ডসের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরাও সোভিয়েত ভাঙার জন্য সমান দায়ী।’

দুগিন তাঁর লেখায় বলছেন, ‘অস্তিত্ব অতীত দ্বারা প্রমাণিত হয় না; এটি বর্তমানের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্মাণের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হয়।’

খটোমটো এই বক্তব্যের মানে যা দাঁড়ায় তা হলো, শুধু ইতিহাসে কোনো ভূখণ্ড বা জাতির উপস্থিতি থাকলেই সেটিকে চূড়ান্তভাবে ‘টু বি’ বা ‘থাকা’ বলা যায় না। বরং বর্তমানে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করে ভবিষ্যৎ গড়তে পারলে সেটিই হবে প্রকৃতপক্ষে ‘থাকা’।

দুগিন বোঝাতে চান, রাশিয়া যদি চলমান এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে হারিয়ে দেয়, তাহলে রাশিয়ার পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব হবে, ইউক্রেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কোনো দিনই অস্তিত্বশীল ছিল না।

আরও পড়ুনপুতিন কি ধর্মযুদ্ধে নেমেছেন?২৫ মার্চ ২০২২

ওই লেখায় দুগিন সরাসরি বলেছেন, তিনি চান না, ইউক্রেনের অস্তিত্ব থাকুক। এটি শুধু দুগিনের ব্যক্তিগত চাওয়া নয়; এটি রাশিয়ার জিওপলিটিক্যাল দৃষ্টিকোণেরও প্রতিফলন, যেখানে ইউক্রেনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করা হয় না।

দুগিনের দাবি, ইউক্রেন কখনোই প্রকৃতপক্ষে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ছিল না, এটি ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ ছিল এবং রাশিয়ার অংশ হিসেবেই দেশটিকে গণ্য করা উচিত।

সুতরাং দুগিনের আলাপকে পুতিন যদি আমলে নেন, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, যুদ্ধ আপাতত থামলেও শেষ পর্যন্ত তা থামবে না।

কারণ, দুগিন মনে করেন, স্নায়ুযুদ্ধে হেরে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া বিশ্ব-আসন থেকে নাই হয়ে গেছে, অর্থাৎ রাশিয়া তার ‘অস্তিত্ব’ হারিয়েছে।

রাশিয়ার সেই অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ হলো যুদ্ধ। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাশিয়া যদি গোটা পশ্চিমের সঙ্গে লড়ে ইউক্রেনকে দখল করে নিতে পারে, শুধু তাহলেই রাশিয়া নিজের ‘অস্তিত্ব’ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

দুগিন বলছেন, যদি কেউ অতীত–সম্পর্কিত প্রচলিত ভাষ্য পাল্টে ফেলতে চায়, তাহলে তাকে ক্ষমতা দখল করতে হবে; অর্থাৎ বিজয়ী হতে হবে।

কারণ, ক্ষমতার সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক আছে। অস্তিত্বের সঙ্গে বিজয়ের সংযোগ আছে।

আরও পড়ুনহ্যাঁ, ‘মিরাকল অব গড’ পুতিন ‘ধর্মযুদ্ধে’ নেমেছেন৩০ মার্চ ২০২২

দুগিন তাঁর লেখায় বলেছেন, খ্রিষ্টান চার্চ অতীতে কিছু বিষয়কে ‘ঘটেনি’ বলে ঘোষণা করেছে। তাদের এই ঘোষণাটি অস্তিত্বের, অর্থাৎ কোনো কিছুর থাকা বা না থাকার একটি দার্শনিক সিদ্ধান্ত।

তাঁর মতে, অতীতে চার্চ যে ঘটনাকে ‘ঘটেনি’ বলে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে, হয়তো সেই ঘটনার অস্তিত্ব কোনো না কোনোভাবে ছিল, কিন্তু ক্ষমতাধরেরা সে অস্তিত্বকে শূন্যের কাতারে নামিয়ে দিয়েছেন।

জর্জ অরওয়েল তাঁর ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে বলেছেন, ‘যে বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করে, সে অতীতকেও নিয়ন্ত্রণ করে।’ অরওয়েল এটিকে ‘টোটালিটারিয়ান’ বা একনায়কতান্ত্রিক বিষয় বলেছেন।

আর দুগিন মনে করেন, এটি শুধু একনায়কতন্ত্রের ব্যাপার নয়, বরং এটিই চিরকালীন সত্য। তিনি বলছেন, ক্ষমতাধরেরা অতীতকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাখ্যা করে। কেউ যদি সেই ব্যাখ্যা বদলাতে চায়, তাহলে তাকে ক্ষমতা দখল করতে হবে।

দুগিন বলছেন, পুতিন ‘অস্তিত্বহীন’ রাশিয়াকে বিশ্বমঞ্চে পুনরুজ্জীবিত করার লড়াই চালাচ্ছেন এবং রাশিয়া কেবল তখনই সত্যিকারের অস্তিত্ব লাভ করবে, যখন সে জয়ী হবে। কারণ, অস্তিত্ব আর বিজয় একই জিনিস। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া হলো তা-ই, যা আসতে চলেছে।’

এই যুদ্ধ ইউক্রেনের জন্য যেমন ‘টু বি’ বা ‘থাকা’ তথা অস্তিত্ব টেকানোর লড়াই; তেমনি রাশিয়ার জন্যও এটি ‘টু বি’র লড়াই।

ধরা যাক, একটা শোল মাছ একটা পুঁটি মাছকে ধাওয়াচ্ছে। পুঁটি ছুটছে। পুঁটি ধরা পড়লেই তাকে মরতে হবে, তার অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে। আর শোল যদি তাকে ধরতে না পারে, তাহলে না খেতে পেয়ে শোলের মৃত্যু হবে এবং তার অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে।

তার মানে হানাদার আর হানার শিকার—দুজনই অস্তিত্ব টেকাতে হানাহানি করছে।

দ্য ফোর্থ পলিটিক্যাল থিওরি

‘অস্তিত্বহীন’ রাশিয়াকে ‘অস্তিত্বশীল’ করার জন্য দুগিন ‘ফোর্থ পলিটিক্যাল থিওরি’ বা ‘চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব’ নামের একটি তত্ত্ব প্রচার করে যাচ্ছেন।

‘দ্য ফোর্থ পলিটিক্যাল থিওরি’ শিরোনামে তাঁর লেখা বইয়ে তিনি এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। বইটি রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে অবশ্যপাঠ্য। দুগিন তাঁর এই বইয়ের ভূমিকার শিরোনামও দিয়েছেন ‘টু বি অর নট টু বি?’

এই বইয়ে দুগিন বলছেন, বিশ শতকে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক তত্ত্ব ছিল:

প্রথম রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো উদারবাদ, দ্বিতীয় রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো সমাজতন্ত্র এবং তৃতীয় রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো ফ্যাসিবাদ।

এর মধ্যে সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদকে হারিয়ে উদারবাদ বিংশ শতক থেকে বিশ্বজুড়ে রাজত্ব করছে।

দুগিনের মতে, রাশিয়াকে ‘অস্তিত্বহীন’ থেকে ‘অস্তিত্বশীল’ করতে হলে এই তিন তত্ত্বের বাইরে গিয়ে ‘চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব’ গ্রহণ করতে হবে।

এই তত্ত্ব নিয়ে দুগিন বিশদে যত কথা বলেছেন, তার চুম্বক কথা হলো শাসন, আইন, মানবাধিকার—এগুলো স্থানীয় সংস্কৃতির বিষয়।

এই থিওরি অনুসারে রাশিয়াই ঠিক করবে কোনটি মানবাধিকারের মধ্যে পড়বে, আর কোনটি পড়বে না। যুক্তরাষ্ট্রে বা পশ্চিমি সমাজে যেটিকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, রাশিয়ায় সেটিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে ধরা হতে পারে।

পশ্চিম যে উদারবাদ তথা পুঁজিবাদের অনুসরণ করে, সেখানে ব্যক্তি সত্তার স্বাধীনতাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়। পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে ব্যক্তি কীভাবে জীবন চালাবে, তা নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামায় না।

কিন্তু দুগিনের প্রচারিত ‘চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব’ সমাজের মৌলিক নিয়মনীতি বা ঐতিহ্যকে ব্যক্তিরও ওপরে গুরুত্ব দেয়।

দুগিনের প্রচারিত এই তত্ত্ব মূলত অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটিকে দারুণভাবে ধারণ করে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাভিত্তিক পশ্চিমা সংস্কৃতিকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে।

যেমন লিঙ্গ ইস্যুতে পশ্চিমা উদারবাদ যে ব্যক্তিস্বাধীনতা অনুমোদন করে, চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব তা রাশিয়ায় অনুমোদন করে না।

এই বইয়ের ভূমিকায় দুগিন বলছেন, ‘রাশিয়ার জন্য উদারবাদ উপযোগী নয়। আবার কমিউনিজম বা ফ্যাসিবাদও গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমাদের চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রয়োজন। কারও কাছে এটি হয়তো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা রাজনৈতিক ইচ্ছার বিষয় হতে পারে; কেউ এটিকে সমর্থন করতে পারেন, কেউ বিরোধিতা করতে পারেন। কিন্তু রাশিয়ার জন্য এটি বাঁচা–মরার প্রশ্ন; “টু বি অর নট টু বি”র প্রশ্ন। রাশিয়ার জন্য এটি হ্যামলেটের সেই চিরন্তন দ্বিধাসূচক প্রশ্ন “বাঁচব নাকি মারা যাব?”’

সাবেক সোভিয়েতভুক্ত ভূখণ্ডের অধিবাসী হওয়ার সুবাদে ইউক্রেনবাসীর একটি বড় অংশ জাতিগতভাবে রুশ। রাশিয়ার মানুষের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা আছে। তাঁরা ক্যাথলিক নন, অর্থোডক্স খ্রিষ্টান।

ফলে ইউরোপীয় ক্যাথলিকদের সঙ্গে ইউক্রেনের অর্থোডক্স রুশদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা রয়েছে।

কিন্তু ইউক্রেন ইউরোপের সংস্পর্শে আসার কারণে সেখানে পশ্চিমা সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করেছে। সেখানে ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসির আউটলেটে ইউক্রেনীয় রুশরা লাইন লাগাচ্ছেন। ঐতিহ্যবাহী রুশ অর্থোডক্স রক্ষণশীলতা থেকে সরে যাচ্ছেন।

রাশিয়া যেহেতু ইউক্রেনকে তার লাগোয়া বারান্দা মনে করে, সেহেতু সেখানে পশ্চিমা উদারবাদী সংস্কৃতির আবাদকে চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্বে বিশ্বাসীরা রাশিয়ার রক্ষণশীল সমাজের জন্য হুমকি মনে করেন।

এই চিন্তা থেকেই দুগিন তাঁর ১৯৯৭ সালে লেখা ‘ফাউন্ডেশনস অব জিওপলিটিকস: দ্য জিওপলিটিক্যাল ফিউচার অব রাশিয়া’ বইটিতে ইউক্রেনকে রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশলের একটি প্রধান অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।

ওই বইতে তিনি যুক্তি দেন, রাশিয়ার উচিত ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করে একটি শক্তিশালী ইউরেশীয় সাম্রাজ্য গঠন করা। এটিই এখনকার বহুল আলোচিত ‘ইউরেশিয়ানিজম’।

এই মতবাদে তিনি যে ‘ইউরেশিয়ান ইউনিয়ন’-এর ধারণা দিয়েছেন, তা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোকে রাশিয়ার নেতৃত্বে একীভূত করার পরিকল্পনা আছে।

এই ধারণাকে পরে পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

ওই বইয়ে দুগিন বলেন, ‘ইউক্রেনের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কোনো তাৎপর্য নেই এবং এটি রাশিয়ার অংশ হওয়া উচিত।’

মেদুজার কাছে একটি ২৪০ পৃষ্ঠার লেকচার সিরিজ ও ৭৬ পৃষ্ঠার শিক্ষা পরিকল্পনা এবং রাশিয়ার বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনার (প্রেজেন্টেশন) নথি এসেছে। এগুলো দুগিনের দল তৈরি করেছে। এই কাজগুলো করা হয়েছে রাশিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি ফর দ্য হিউম্যানিটিজের ইভান ইলিন হায়ার পলিটিক্যাল স্কুল থেকে। দুগিন ও তাঁর সহযোগীরা পুতিনকে সতর্ক করে দিয়েছেন, রাশিয়ার রাজনীতিবিজ্ঞানে বর্তমানে ‘আমেরিকাকেন্দ্রিকতা’ (আমেরিকাসেন্ট্রিজম) বিরাজ করছে এবং এটি ‘দমন’ করা দরকার।২৪০ পৃষ্ঠার লেকচার আর ৭৬ পৃষ্ঠার শিক্ষা পরিকল্পনা এবং দুগিনের ‘জনসমর্থিত গণতন্ত্র’

তবে রাতারাতি চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব রাশিয়ায় যে দাঁড় করানো যাবে না, সেটি দুগিন ও প্রেসিডেন্ট পুতিন দুজনেই জানেন। তাঁরা বোঝেন, এর জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নতুন প্রজন্মের রাশিয়ান নাগরিকদের তৈরি করতে হবে। নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক জ্ঞানের কাঠামোকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।

সে লক্ষ্যেই দুগিন রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতিবিজ্ঞান শেখানোর পদ্ধতিকেই বদলে ফেলতে চাইছেন।

রাশিয়ার বেশ কয়েকজন নামকরা সাংবাদিক পুতিনের দমন–পীড়ন থেকে বাঁচতে লাটভিয়ার রিগায় গিয়ে মেদুজা নামের একটি অনলাইন পোর্টাল চালাচ্ছেন।

সেই মেদুজা একটি প্রতিবেদনে বলেছে, দুগিন চান, রাশিয়ার উচ্চশিক্ষার মানবিক বিভাগগুলোতে রাজনীতিবিজ্ঞান শেখানোর পদ্ধতি বদলে দেওয়া হোক।

মেদুজার কাছে একটি ২৪০ পৃষ্ঠার লেকচার সিরিজ ও ৭৬ পৃষ্ঠার শিক্ষা পরিকল্পনা এবং রাশিয়ার বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনার (প্রেজেন্টেশন) নথি এসেছে।

এগুলো দুগিনের দল তৈরি করেছে। এই কাজগুলো করা হয়েছে রাশিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি ফর দ্য হিউম্যানিটিজের ইভান ইলিন হায়ার পলিটিক্যাল স্কুল থেকে।

দুগিন ও তাঁর সহযোগীরা পুতিনকে সতর্ক করে দিয়েছেন, রাশিয়ার রাজনীতিবিজ্ঞানে বর্তমানে ‘আমেরিকাকেন্দ্রিকতা’ (আমেরিকাসেন্ট্রিজম) বিরাজ করছে এবং এটি ‘দমন’ করা দরকার।

দুগিনের মতে, রাশিয়ার রাজনীতিবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত রাশিয়ায় নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম বাড়ানো এবং রাষ্ট্র ও সমাজের স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।

তিনি ‘নাগরিক সচেতনতা’ বলতে রাষ্ট্রীয় বিধান ও সমাজের কল্যাণকে ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়াকে বোঝান।

তাঁর মতে, পশ্চিমা ধারণা (যেমন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা বিশ্বনাগরিকতা) রাশিয়ার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর।

দুগিনের প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমে শিক্ষকদের রাশিয়ার ইতিহাসের তিনটি মূল ধারণা শেখাতে বলা হয়েছে:

১. অর্থোডক্স খ্রিষ্টধর্ম

২. স্বৈরতন্ত্র

৩. জাতীয়তাবাদ।

দুগিনের প্রস্তাবিত শিক্ষা পরিকল্পনা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের বলা হবে রাশিয়ার জারতন্ত্র প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী।

১৬ শতকের একটি তত্ত্ব ব্যবহার করে দুগিন চান নব্য উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।

এই তত্ত্ব অতীতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ১৭ শতকে রোমান জারদের পোলিশ-লিথুয়ানীয় ও অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় এই তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়েছিল।

দুগিনের মতে, রাশিয়ার শিক্ষার্থীদের শেখানো উচিত মস্কো হলো ‘তৃতীয় রোম’। অর্থাৎ রোম ও কনস্টান্টিনোপলের পর রাশিয়াই সভ্যতার নতুন কেন্দ্র।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার দুর্বলতাকে দুগিনের পাঠ্যক্রমে খারাপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর পুতিনের ক্ষমতায় আসাকে রাশিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এখানে বলা হয়েছে, পুতিন দেশটির সার্বভৌমত্ব ও শক্তি ফিরিয়ে এনেছেন। বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে এই পাঠ্যক্রমে রাশিয়ার ‘আদর্শিক স্বাধীনতা’ অর্জনের শেষ ধাপ হিসেবে বলা হয়েছে।

দুগিন চান, রুশ শিক্ষার্থীরা মনে করুক রাশিয়ার বর্তমান শাসনব্যবস্থাই সবচেয়ে ভালো। এই ব্যবস্থায় একজন শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট জনগণের ভোটে ক্ষমতায় থাকেন।

দুগিন এটিকে ‘জনসমর্থিত গণতন্ত্র’ বলেন। তাঁর মতে, ক্ষমতা ভাগ করা বা নেতা বদলের ব্যবস্থা বিপজ্জনক, কারণ এতে অদক্ষ আমলারা ক্ষমতা দখল করেন। তিনি সমাজে শান্তি বজায় রাখা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে পবিত্র ও ঐতিহ্যবাহী বলে মনে করেন।

দুগিনের পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় দর্শনের প্রভাব বেশি। যেমন এই পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে, রাষ্ট্র হলো একধরনের ‘রক্ষাকারী শক্তি’, যা বিশ্বকে অরাজকতা থেকে বাঁচায়।

প্রাচীন রোমান সম্রাট বা রাশিয়ার জারদের মতো বর্তমান রাশিয়ার সরকারকেও এই ভূমিকায় দেখতে হবে।

দুই সভ্যতার চিরন্তন যুদ্ধ

দুগিন বিশ্বাস করেন, ইতিহাসজুড়ে ‘স্থলভিত্তিক’ ও ‘সমুদ্রভিত্তিক’ সভ্যতার লড়াই চলেছে।

রাশিয়া হলো স্থলভিত্তিক সভ্যতা, যার মূলনীতি স্থিতিশীলতা, রক্ষণশীলতা ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী।

পশ্চিমা দেশগুলো হলো সমুদ্রভিত্তিক সভ্যতা, যারা বাণিজ্য, নৌশক্তি ও তথ্য দিয়ে ক্ষমতা বাড়ায়।

দুগিনের ভাষায়, ইউক্রেন যুদ্ধকে এই দুই সভ্যতার লড়াইয়ের অংশ বলা হয় এবং ২০১৪ সালে ইউক্রেনে পশ্চিমা প্রভাব বাড়াকে রাশিয়ার জন্য হুমকি হিসেবে দেখানো হয়।

মার্ক্সবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করলেও দুগিনের পাঠ্যক্রমে চীন ও উত্তর কোরিয়াকে সম্মান দেওয়া হয়। চীনের রাজনীতিতে কনফুসিয়াসের শিক্ষা এবং উত্তর কোরিয়ার জুচে মতবাদকে ঐতিহ্যবাহী দর্শনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

তো, দুগিন মনে করেন, ‘টু বি অর নট টু বি’র সন্ধিক্ষণে অস্তিত্ব হারানো রাশিয়াকে অস্তিত্বশীল করতে পারেন একজন ‘জার’। সেই জার হলেন ভ্লাদিমির পুতিন।

গত বছরের ৭ অক্টোবর পুতিনকে তাঁর ৭২তম জন্মদিনে ‘ঈশ্বর জারকে রক্ষা করুন’ বলে নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন দুগিন।

টেলিগ্রামে তাঁর ৭১ হাজারের বেশি অনুসারীর উদ্দেশে দেওয়া বার্তায় দুগিন কামনা করেন, ‘দেবদূতেরা’ যেন ‘সম্রাট’ পুতিনের মাথায় ‘সোনার মুকুট’ পরিয়ে দেন। একই সঙ্গে তিনি ৭২ বছর বয়সকে পুতিনের ‘দ্বিতীয় যৌবন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

পুতিন এযাবৎকাল দুগিনের তত্ত্ব মেনে ক্রিমিয়া দখল থেকে শুরু করে ইউক্রেন অভিযানের মতো কাজ একে একে করে এসেছেন। একের পর এক দুগিনের তত্ত্ব বাস্তবায়ন করে এসেছেন।

এখন যেহেতু ‘রাসপুটিন’ দুগিন বলছেন, রাশিয়ার ‘অস্তিত্ব’ ফিরিয়ে আনার একমাত্র পন্থা যুদ্ধ করে ইউক্রেনকে সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার দখলে নিয়ে নেওয়া; সেহেতু ‘জার’ পুতিন ইউক্রেন দখলের অভিলাষ থেকে ফিরে আসবেন, তা মনে করা কঠিন।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই–মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ব জ ঞ ন র শ য় র জন য দ গ ন বলছ ন ইউক র ন র তত ত ব ব দ গ ন বল র র জন ত এই য দ ধ ন ই হয় আম র ক ন র মত বল ছ ন র স মন পর জ ত ক ষমত র একট ইউর প

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভবনের পাশ থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একটি ভবনের পাশ থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

গতকাল রোববার বিকেলে লাশটি উদ্ধার করা হয়। যুবকের নাম তারেক রহমান ওরফে সানি (৩৫)। তাঁর হাত-পা ভাঙা ছিল।

পুলিশের ধারণা, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চুরি করতে ঢুকেছিল এই যুবক। ধাওয়া খেয়ে ভবন থেকে পড়ে তিনি মারা গেছেন।

শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) যোবায়ের হোসেন আজ সোমবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে একটি ফোন আসে। বলা হয়, একটি ভবনের পাশে এক যুবকের লাশ পড়ে আছে। পরে পুলিশ গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে।

ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ।

এসআই যোবায়ের হোসেন বলেন, তাঁদের প্রাথমিক ধারণা, তারেক চুরি করতে গিয়ে ধাওয়া খেয়ে ভবনের পঞ্চম তলার বারান্দা থেকে পা ফসকে নিচে পড়ে যান। কারণ, পঞ্চম তলার বারান্দায় কোনো রেলিং ছিল না। আগে চুরির অভিযোগে তারেক জেল খেটেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে চুরি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্বজনদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, তারেকের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায়। তিনি রাজধানীতে থাকতেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ