দুগিনের দুনিয়ায় ‘থাকা’, ‘না থাকা’
Published: 15th, March 2025 GMT
শেক্সপিয়ারের রাজকুমার হ্যামলেট সংশয়বাদী। সেই কারণে সে বলেছে, ‘টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন।’ ‘টু বি’ মানে ‘বেঁচে থাকা’ আর ‘নট টু বি’ মানে ‘মৃত্যু’। কোনটা সে বেছে নেবে, সেটিই তার সামনে বিরাট প্রশ্ন।
যেহেতু মৃত্যুই শেষ পরিণতি, তাই সংকটময় পরিস্থিতিতে বাস্তবতা মেনে নিয়ে মৃত্যুর কাছে সঁপে দেওয়াই ঠিক হবে; নাকি যেকোনো উপায়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে, তা হ্যামলেট ঠিক করে উঠতে পারেনি। তার মনে দ্বিধা থেকে গেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মাফিয়া সর্দারের মতো করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে ডেকে নিয়ে ক্যামেরার সামনে যাচ্ছেতাই অপমান করে তাঁকে প্রকারান্তরে ‘বাড়ি থেকে বের করে’ দিয়েছেন।
এরপর জেলেনস্কি সম্ভবত হ্যামলেটের ‘টু বি অর নট টু বি’ দশায় পড়েছেন।
আরও পড়ুনআসুন, ইউক্রেন যুদ্ধের মূল (খল) নায়কের সঙ্গে পরিচিত হই২০ মার্চ ২০২২ট্রাম্প ইউক্রেনকে অস্ত্রপাতি দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে সরাসরি পুতিনের পক্ষ নিয়েছেন। এখন জেলেনস্কির সামনে দুটি পথ, তাঁকে একটি বেছে নিতে হবে।
পয়লা নম্বর পথ হলো ‘টু বি’র পথ। অর্থাৎ ট্রাম্প ও পুতিনের চাপিয়ে দেওয়া সব শর্ত মেনে নিয়ে শান্তিচুক্তি নামক দাসখতে সই করে ইউক্রেনের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা।
দ্বিতীয় পথ হলো ‘নট টু বি’র পথ। অর্থাৎ কিনা, ‘জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে, যে ডরে ভীরু সে মূঢ়, শত ধিক্ তারে!’ টাইপের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে লড়তে লড়তে মর্যাদাকর মৃত্যুকে বেছে নেওয়া। অর্থাৎ প্রায় অবধারিতভাবে এই যুদ্ধে হেরে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলা।
জেলেনস্কি অবশেষে ট্রাম্প ও পুতিনের শর্তানুসারে যুদ্ধবিরতির দিকেই হাঁটলেন। অর্থাৎ এক প্রকার বাধ্য হলেন।
ইউক্রেনের সামনে ঢাল হিসেবে যে যুক্তরাষ্ট্র এত দিন ছিল, সেই ঢাল ট্রাম্প সরিয়ে নিয়েছেন।
ইউরোপ যদিও বলছে, তারা দ্রুত সাহায্য বাড়িয়ে সেই ঢাল সরবরাহ করবে; কিন্তু তাদের আশ্বাসের ওপর ভরসা কম।
তাই ঢালবিহীন নিধিরাম সর্দার জেলেনস্কির পক্ষে সুপার পাওয়ার রাশিয়ার বিরুদ্ধে কতক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব, ‘দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন’।
দুগিনের ‘টু বি অর নট টু বি’মোটাদাগে বোঝা যাচ্ছে, ইউক্রেন তথা ইউরোপ এই যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে।
এখন ট্রাম্পের চাপে পড়ে জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি চুক্তি করলেন। সামনে হয়তো দেখা যাবে, এই বিশাল এলাকা স্থায়ীভাবে রাশিয়াকে লিখে–পড়ে দিতে হবে।
কিন্তু ইউক্রেনের ভূখণ্ড হাতিয়ে নিতে পারলে কি রাশিয়া এখানেই থেমে যাবে? পুতিন কি এখানেই যুদ্ধ শেষ করবেন? নিজের দেহের পাঁচ ভাগের এক ভাগ কেটে রাশিয়াকে দিয়েও কি ইউক্রেন নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে?
মনে হয় না। কারণ, যে ব্যক্তিকে কেউ বলেন, ‘পুতিনের মগজ’, কেউ বলেন, ‘পুতিনের রাসপুটিন’; সেই রুশ রাজনৈতিক দার্শনিক আলেকসান্দর দুগিনের দর্শন পুরোপুরি যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে নয়।
দুগিন বলেছেন, ‘কে থাকবে, আর কে নাই হয়ে যাবে, তার একমাত্র ফয়সালাকারী হলো যুদ্ধ।.
গত বছরের আগস্টে জিওপলিটিকা ডট আরইউ ওয়েবসাইটে দুগিন ‘ওয়ার অ্যাফেক্টস দ্য ভেরি নেচার অব এক্সিস্ট্যান্স-ইট ইজ ওয়ার দ্যাট ডিসাইডস হোয়াট এক্সিস্টস অ্যান্ড হোয়াট ডাজ নট’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে এসব কথা লিখেছেন।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের উক্তি সামনে এনে দুগিন বলেছেন, ‘যুদ্ধ একজনকে প্রভু বানায়, আরেকজনকে দাসে পরিণত করে।...বিজয়ীদের বিচার করা হয় না, বিচার হয় পরাজিতদের। বিজয়ী প্রভু হয়ে যায় এবং তাই তার অস্তিত্ব থাকে। পরাজিত হয় অস্তিত্বহীন হয়ে যায়, নয়তো দাসে পরিণত হয়; আর দাসত্ব নাই হয়ে যাওয়া বা অস্তিত্বহীনতার চেয়েও নিকৃষ্ট।’
ওই নিবন্ধে দুগিন লিখেছেন, ‘আজকের জার্মানি বা জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, ফলে এখন তারা পশ্চিমাদের দাস। কার্যত তাদের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই।’
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রসঙ্গ টেনে দুগিন লিখেছেন, ‘শীতল যুদ্ধের পর গর্বাচেভ, ইয়েলেৎসিন ও উদারপন্থী সংস্কারকদের কারণে রাশিয়া পরাজিতদের দলে পড়ে। যাঁরা এই বিশ্বাসঘাতকদের সমর্থন করেছিলেন এবং ম্যাকডোনাল্ডসের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরাও সোভিয়েত ভাঙার জন্য সমান দায়ী।’
দুগিন তাঁর লেখায় বলছেন, ‘অস্তিত্ব অতীত দ্বারা প্রমাণিত হয় না; এটি বর্তমানের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্মাণের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হয়।’
খটোমটো এই বক্তব্যের মানে যা দাঁড়ায় তা হলো, শুধু ইতিহাসে কোনো ভূখণ্ড বা জাতির উপস্থিতি থাকলেই সেটিকে চূড়ান্তভাবে ‘টু বি’ বা ‘থাকা’ বলা যায় না। বরং বর্তমানে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করে ভবিষ্যৎ গড়তে পারলে সেটিই হবে প্রকৃতপক্ষে ‘থাকা’।
দুগিন বোঝাতে চান, রাশিয়া যদি চলমান এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে হারিয়ে দেয়, তাহলে রাশিয়ার পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব হবে, ইউক্রেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কোনো দিনই অস্তিত্বশীল ছিল না।
আরও পড়ুনপুতিন কি ধর্মযুদ্ধে নেমেছেন?২৫ মার্চ ২০২২ওই লেখায় দুগিন সরাসরি বলেছেন, তিনি চান না, ইউক্রেনের অস্তিত্ব থাকুক। এটি শুধু দুগিনের ব্যক্তিগত চাওয়া নয়; এটি রাশিয়ার জিওপলিটিক্যাল দৃষ্টিকোণেরও প্রতিফলন, যেখানে ইউক্রেনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করা হয় না।
দুগিনের দাবি, ইউক্রেন কখনোই প্রকৃতপক্ষে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ছিল না, এটি ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ ছিল এবং রাশিয়ার অংশ হিসেবেই দেশটিকে গণ্য করা উচিত।
সুতরাং দুগিনের আলাপকে পুতিন যদি আমলে নেন, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, যুদ্ধ আপাতত থামলেও শেষ পর্যন্ত তা থামবে না।
কারণ, দুগিন মনে করেন, স্নায়ুযুদ্ধে হেরে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া বিশ্ব-আসন থেকে নাই হয়ে গেছে, অর্থাৎ রাশিয়া তার ‘অস্তিত্ব’ হারিয়েছে।
রাশিয়ার সেই অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ হলো যুদ্ধ। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাশিয়া যদি গোটা পশ্চিমের সঙ্গে লড়ে ইউক্রেনকে দখল করে নিতে পারে, শুধু তাহলেই রাশিয়া নিজের ‘অস্তিত্ব’ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
দুগিন বলছেন, যদি কেউ অতীত–সম্পর্কিত প্রচলিত ভাষ্য পাল্টে ফেলতে চায়, তাহলে তাকে ক্ষমতা দখল করতে হবে; অর্থাৎ বিজয়ী হতে হবে।
কারণ, ক্ষমতার সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক আছে। অস্তিত্বের সঙ্গে বিজয়ের সংযোগ আছে।
আরও পড়ুনহ্যাঁ, ‘মিরাকল অব গড’ পুতিন ‘ধর্মযুদ্ধে’ নেমেছেন৩০ মার্চ ২০২২দুগিন তাঁর লেখায় বলেছেন, খ্রিষ্টান চার্চ অতীতে কিছু বিষয়কে ‘ঘটেনি’ বলে ঘোষণা করেছে। তাদের এই ঘোষণাটি অস্তিত্বের, অর্থাৎ কোনো কিছুর থাকা বা না থাকার একটি দার্শনিক সিদ্ধান্ত।
তাঁর মতে, অতীতে চার্চ যে ঘটনাকে ‘ঘটেনি’ বলে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে, হয়তো সেই ঘটনার অস্তিত্ব কোনো না কোনোভাবে ছিল, কিন্তু ক্ষমতাধরেরা সে অস্তিত্বকে শূন্যের কাতারে নামিয়ে দিয়েছেন।
জর্জ অরওয়েল তাঁর ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে বলেছেন, ‘যে বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করে, সে অতীতকেও নিয়ন্ত্রণ করে।’ অরওয়েল এটিকে ‘টোটালিটারিয়ান’ বা একনায়কতান্ত্রিক বিষয় বলেছেন।
আর দুগিন মনে করেন, এটি শুধু একনায়কতন্ত্রের ব্যাপার নয়, বরং এটিই চিরকালীন সত্য। তিনি বলছেন, ক্ষমতাধরেরা অতীতকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাখ্যা করে। কেউ যদি সেই ব্যাখ্যা বদলাতে চায়, তাহলে তাকে ক্ষমতা দখল করতে হবে।
দুগিন বলছেন, পুতিন ‘অস্তিত্বহীন’ রাশিয়াকে বিশ্বমঞ্চে পুনরুজ্জীবিত করার লড়াই চালাচ্ছেন এবং রাশিয়া কেবল তখনই সত্যিকারের অস্তিত্ব লাভ করবে, যখন সে জয়ী হবে। কারণ, অস্তিত্ব আর বিজয় একই জিনিস। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া হলো তা-ই, যা আসতে চলেছে।’
এই যুদ্ধ ইউক্রেনের জন্য যেমন ‘টু বি’ বা ‘থাকা’ তথা অস্তিত্ব টেকানোর লড়াই; তেমনি রাশিয়ার জন্যও এটি ‘টু বি’র লড়াই।
ধরা যাক, একটা শোল মাছ একটা পুঁটি মাছকে ধাওয়াচ্ছে। পুঁটি ছুটছে। পুঁটি ধরা পড়লেই তাকে মরতে হবে, তার অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে। আর শোল যদি তাকে ধরতে না পারে, তাহলে না খেতে পেয়ে শোলের মৃত্যু হবে এবং তার অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে।
তার মানে হানাদার আর হানার শিকার—দুজনই অস্তিত্ব টেকাতে হানাহানি করছে।
‘অস্তিত্বহীন’ রাশিয়াকে ‘অস্তিত্বশীল’ করার জন্য দুগিন ‘ফোর্থ পলিটিক্যাল থিওরি’ বা ‘চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব’ নামের একটি তত্ত্ব প্রচার করে যাচ্ছেন।
‘দ্য ফোর্থ পলিটিক্যাল থিওরি’ শিরোনামে তাঁর লেখা বইয়ে তিনি এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। বইটি রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে অবশ্যপাঠ্য। দুগিন তাঁর এই বইয়ের ভূমিকার শিরোনামও দিয়েছেন ‘টু বি অর নট টু বি?’
এই বইয়ে দুগিন বলছেন, বিশ শতকে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক তত্ত্ব ছিল:
প্রথম রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো উদারবাদ, দ্বিতীয় রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো সমাজতন্ত্র এবং তৃতীয় রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো ফ্যাসিবাদ।
এর মধ্যে সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদকে হারিয়ে উদারবাদ বিংশ শতক থেকে বিশ্বজুড়ে রাজত্ব করছে।
দুগিনের মতে, রাশিয়াকে ‘অস্তিত্বহীন’ থেকে ‘অস্তিত্বশীল’ করতে হলে এই তিন তত্ত্বের বাইরে গিয়ে ‘চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব’ গ্রহণ করতে হবে।
এই তত্ত্ব নিয়ে দুগিন বিশদে যত কথা বলেছেন, তার চুম্বক কথা হলো শাসন, আইন, মানবাধিকার—এগুলো স্থানীয় সংস্কৃতির বিষয়।
এই থিওরি অনুসারে রাশিয়াই ঠিক করবে কোনটি মানবাধিকারের মধ্যে পড়বে, আর কোনটি পড়বে না। যুক্তরাষ্ট্রে বা পশ্চিমি সমাজে যেটিকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, রাশিয়ায় সেটিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে ধরা হতে পারে।
পশ্চিম যে উদারবাদ তথা পুঁজিবাদের অনুসরণ করে, সেখানে ব্যক্তি সত্তার স্বাধীনতাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়। পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে ব্যক্তি কীভাবে জীবন চালাবে, তা নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামায় না।
কিন্তু দুগিনের প্রচারিত ‘চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব’ সমাজের মৌলিক নিয়মনীতি বা ঐতিহ্যকে ব্যক্তিরও ওপরে গুরুত্ব দেয়।
দুগিনের প্রচারিত এই তত্ত্ব মূলত অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটিকে দারুণভাবে ধারণ করে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাভিত্তিক পশ্চিমা সংস্কৃতিকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
যেমন লিঙ্গ ইস্যুতে পশ্চিমা উদারবাদ যে ব্যক্তিস্বাধীনতা অনুমোদন করে, চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব তা রাশিয়ায় অনুমোদন করে না।
এই বইয়ের ভূমিকায় দুগিন বলছেন, ‘রাশিয়ার জন্য উদারবাদ উপযোগী নয়। আবার কমিউনিজম বা ফ্যাসিবাদও গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমাদের চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রয়োজন। কারও কাছে এটি হয়তো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা রাজনৈতিক ইচ্ছার বিষয় হতে পারে; কেউ এটিকে সমর্থন করতে পারেন, কেউ বিরোধিতা করতে পারেন। কিন্তু রাশিয়ার জন্য এটি বাঁচা–মরার প্রশ্ন; “টু বি অর নট টু বি”র প্রশ্ন। রাশিয়ার জন্য এটি হ্যামলেটের সেই চিরন্তন দ্বিধাসূচক প্রশ্ন “বাঁচব নাকি মারা যাব?”’
সাবেক সোভিয়েতভুক্ত ভূখণ্ডের অধিবাসী হওয়ার সুবাদে ইউক্রেনবাসীর একটি বড় অংশ জাতিগতভাবে রুশ। রাশিয়ার মানুষের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা আছে। তাঁরা ক্যাথলিক নন, অর্থোডক্স খ্রিষ্টান।
ফলে ইউরোপীয় ক্যাথলিকদের সঙ্গে ইউক্রেনের অর্থোডক্স রুশদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা রয়েছে।
কিন্তু ইউক্রেন ইউরোপের সংস্পর্শে আসার কারণে সেখানে পশ্চিমা সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করেছে। সেখানে ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসির আউটলেটে ইউক্রেনীয় রুশরা লাইন লাগাচ্ছেন। ঐতিহ্যবাহী রুশ অর্থোডক্স রক্ষণশীলতা থেকে সরে যাচ্ছেন।
রাশিয়া যেহেতু ইউক্রেনকে তার লাগোয়া বারান্দা মনে করে, সেহেতু সেখানে পশ্চিমা উদারবাদী সংস্কৃতির আবাদকে চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্বে বিশ্বাসীরা রাশিয়ার রক্ষণশীল সমাজের জন্য হুমকি মনে করেন।
এই চিন্তা থেকেই দুগিন তাঁর ১৯৯৭ সালে লেখা ‘ফাউন্ডেশনস অব জিওপলিটিকস: দ্য জিওপলিটিক্যাল ফিউচার অব রাশিয়া’ বইটিতে ইউক্রেনকে রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশলের একটি প্রধান অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
ওই বইতে তিনি যুক্তি দেন, রাশিয়ার উচিত ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করে একটি শক্তিশালী ইউরেশীয় সাম্রাজ্য গঠন করা। এটিই এখনকার বহুল আলোচিত ‘ইউরেশিয়ানিজম’।
এই মতবাদে তিনি যে ‘ইউরেশিয়ান ইউনিয়ন’-এর ধারণা দিয়েছেন, তা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোকে রাশিয়ার নেতৃত্বে একীভূত করার পরিকল্পনা আছে।
এই ধারণাকে পরে পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ওই বইয়ে দুগিন বলেন, ‘ইউক্রেনের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কোনো তাৎপর্য নেই এবং এটি রাশিয়ার অংশ হওয়া উচিত।’
মেদুজার কাছে একটি ২৪০ পৃষ্ঠার লেকচার সিরিজ ও ৭৬ পৃষ্ঠার শিক্ষা পরিকল্পনা এবং রাশিয়ার বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনার (প্রেজেন্টেশন) নথি এসেছে। এগুলো দুগিনের দল তৈরি করেছে। এই কাজগুলো করা হয়েছে রাশিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি ফর দ্য হিউম্যানিটিজের ইভান ইলিন হায়ার পলিটিক্যাল স্কুল থেকে। দুগিন ও তাঁর সহযোগীরা পুতিনকে সতর্ক করে দিয়েছেন, রাশিয়ার রাজনীতিবিজ্ঞানে বর্তমানে ‘আমেরিকাকেন্দ্রিকতা’ (আমেরিকাসেন্ট্রিজম) বিরাজ করছে এবং এটি ‘দমন’ করা দরকার।২৪০ পৃষ্ঠার লেকচার আর ৭৬ পৃষ্ঠার শিক্ষা পরিকল্পনা এবং দুগিনের ‘জনসমর্থিত গণতন্ত্র’তবে রাতারাতি চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্ব রাশিয়ায় যে দাঁড় করানো যাবে না, সেটি দুগিন ও প্রেসিডেন্ট পুতিন দুজনেই জানেন। তাঁরা বোঝেন, এর জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নতুন প্রজন্মের রাশিয়ান নাগরিকদের তৈরি করতে হবে। নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক জ্ঞানের কাঠামোকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।
সে লক্ষ্যেই দুগিন রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতিবিজ্ঞান শেখানোর পদ্ধতিকেই বদলে ফেলতে চাইছেন।
রাশিয়ার বেশ কয়েকজন নামকরা সাংবাদিক পুতিনের দমন–পীড়ন থেকে বাঁচতে লাটভিয়ার রিগায় গিয়ে মেদুজা নামের একটি অনলাইন পোর্টাল চালাচ্ছেন।
সেই মেদুজা একটি প্রতিবেদনে বলেছে, দুগিন চান, রাশিয়ার উচ্চশিক্ষার মানবিক বিভাগগুলোতে রাজনীতিবিজ্ঞান শেখানোর পদ্ধতি বদলে দেওয়া হোক।
মেদুজার কাছে একটি ২৪০ পৃষ্ঠার লেকচার সিরিজ ও ৭৬ পৃষ্ঠার শিক্ষা পরিকল্পনা এবং রাশিয়ার বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনার (প্রেজেন্টেশন) নথি এসেছে।
এগুলো দুগিনের দল তৈরি করেছে। এই কাজগুলো করা হয়েছে রাশিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি ফর দ্য হিউম্যানিটিজের ইভান ইলিন হায়ার পলিটিক্যাল স্কুল থেকে।
দুগিন ও তাঁর সহযোগীরা পুতিনকে সতর্ক করে দিয়েছেন, রাশিয়ার রাজনীতিবিজ্ঞানে বর্তমানে ‘আমেরিকাকেন্দ্রিকতা’ (আমেরিকাসেন্ট্রিজম) বিরাজ করছে এবং এটি ‘দমন’ করা দরকার।
দুগিনের মতে, রাশিয়ার রাজনীতিবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত রাশিয়ায় নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম বাড়ানো এবং রাষ্ট্র ও সমাজের স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
তিনি ‘নাগরিক সচেতনতা’ বলতে রাষ্ট্রীয় বিধান ও সমাজের কল্যাণকে ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়াকে বোঝান।
তাঁর মতে, পশ্চিমা ধারণা (যেমন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা বিশ্বনাগরিকতা) রাশিয়ার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর।
দুগিনের প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমে শিক্ষকদের রাশিয়ার ইতিহাসের তিনটি মূল ধারণা শেখাতে বলা হয়েছে:
১. অর্থোডক্স খ্রিষ্টধর্ম
২. স্বৈরতন্ত্র
৩. জাতীয়তাবাদ।
দুগিনের প্রস্তাবিত শিক্ষা পরিকল্পনা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের বলা হবে রাশিয়ার জারতন্ত্র প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী।
১৬ শতকের একটি তত্ত্ব ব্যবহার করে দুগিন চান নব্য উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
এই তত্ত্ব অতীতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ১৭ শতকে রোমান জারদের পোলিশ-লিথুয়ানীয় ও অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় এই তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়েছিল।
দুগিনের মতে, রাশিয়ার শিক্ষার্থীদের শেখানো উচিত মস্কো হলো ‘তৃতীয় রোম’। অর্থাৎ রোম ও কনস্টান্টিনোপলের পর রাশিয়াই সভ্যতার নতুন কেন্দ্র।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার দুর্বলতাকে দুগিনের পাঠ্যক্রমে খারাপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর পুতিনের ক্ষমতায় আসাকে রাশিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এখানে বলা হয়েছে, পুতিন দেশটির সার্বভৌমত্ব ও শক্তি ফিরিয়ে এনেছেন। বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে এই পাঠ্যক্রমে রাশিয়ার ‘আদর্শিক স্বাধীনতা’ অর্জনের শেষ ধাপ হিসেবে বলা হয়েছে।
দুগিন চান, রুশ শিক্ষার্থীরা মনে করুক রাশিয়ার বর্তমান শাসনব্যবস্থাই সবচেয়ে ভালো। এই ব্যবস্থায় একজন শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট জনগণের ভোটে ক্ষমতায় থাকেন।
দুগিন এটিকে ‘জনসমর্থিত গণতন্ত্র’ বলেন। তাঁর মতে, ক্ষমতা ভাগ করা বা নেতা বদলের ব্যবস্থা বিপজ্জনক, কারণ এতে অদক্ষ আমলারা ক্ষমতা দখল করেন। তিনি সমাজে শান্তি বজায় রাখা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে পবিত্র ও ঐতিহ্যবাহী বলে মনে করেন।
দুগিনের পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় দর্শনের প্রভাব বেশি। যেমন এই পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে, রাষ্ট্র হলো একধরনের ‘রক্ষাকারী শক্তি’, যা বিশ্বকে অরাজকতা থেকে বাঁচায়।
প্রাচীন রোমান সম্রাট বা রাশিয়ার জারদের মতো বর্তমান রাশিয়ার সরকারকেও এই ভূমিকায় দেখতে হবে।
দুই সভ্যতার চিরন্তন যুদ্ধদুগিন বিশ্বাস করেন, ইতিহাসজুড়ে ‘স্থলভিত্তিক’ ও ‘সমুদ্রভিত্তিক’ সভ্যতার লড়াই চলেছে।
রাশিয়া হলো স্থলভিত্তিক সভ্যতা, যার মূলনীতি স্থিতিশীলতা, রক্ষণশীলতা ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী।
পশ্চিমা দেশগুলো হলো সমুদ্রভিত্তিক সভ্যতা, যারা বাণিজ্য, নৌশক্তি ও তথ্য দিয়ে ক্ষমতা বাড়ায়।
দুগিনের ভাষায়, ইউক্রেন যুদ্ধকে এই দুই সভ্যতার লড়াইয়ের অংশ বলা হয় এবং ২০১৪ সালে ইউক্রেনে পশ্চিমা প্রভাব বাড়াকে রাশিয়ার জন্য হুমকি হিসেবে দেখানো হয়।
মার্ক্সবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করলেও দুগিনের পাঠ্যক্রমে চীন ও উত্তর কোরিয়াকে সম্মান দেওয়া হয়। চীনের রাজনীতিতে কনফুসিয়াসের শিক্ষা এবং উত্তর কোরিয়ার জুচে মতবাদকে ঐতিহ্যবাহী দর্শনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
তো, দুগিন মনে করেন, ‘টু বি অর নট টু বি’র সন্ধিক্ষণে অস্তিত্ব হারানো রাশিয়াকে অস্তিত্বশীল করতে পারেন একজন ‘জার’। সেই জার হলেন ভ্লাদিমির পুতিন।
গত বছরের ৭ অক্টোবর পুতিনকে তাঁর ৭২তম জন্মদিনে ‘ঈশ্বর জারকে রক্ষা করুন’ বলে নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন দুগিন।
টেলিগ্রামে তাঁর ৭১ হাজারের বেশি অনুসারীর উদ্দেশে দেওয়া বার্তায় দুগিন কামনা করেন, ‘দেবদূতেরা’ যেন ‘সম্রাট’ পুতিনের মাথায় ‘সোনার মুকুট’ পরিয়ে দেন। একই সঙ্গে তিনি ৭২ বছর বয়সকে পুতিনের ‘দ্বিতীয় যৌবন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
পুতিন এযাবৎকাল দুগিনের তত্ত্ব মেনে ক্রিমিয়া দখল থেকে শুরু করে ইউক্রেন অভিযানের মতো কাজ একে একে করে এসেছেন। একের পর এক দুগিনের তত্ত্ব বাস্তবায়ন করে এসেছেন।
এখন যেহেতু ‘রাসপুটিন’ দুগিন বলছেন, রাশিয়ার ‘অস্তিত্ব’ ফিরিয়ে আনার একমাত্র পন্থা যুদ্ধ করে ইউক্রেনকে সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার দখলে নিয়ে নেওয়া; সেহেতু ‘জার’ পুতিন ইউক্রেন দখলের অভিলাষ থেকে ফিরে আসবেন, তা মনে করা কঠিন।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ব জ ঞ ন র শ য় র জন য দ গ ন বলছ ন ইউক র ন র তত ত ব ব দ গ ন বল র র জন ত এই য দ ধ ন ই হয় আম র ক ন র মত বল ছ ন র স মন পর জ ত ক ষমত র একট ইউর প
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতের ঋণে দুই সড়ক, বাংলাদেশের লাভ নিয়ে প্রশ্ন
ভারতীয় ঋণে (এলওসি) আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, কসবা, ধরখার হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণ চলছে। ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ রাস্তা ভারতের ত্রিপুরার আগরতলাকে আশুগঞ্জ নৌবন্দরের সঙ্গে যুক্ত করবে। এ ছাড়া ৭ হাজার ১৮৮ কোটি টাকায় কুমিল্লার ময়নামতি থেকে ধরখার সড়কও চার লেনে উন্নীত করা হবে ভারতীয় ঋণে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করা পণ্য ত্রিপুরা ও আসামে পরিবহন সহজ হবে। ১২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকার এই দুই সড়কে ভারতের ফায়দা হলেও, বাংলাদেশের কী লাভ, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) কর্মকর্তারা বলেছেন, মহাসড়ক দুটি চার লেনে উন্নীত হলে আগরতলার বাণিজ্য বাড়বে। সিলেট ও চট্টগ্রামের যোগাযোগ সহজ হবে। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই লাভবান হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির সমকালকে বলেন, কেন এই মহাসড়ক প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছিল, বাংলাদেশের আদৌ লাভ আছে কিনা, খতিয়ে দেখা হবে। ময়নামতি-ধরখার মহাসড়ক প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে না হলে সরকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে ২০১৫ সালে নৌ-ট্রানজিট চুক্তি সই হয়। এতে আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহারের সুবিধা পায় ভারত। ২০১৬ সালের জুনে শুরু হয় পণ্য পরিবহন। কলকাতা থেকে নদীপথে আনা ভারতীয় পণ্য প্রথমে আশুগঞ্জ বন্দরে খালাস করা হয়। এর পর সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কসবা, ধরখার সড়ক হয়ে আগারতলায় নেওয়া হয়।
এ চুক্তির মাধ্যমে স্থলভূমি বেষ্টিত উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহন সুবিধা পেয়েছে ভারত। এতে কলকাতা-আগরতলার দূরত্ব কমেছে প্রায় ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার। পণ্য পরিবহন সহজ করতে ২০১৭ সালের এপ্রিলে আশুগঞ্জ থেকে সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কসবা, ধরখার হয়ে আখাউড়া পর্যন্ত ধীরগতির যান চলাচলে দু’পাশে সার্ভিস এবং চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। মোট ছয় লেনের মহাসড়কটি ৩ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকায় ২০২০ সালের জুনের মধ্যে নির্মাণ সম্পন্নের পরিকল্পনা ছিল।
পরে প্রকল্প ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্প সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। ভারত এতে ঋণ দেবে ২ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।
ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো আশুগঞ্জ-আখাউড়া মহাসড়ক নির্মাণের কাজ পায়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের জনবলও নিজ দেশে চলে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নিরাপত্তার আশ্বাসে গত অক্টোবরে তারা কাজে ফেরে। ডিসেম্বরে আবার শুরু হয়েছে কাজ। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৫৭ শতাংশ। আবার ধরখার থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত অংশে জমি অধিগ্রহণ হলেও এখনও সড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো অনেকটাই নিশ্চিত।
সওজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কুমিল্লার ময়নামতি থেকে আখউড়া বন্দরসংলগ্ন ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ধরখার পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার সড়ককে দু’পাশে সার্ভিস লেনসহ ছয় লেনে উন্নীতকরণের প্রকল্প অনুমোদন হয়। ৭ হাজার ১৮৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকার প্রকল্পটির কাজ ২০২২ সালে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের জুনে সম্পন্নের পরিকল্পনা ছিল। এখনও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।
ভারতের কী লাভ
২০১৮ সালের অক্টোবরে সই হওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তিতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছে ভারত। বন্দরে খালাস করা প্রতি টন পণ্য প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৮৫ ফি মাশুল দিয়ে আসাম ও ত্রিপুরায় পরিবহন করতে পারে দেশটি।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক পর্যন্ত পণ্য আসে কুমিল্লার ময়নামতি পর্যন্ত। সেখান থেকে বিদ্যমান ১৮ ফুট প্রশস্ত কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক দিয়ে ধরখার হয়ে আগরতলায় যায় ত্রিপুরাগামী পণ্যবাহী গাড়ি। আসামগামী পণ্যবাহী গাড়ি ধরখার থেকে আখাউড়া-আশুগঞ্জ সড়ক হয়ে সরাইল দিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যেতে পারে। নির্মাণাধীন আশুগঞ্জ-আখাউড়া মহাসড়কের আশুগঞ্জ সরাইল অংশ, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেরও অংশ। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে শেওলাবন্দর, তামাবিল বন্দর হয়ে আসামে যায়।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দুই পাশে সার্ভিস লেনসহ চার লেনের মহাসড়কে উন্নীত করা হচ্ছে। সিলেট থেকে তামাবিল পর্যন্ত ৫৬ কিলোমিটার মহাসড়ক ৩ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকায় দুই পাশে সার্ভিস লেনসহ চার লেনের মহাসড়কে উন্নীত করা হচ্ছে। এতে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ২ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে।
ময়নামতি-ধরখার সড়ক নির্মাণ হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতীয় পণ্য সহজেই চার লেনের মহাসড়ক ব্যবহার করে আখাউড়া এবং তামাবিল হয়ে দ্রুত ও সহজে ত্রিপুরা, আসাম যেতে পারবে। দক্ষিণ এশীয় উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা (সাসেক) কর্মসূচির অংশ হিসেবে আশুগঞ্জ-আখাউড়া এবং ময়নামতি-ধরখার সড়কের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা করা হয়েছিল রোড সেক্টর রিফর্ম প্রজেক্টের আওতায় (আরএসআরপি)। এর সারাংশে বলা হয়েছে, আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়ক নির্মিত হলে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ বাড়বে। ময়নামতি-ধরখার সড়ক সিলেটের সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রামের যোগাযোগ সহজ করবে। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে প্রকল্প দুটি।
বাংলাদেশে অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার সঙ্গে মেলে না। প্রকল্প অনুমোদন করাতে লাভজনক দেখানো হয় জানিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেন, খালি চোখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের লাভ। তবে সামগ্রিকভাবে দেখলে ভারতীয় ঋণে প্রকল্প দুটিতে বাংলাদেশের চেয়ে অর্থায়নকারী দেশেরই লাভ। তারা তো শুধু একবার ঋণ দেবে সড়ক নির্মাণে। পরে এই সড়কের রক্ষণাবেক্ষণে খরচ বাংলাদেশকেই দিতে হবে। ভারতীয় পণ্য পরিবহন করে সেই খরচ উঠবে কিনা, দেখতে হবে। সিলেটের সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রামের যোগাযোগ বাড়াতে ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় লাভজনক হবে কিনা, তাও দেখতে হবে। যদিও প্রকল্পগুলো যে পর্যায়ে আছে, তাতে নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন হবে না। ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকাও ছাড়াতে পারে।
হাদীউজ্জামান বলেন, আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিল সহজ নয়। আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কের কাজ অর্ধেকের বেশি সম্পন্ন হয়ে যাওয়ায় এখান থেকে ফিরে আসার পথ নেই। ময়নামতি-ধরখার সড়কের কাজ শুরুর আগে ভাবতে হবে, বাংলাদেশের কতটা লাভ হবে। শুধু ভারতের স্বার্থেই রক্ষিত হচ্ছে কিনা, খতিয়ে দেখতে হবে।
বাংলাদেশের কী লাভ
২০১১ সালে আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে ত্রিপুরার পালাটানায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালপত্র পরিবহন করে ভারত। পরে কয়েক দফায় খাদ্যশস্য, ইস্পাত, পাথর পরিবহন করে তারা। ২০১৬ সালের ১৫ জুন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর পরের চার বছরে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সব মিলিয়ে মাশুল পায় ৩৫ লাখ টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে আখাউড়ার এই স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হয় ৭ কোটি ৫ হাজার টাকার পণ্য। রপ্তানি হয় ৪২৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকার পণ্য। কোনো অর্থবছরেই মোট আমদানি-রপ্তানি ৫০০ কোটি টাকার বেশি ছিল না। এই বন্দরকে যুক্ত করতে ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকার মহাসড়ক বাংলাদেশের জন্য কতটা লাভজনক হবে– এ প্রশ্ন শুরু থেকেই ছিল। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা সমকালকে বলেন, এগুলো খতিয়ে দেখা হবে।
আশুগঞ্জ-সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া মহাসড়ক নির্মাণ শেষে সিলেট থেকে কুমিল্লা, চট্টগ্রামগামী গাড়ি ধরখার পর্যন্ত চার লেনের সড়কে আসবে। পরে বিদ্যমান সরু ৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ দুই লেনের সড়কে ময়নামতি পর্যন্ত এসে চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে বন্দরে যেতে পারে। পুরো পথ চার লেনের সুবিধা পেতে হলে আশুগঞ্জ থেকে নরসিংদী ঘুরে দাউদকান্দী হয়ে চট্টগ্রাম যেতে হয়। এতে ৬০ কিলোমিটার পথ বেশি ঘুরতে হয়।
ময়মনামতি-ধরখার সড়ক প্রকল্পের পরিচালকের পদ শূন্য থাকায় অরিক্তি পরিচালক শামীম আল মামুন দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, দুই লেনের সরু রাস্তায় হওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা অংশে ব্যাপক যানজট হয়। চার লেনের সড়ক হলে সিলেট থেকে কুমিল্লা, চট্টগ্রামের যোগাযোগ সহজ হবে।
৭ হাজার ১৮৮ কোটি টাকার ময়মনামতি-ধরখার সড়ক প্রকল্পে ভারত ২ হাজার ৮১০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণ দেবে। বাকি ৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১৩৩ কোটি টাকা, যা ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পর সবচেয়ে ব্যয়বহুল। সিলেট অঞ্চলের সঙ্গে কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামের যোগাযোগ বাড়াতে এত ব্যয়বহুল সড়ক বাংলাদেশের জন্য লাভজনক নাকি শুধু ভারতের লাভ হবে– এসব প্রশ্নে শামীম আলম মামুন বলেন, দুই দেশের জন্যই ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ তৈরি হবে। দু’পক্ষেরই লাভ হবে।
ময়নামতি-ধরখার সড়কের নির্মাণকাজ এখনও শুরুই হয়নি। ভারতীয় ঋণের সুরাহা না হওয়ায় দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ঠিকাদার নিয়োগ করা যাচ্ছে না। এ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ ও পুনবার্সনে খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮৪২ কোটি ২২ লাখ টাকা। স্টেশনারি, সিল ও স্ট্যাম্পের জন্য ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা, প্রকল্পের জন্য ৬৮০ বর্গমিটার অফিস তৈরিতে ২ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার, আসবাব, কম্পিউটারে পৌনে ২ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে।
কাজ এগোচ্ছে না, সেচ বন্ধে কৃষকের সর্বনাশ
ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ফেরায় ডিসেম্বর থেকে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কের কাজ এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক আবদুল আউয়াল মোল্লা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে লাভজনক হবে কিনা? বিনিয়োগ উঠে আসবে কিনা– এসব প্রশ্নে তিনি ২৯ জানুয়ারি সমকালকে বলেছিলেন, ‘সব প্রশ্নের জবাব সমীক্ষায় রয়েছে। সমীক্ষা করেই প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। আমি বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ, আমাকে যেভাবে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে, সেভাবে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন ঠান্ডা রাখতে মেঘনা নদী থেকে তোলা পানিতে আশপাশের ৫০ হাজার একর জমিতে সেচ দেওয়া হতো। ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ‘আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্প’ নামে সেচ কার্যক্রম শুরু করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহৃত পানিতে সেচ সুবিধা চালু করায় তা সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী ছিল।
২০২০ সালে আশুগঞ্জ নৌবন্দর-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ক চার লেন উন্নয়নে, সড়কের পাশে ১১ কিলোমিটার সেচ খাল ভরাট করা হয়। কোথাও ৪০ ফুট প্রশস্ত খাল, এখন ৪-৫ ফুট টিকে রয়েছে। এতে সেচ ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভারতের সুবিধায় নির্মাণ করা সড়কের কারণে কৃষকের সর্বনাশ করা হয়েছে।
গত ২৪ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে সভায় বিএডিসি জানায়, সেচ খাল নির্মাণে সওজের সঙ্গে ভূমি মালিকানা চুক্তি হয়েছে। প্রস্তাবিত সেচ প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন কুমিল্লা প্রতিনিধি মো. কামাল উদ্দিন)