এবারের রোজায় শাকসবজির দাম কম কেন
Published: 10th, March 2025 GMT
চলতি বছর পবিত্র রমজান মাসে অধিকাংশ প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে সবজির বাজার যেন স্বস্তি দিয়েছে ভোক্তাদের। অর্থাৎ রমজান এলেই বাজারে মূল্যবৃদ্ধির যে প্রবণতা তৈরি হয়, এবার তা আগের মতো দেখা যায়নি।
ব্যতিক্রম শুধু লেবু, শসা, বেগুন ও সয়াবিন তেল। রোজার শুরুতে এসব পণ্যের দাম কিছুটা বেড়ে গেলেও কয়েক দিনের ব্যবধানে তা কমে এসেছে।
কৃষক, ব্যবসায়ী, পাইকার ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর শীত মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই রোজা শুরু হয়েছে। ফলে বাজারে পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, শসা প্রভৃতি সবজির সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। এ কারণে দাম বাড়েনি। আবার মুরগি ও গরুর মাংস বা ডিমের দামও কম রয়েছে। অন্যদিকে, চিনি, খেজুরসহ কিছু আমদানি পণ্যে সরকার শুল্ক ছাড়ের সুবিধা দেওয়ায় এসব পণ্যের দামও স্থিতিশীল বা কমতির দিকে ছিল।
দামের পার্থক্য কতটা
গত বছর রোজা শুরু হয়েছিল ১২ মার্চ, তবে রোজার মাসটা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য অতটা স্বস্তির ছিল না। ওই সময় কোনো কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল। যেমন পেঁয়াজ। গত রমজানে একপর্যায়ে পেঁয়াজের দাম উঠেছিল কেজিপ্রতি ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। পরে অবশ্য সেটি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় নেমে আসে। অথচ এ বছর ৩০ থেকে ৪০ টাকায় পেঁয়াজ কেনা যাচ্ছে।
ইফতারের সময় বেগুনির চাহিদা অনেক বেশি থাকে। বাড়তি এ চাহিদার সুযোগে ব্যবসায়ীরা গত বছর বেগুনের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। গত বছর রোজায় বেগুনের দাম এক শ টাকা ছাড়িয়ে যায়। রোজার শেষের দিকে অবশ্য তা কমে আসে। শসার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। প্রতি কেজি শসার দাম ওঠে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। এ ছাড়া টমেটো ৬০ থেকে ৮০ টাকা ও লেবুর হালি ৫০ থেকে ৬০ টাকা ও কাঁচামরিচ ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। আর আলুর কেজি ছিল ৪০ টাকার আশপাশে। সে তুলনায় এ বছর এসব পণ্যের দাম বেশ কম।
চলতি বছর বাজারে সবজির পণ্যের দাম অনেকটাই সহনীয়। যেমন চলতি রমজানের শুরু থেকেই প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটি ২০২৩ সালের দামের প্রায় সমান। এ ছাড়া প্রতি কেজি আলু ২৫ থেকে ৩০ টাকা, কাঁচামরিচ ৬০ থেকে ৮০ টাকা আর টমেটো ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে মৌসুম না হওয়ায় রোজার শুরুতে লেবুর দাম সাধারণ মানুষকে ভুগিয়েছে। এভাবে শসা ও বেগুনের দামও কেজিতে ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছিল, পরে অবশ্য সে দাম কমেছে।
কেন দাম কম
কৃষক, ব্যবসায়ী, পাইকার ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে বেগুন, শসা, আলু ও পেঁয়াজের ভরা মৌসুম চলছে। এমন সময় রোজা চলে এসেছে। রোজার সময় এসব পণ্যের বাড়তি চাহিদা থাকে। কিন্তু এবার সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় বাড়তি চাহিদা দাম বাড়াতে পারেনি।
অবশ্য যেসব পণ্যের সরবরাহ কম, সেগুলোর দামে বাড়তি প্রবণতা দেখা যায়। যেমন লেবু ও করলা। রোজার আগে বাজারে এক হালি লেবু ২০ থেকে ৪০ টাকায় কেনা যেত। বর্তমানে লেবুর দাম ৪০ থেকে ৮০ টাকা। ভালো মানের লেবুর দাম ১০০ টাকার ওপরও আছে। কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা জাকির হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে লেবু কম বিক্রি করছি। কারণ, লেবু বিক্রিতে লাভ কম, ঝামেলা বেশি।’
দেশে সবজি পণ্যের অন্যতম পাইকারি স্থান বা মোকাম হচ্ছে বগুড়া। এই জেলার রাজাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর আলু, পেঁয়াজ ও বেগুনের মতো পণ্যের দাম সহনীয় রয়েছে। এর কৃতিত্ব ব্যবসায়ী বা প্রশাসন কারও না, বরং কৃষকের। এ বছর কৃষকেরা পর্যাপ্ত উৎপাদন করেছেন। এ জন্য বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে, ফলে দামও কম।
বগুড়ার আরেক মোকাম মহাস্থান বাজারের আড়তদার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অন্যান্য বছর এ সময় অর্থাৎ রোজা আসার আগে বাজার থেকে শসা উধাও হয়ে যেত। কাঁচামরিচ ও বেগুনের একই অবস্থা হতো, এবার সেটি হয়নি। পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় কেউ মজুত করারও সাহস করছেন না। মোস্তাফিজুর রহমান আরও জানান, ২০২৬ সালের রোজা শীত মৌসুমের দিকে আরও এগিয়ে আসবে। ফলে আগামী বছরও এসব পণ্যের দাম অনেক কম থাকবে।
চিন্তায় কৃষকেরা
এদিকে দাম কম থাকায় সাধারণ ভোক্তারা স্বস্তিতে থাকলেও চিন্তায় রয়েছেন কৃষকেরা। তাঁদের কথা—এ বছর তাঁরা বেশি লাভ পাবেন না; কেউ কেউ লোকসান করতে পারেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জের গণেশপুর গ্রামের কৃষক জিল্লুর রহমান এ বছর বেগুন চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘গত বছর এমন সময়ে খেত থেকে প্রতি মণ বেগুন ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি করেছিলাম। এ বছর প্রথমে ১ হাজার ৪০০ টাকায় বেগুন বিক্রি করি। পরে দাম আরও কমে যায়। দুই দিন ধরে প্রতি মণ বেগুন ১ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করছি।’
জিল্লুর রহমান বলেন, রোজার বিক্রি ধরতে সবাই (কৃষক) একসঙ্গে খেত থেকে বেগুন তুলেছেন। এতে দাম পড়ে গেছে। এখন পর্যন্ত লস (লোকসান) হয়নি, লাভও হয়নি। তবে অন্যান্য বছর রোজার সময় বেগুনের যে ভালো দাম পাওয়া যেত, এবার সেটি হয়নি।
‘পানির দরে’ পেঁয়াজ
পেঁয়াজের চাষিরা জানিয়েছেন আরও হতাশার কথা। গত বছরগুলোতে রমজান মাসে চড়া দামে পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেলেও এবার বিক্রি হচ্ছে একেবারেই কম দামে। কৃষকেরা এই দামকে ‘পানির দর’ বলছেন।
দেশে পেঁয়াজের অন্যতম উৎপাদনস্থল পাবনা। এই জেলার কৃষকেরা এ বছর প্রতি কেজি মুড়িকাটা পেঁয়াজ পাইকারিতে ২২ থেকে ২৭ টাকা ও প্রতি কেজি হালি পেঁয়াজ ২৭ থেকে ৩২ টাকায় বিক্রি করছেন। অথচ সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এবার প্রতি কেজি মুড়িকাটা পেঁয়াজের উৎপাদনে ৪১ থেকে ৪২ টাকা ও হালি পেঁয়াজের উৎপাদনে ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ কৃষকের পেঁয়াজ এখন লোকসানে বিক্রি হচ্ছে।
গত বছর রমজানে পেঁয়াজের দাম উঠেছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। পরে দাম কমলেও সেটি ৬০ থেকে ৭০ টাকার ওপর ছিল। পাবনার পেঁয়াজের ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছর পেঁয়াজের বাজার চড়া ছিল। কৃষকেরাও ভালো লাভ করেছেন। তাই ভালো লাভের আশায় এ বছর কৃষকেরা আরও বেশি জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন। গত কয়েক দিনে সাঁথিয়া উপজেলায় কৃষকের ঘরে প্রচুর মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠেছে। পাশাপাশি নতুন হালি পেঁয়াজও বাজারে উঠতে শুরু করেছে। ফলে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দাম অনেক কম।
সাঁথিয়ার বোয়ালমারী হাটের পেঁয়াজের আড়তদার রাজা হোসেন বলেন, ‘এবার আমাগরে এলাকায় পেঁয়াজের আবাদ ম্যালা বেশি হইছে। সেই পেঁয়াজ একসঙ্গে বাজারে আসতে শুরু করিছে। তাই পেঁয়াজের দামে এমন ধস। কৃষক হাটে পেঁয়াজ বেচবার আইস্যা কাইন্দা বাড়ি ফিরতেছে।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন—আনোয়ার পারভেজ, নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া এবং বরুন রায়, প্রতিনিধি, বেড়া, পাবনা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরবর হ স ব ভ ব ক ১২০ ট ক য় র সরবর হ দ ম অন ক ব যবস য় র রহম ন গত বছর আড়তদ র ন বল ন কর ছ ন দ ম কম ৪০ ট ক ৬০ থ ক অবশ য বছর প সবজ র বছর র এ বছর রমজ ন
এছাড়াও পড়ুন:
রাবিতে ছড়িয়ে পড়েছে ছোঁয়াচে রোগ ‘স্ক্যাবিস’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) আবাসিক হল ও মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে চর্মরোগ ‘স্ক্যাবিস’। ছোঁয়াচে এ রোগে আক্রান্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাশিহুল আলম হোসাইন।
রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি জরুরি চিকিৎসা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে মেডিকেল সেন্টারে সঠিক চিকিৎসাসেবা এবং ওষুধ পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
আরো পড়ুন:
রাবির ভর্তি পরীক্ষা: একটি ইউনিটেই ৭৫০ ওএমআর বাতিল
৫ বিভাগীয় কেন্দ্রে রাবির সি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত
সরেজমিনে দেখা গেছে, সোমবার (২৮ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে সকাল থেকেই আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের ভিড় জমেছে। কেউ সিরিয়ালে ডাক্তার দেখানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, কেউবা ওষুধ পেতে অপেক্ষা করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, “কয়েকদিন ধরেই শরীরে ব্যাপক চুলকাচ্ছে, লাল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের রুমেও কয়েকজনের একই সমস্যা।”
আরেক শিক্ষার্থী জানান, “আমার হাতের আঙুলে, পেটে এবং শরীরের কিছু স্পর্শকাতর জায়গায় চুলকানোর ফলে ফুলে গেছে। এখন ডাক্তার দেখালাম। অনেকদিন পর ভালো চিকিৎসাসেবা পেলাম। একটি ছাড়া সবগুলো ওষুধই পেয়েছি।”
এ বিষয়ে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাশিহুল আলম হোসাইন বলেন, “শত শত চর্মরোগের মধ্যে সবচেয়ে ছোঁয়াচে রোগটির নাম স্ক্যাবিস। গত কয়েকদিন ধরেই একের পর এক এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা এসে হাজির হচ্ছেন। বিভিন্ন হল, মেসে বসবাসরত ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই ছোঁয়াচে রোগ।”
রোগটির বর্ণনা দিতে গিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “আঙুলের ফাঁকে, কব্জির সামনে, বগলে, নাভিতে ছোট ছোট ফুসকুড়ি নিয়ে শুরু হয়ে যায় এই রোগ। বিশেষ করে রাতের বেলায় চুলকানির মাত্রা বেড়ে যায়। ক্লোজ কন্টাক্টে যারা থাকেন, তাদের মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে যাওয়ার মাত্রা অনেক বেশি।”
মেডিকেল সেন্টারে রোগটির ওষুধ থাকার বিষয়ে ডা. মাশিহুল আলম বলেন, “অবাক করা বিষয় হলো, মেডিকেল সেন্টারে স্ক্যাবিস রোগের ওষুধ ছিল না। পরে প্রধান চিকিৎসক ডা. মাফরুহা সিদ্দিকা লীপিকে বিষয়টি জানালে তিনি জরুরিভিত্তিতে ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এখন থেকে রাবি চিকিৎসা কেন্দ্রেই স্ক্যাবিসের চিকিৎসাসহ সব ওষুধ পাবেন। এজন্য প্রধান চিকিৎসককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. মাফরুহা সিদ্দিকা লিপি বলেন, “হলে বা মেসে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগজনক হারে এ ছোঁয়াচে রোগ বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের উচিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সচেতন থাকা। এছাড়া একে অন্যের পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার না করা।”
শিক্ষার্থীরা ঠিকঠাক সেবা পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে এই প্রধান চিকিৎসক জানান, “আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি সবাইকে সঠিক চিকিৎসা এবং ওষুধ সরবরাহ করতে। যদিও আমাদের কিছু ঘাটতি রয়েছে, আমরা প্রশাসনের কাছে জানিয়েছি। কিছু ওষুধ পেয়েছি, আরও দরকার।”
ঢাকা/ফাহিম/মেহেদী