আমেরিকার মোড়লগিরির ট্রাম্প আরও খোলামেলা করে দিলেন
Published: 7th, March 2025 GMT
ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটা দিকের জন্য আমরা তাঁকে ধন্যবাদ দিতে পারি। তিনি একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে আমেরিকা কখনোই ‘নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’ টিকিয়ে রাখার উপযুক্ত পুলিশ ছিল না।
আমেরিকাকে বরং এক গ্যাংস্টার সাম্রাজ্যের প্রধান বলাই ভালো। সারা বিশ্বে তাদের আট শতাধিক সামরিক ঘাঁটি আছে। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে তারা ‘বিশ্বের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ চায়।
আপনি যদি আমেরিকাকে মেনে চলেন, তাহলে ঠিক আছে। আর যদি তা না করেন, তাহলে আপনাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। গত শুক্রবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাঁকে প্রকাশ্যে অপমান করা হয়েছে হোয়াইট হাউসে। সাংবাদিকদের সামনেই।
অনেকে ভাবছেন, এটা তো খুব খারাপ হলো। কিন্তু এর চেয়েও খারাপ তো হয়ে গেছে আগেই। আর তা হলো ইউক্রেন ও রাশিয়ার লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু। এই যুদ্ধ একদমই দরকার ছিল না। আমেরিকাই এই যুদ্ধ তৈরি করেছে গত বিশ বছর ধরে ন্যাটোর মাধ্যমে। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল একটাই—বিশ্বকে দেখানো, আমেরিকাই বস। ঠিক যেমন তারা ইরাকে করেছিল।
হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, কিন্তু আমেরিকার বন্ধু হওয়া আরও ভয়ংকর।
জেলেনস্কি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। গ্যাংস্টারদের সাম্রাজ্য এমনই হয়। আপনাকে তারা কাজ করাবে। এরপর যখন দরকার ফুরাবে, ছুড়ে ফেলে দেবে। ঠিক যেমন হলিউড সিনেমায় দেখা যায়।
জো বাইডেনের আমলে জেলেনস্কিকে আমেরিকা কাজে লাগিয়েছে। রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে আমেরিকার একটা কাজের লোক দরকার ছিল। এখন তার পরিণতি কী হলো, সবাই দেখছে।
ন্যাটো বারবার ইউক্রেনকে নিজেদের আওতায় নেওয়ার চেষ্টা করেছে। রাশিয়া বারবার সতর্ক করেছে যে এটি তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। রাশিয়া কখনোই চাইবে না আমেরিকা তার সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র বসাক। ঠিক যেমন ১৯৬০-এর দশকে কিউবার সীমান্তে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র বসানোকে আমেরিকা একেবারে বরদাশত করেনি।
ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি হলে আমেরিকা রাশিয়াকে নিজের পক্ষে এনে নতুন এক নিরাপত্তা–কাঠামো তৈরি করবে, যা চীনের একক প্রভাবকে আরও দুর্বল করে দেবে।এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের জনগণ নিজেদের শান্তির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করেছিল ভলোদিমির জেলেনস্কিকে। তাঁর মূল প্রতিশ্রুতি ছিল দেশে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করা। এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। পশ্চিম ইউক্রেনের রাশিয়াবিরোধী ‘জাতীয়তাবাদী’ গোষ্ঠী এবং পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষী জনগণের মধ্যে বিরোধের মধ্য দিয়ে এর সৃষ্টি। কিন্তু শিগগিরই জেলেনস্কি তাঁর সেই শান্তির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প জেলেনস্কিকে ‘একজন স্বৈরশাসক’ বলেছিলেন। এ অভিযোগ কিছুটা সত্য হতেও পারে। কারণ, আমেরিকা চেয়েছিল, জেলেনস্কি সেই ধরনের নেতা হোক যে তাদের প্রয়োজনে কাজ করবে। যদিও অনেক ইউক্রেনীয় চেয়েছিল অন্য কিছু।
এখন বাইডেন চলে গেছেন। নতুন প্রশাসন এসেছে। নতুন মাফিয়া ‘ডন’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে জেলেনস্কি দিয়ে কাজ হচ্ছে না। কিন্তু এর পেছনে খরচ হচ্ছে অনেক বেশি। ওদিকে রাশিয়া কোনোভাবে দুর্বল হয়নি। বরং শক্তিশালী হয়েছে। এখন নতুন কৌশল দরকার।
জেলেনস্কি মনে করছিলেন যে তিনি আমেরিকার প্রিয় ‘গুন্ডা’। আর তখনই তিনি হোয়াইট হাউসে গিয়ে এক কঠিন পাঠ শিখলেন—মাফিয়া শিষ্টাচারের শিক্ষা। জানলেন যে তিনি ঠিকমতো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন না।
ট্রাম্প এখন ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। শান্তি আসুক আর না সুক, আসল কথা হলো এই চুক্তির পেছনে আছে মূলত অর্থনৈতিক লাভের হিসাব। ট্রাম্পের মতে, রাশিয়া এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। অবশ্য পশ্চিম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চাইলে অন্য কথা। বাস্তবে, এই যুদ্ধের পেছনে যে শক্তি কাজ করছে, তা হলো টাকা।
এখন ট্রাম্পের চাপে একটা শান্তিচুক্তি হয়তো হবে। সেই চুক্তির ভিত্তি হবে ইউক্রেনের সম্পদ—বিরল খনিজ, কৃষিজমি এবং অন্যান্য খাত। আর এই সবই ব্যবহৃত হবে একটি শক্তিশালী দেশের প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য। জেলেনস্কি এখন এটা বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন যে তিনি এবং ইউক্রেনের জনগণ এক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মাফিয়া সংগঠনের সঙ্গে হাত মেলালে এ রকমই হয়।
ট্রাম্পের পূর্বসূরিরা যেখানে ইউক্রেন এবং গাজা সমস্যা সমাধানকে বিশ্বশান্তি বা এরকম সব গালভরা নামে ডাকত। ট্রাম্প সেখানে সরাসরি বলেছিলেন যে এই অঞ্চলগুলো শুধু আমেরিকার ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। তিনি কোনো রকম আড়াল না রেখেই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে ইউক্রেন এবং গাজা তার দেশের বৈশ্বিক স্বার্থের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ।
হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির সঙ্গে কথোপকথনে ট্রাম্প একথা আবার বলেছেন, ‘আমরা ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ ব্যবহার করব। এসব ব্যবহৃত হবে আমাদের বিভিন্ন কাজে, যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অস্ত্র ব্যবস্থাপনা ও সামরিক ক্ষেত্রে। এগুলো আমাদের দরকার।’
এই বক্তব্যে ট্রাম্পের লক্ষ্য পরিষ্কার—যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ শেষ করা এবং রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি ঠেকানো। রাশিয়া ইউক্রেনের যত বেশি অঞ্চল দখল করবে, আমেরিকার ভাগে তত কম জায়গা থাকবে খনিজ সম্পদ লুট করার জন্য। এ জন্যই ট্রাম্প যুদ্ধ শেষ করতে এমন মরিয়া।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ন্যাটোর এই যুদ্ধ একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে খনিজ সম্পদ নিয়ে লড়াইয়ের গভীর কৌশলের অংশ। গত বছর মার্কিন কংগ্রেসের একটি কমিটিতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য ‘সামরিক খনিজের প্রাধান্য’ নিয়ে আলোচনা করেছিল। আমেরিকার মূল লক্ষ্য ছিল চীনের প্রভাব রুখে দেওয়া এবং ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়াকে আরও একবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা।
এখানে ট্রাম্পের লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেনের ভূখণ্ড কাজে লাগিয়ে পশ্চিমে একটি নতুন নিরাপত্তা–কাঠামো তৈরি করা। তা করে রাশিয়াকে আমেরিকার পক্ষে আনা যাবে। আবার চীনের একচেটিয়া প্রভাবকেও চাপের মধ্যে ফেলা যাবে। রাশিয়া ও চীন একত্র হয়ে নতুন এক শক্তিশালী জোট তৈরি করেছে। এই জোটের নাম ব্রিকস। এতে আছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
ব্রিকস আমেরিকার বৈশ্বিক আধিপত্যের বিপরীতে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়তে চাচ্ছে। ইউক্রেনে শান্তিচুক্তি হলে আমেরিকা রাশিয়াকে নিজের পক্ষে এনে নতুন এক নিরাপত্তা–কাঠামো তৈরি করবে, যা চীনের একক প্রভাবকে আরও দুর্বল করে দেবে।
ট্রাম্পের আচরণ অশালীন হতে পারে। কিন্তু তিনি যে সাম্রাজ্য পরিচালনা করছেন, তা আগেও দুনিয়াজুড়ে ক্ষমতার লড়াই চালিয়েছে। ট্রাম্পও সেই কাজ করছেন। তবে আরও খোলামেলাভাবে।
জোনাথন কুক লেখক, সাংবাদিক
মিডিল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র এই য দ ধ আম র ক র র জন য ক জ কর দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
জনআকাঙ্ক্ষার সংস্কার উদ্যোগ, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার দেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের সিংহভাগ মানুষ সংস্কারের পক্ষে। দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেশের পুলিশ, প্রশাসন, আইন, বিচার, আর্থিক খাত, নির্বাচন, গণমাধ্যম প্রভৃতি ক্ষেত্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এগুলোর ওপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেই কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে সব রাজনৈতিক দল ও সমাজের নানা পেশার মানুষের মতামত নিয়ে একটি জুলাই-আগস্ট চার্টার্ড তৈরি করা; পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সরকার এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করবে এবং মেনে চলবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে কখনও প্রকাশ্যে আবার কখনও অপ্রকাশ্যে এবং নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চলমান সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। যেমন সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটি করার অধিকার শুধু রাজনৈতিক সরকারের। সুতরাং আগে নির্বাচন দিতে হবে। কোনো কোনো মহল বলছে, যারা সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তারা দেশের নাগরিক নন। ফলে তাদের প্রস্তাবকৃত সংস্কার মানা হবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। দেশের জনগণ তা মানবে না, দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। আজ এই লেখায় মূলত আলোচনা করতে চেষ্টা করব রাষ্ট্র সংস্কারের সুফলভোগী মূলত কে বা কারা। একই সঙ্গে দেখতে চেষ্টা করব চলমান সংস্কার কার্যক্রমের প্রধান প্রধান অংশীজন কারা এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় কী কী?
প্রথম কথা হলো, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম এবং প্রধান সুবিধাভোগী এ দেশের সাধারণ জনগণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই সাধারণ জনগণ? সেই জন সাধারণ জনগণ, যারা ক্ষেত-খামারে, অফিসে, শিল্পকারখানায়, জলে ও স্থলে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কোনো রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনীর কাজ করেন না। তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অতিরিক্ত এবং ব্যক্তিগত কোনো সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশা করেন না। তারা যা প্রত্যাশা করেন তা হলো, তাদের উৎপাদিত ফসল ও শ্রমের ন্যায্য মূল্য, মানুষ হিসেবে যথাযথ সম্মান, নিজস্ব মতামত ও ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার, নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, সন্তানের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা।
অন্য যেসব অংশীজন রয়েছে, তার মধ্যে আছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি, পরিবহন সমিতি, সংঘ, ক্লাব, পেশাজীবী সংগঠন ইত্যাদি। এদের আবার নিজস্ব সুযোগ-সুবিধার আলোকে রাষ্ট্রকে দেখার এবং ব্যবহারের নজির রয়েছে। মূলত রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম বাধাগুলো এখান থেকেই আসছে। প্রথমেই আলোচনা করা যাক, রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিতে তারা কতটুকু রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে? প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব দর্শন ও কর্মপরিকল্পনা থাকে। দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আগে মুখে মুখে জনগণের কথা বললেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হয়ে ওঠেন একেকজন একেকটি এলাকার প্রধান। তাঁর কথাই আইন। তিনি যা বলবেন এলাকার লোক তা মানতে বাধ্য। না মানলে নানা মাত্রায় হামলা, মামলা ও জেল-জুলুম নেমে আসে। অন্তত স্বাধীনতা পরবর্তী বছরগুলো থেকে সর্বশেষ জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আগের অভিজ্ঞতার আলোকে এটা নিশ্চিত করে বলাই যায়। মূলত ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের আচরণ জনমতের বিরুদ্ধে যেতে থাকে। অন্যদিকে দলগুলোর ভেতরে আর গণতান্ত্রিক চর্চা না হওয়াও একটি কারণ।
অন্য যেসব অংশীজন রয়েছে যেমন– বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি বা সংঘ, তারাও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যবসায়ী স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারি দলের লেবাসে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দলগুলোও তাদের সহযোগিতা করে। কারণ এরাই দলের ফান্ডে যত চাঁদা তার সিংহভাগ সরবরাহ করেন। ফলে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জনগণের পকেট কেটে তা দেশে-বিদেশে পাচার করে আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। রাষ্ট্র সংস্কারের ফলে যদি কেউ বর্তমানে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন সেগুলো কমে যায় বা প্রশ্নের মুখে পড়ে তাহলে সেই সংস্কারের পক্ষে কেন তিনি দাঁড়াবেন! সুতরাং বাধা এখান থেকেও আসছে– হোক তা প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে।
আরও একটি অংশীজন হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা তো রাষ্ট্রের কর্মচারী। তারা কেন রাষ্ট্র সংস্কারের বিরোধী হবেন? হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী ও জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা হয় এবং তাদের প্রধান কাজ জনগণকে সেবা দেওয়া– কথাটা তাদের মাথায় নেই। তারা জনগণের সেবক না হয়ে ইতোমধ্যে জনগণের কর্তারূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তাই যেখানে রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী হয়ে এ দেশের প্রত্যেক মানুষকে স্যার বলার কথা, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো; জনগণকেই তারই টাকায় যাঁর বেতন-ভাতা হয়, তাঁকে স্যার বলতে বাধ্য হতে হয়। রাজনীতিতে যেমন জবাবদিহির অভাব ঘটেছে, তেমনি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রও অনেকটা জবাবদিহির বাইরে চলে গেছে। ফলে সমাজে দুর্নীতি বেড়েছে। ভন্ড রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ীদের মতো দেশের অর্থ পাচার করে সরকারি কর্মচারীদেরও বিদেশের বেগমপল্লিতে বাড়ি-গাড়ির তথ্য বেরিয়ে আসছে।
এখন রাষ্ট্র সংস্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশ থেকে দুর্নীতি কমানো ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সত্যি সত্যিই যদি রাষ্ট্র সেদিকে অগ্রসর হয়, তাহলে যারা এতদিন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসছেন, তাদের সেই সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে এবং জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে। কে চায় তাঁর সোনার সংসারে এমন আগুনের তাপ এসে লাগুক! সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারা এসব সংস্কার উদ্যোগে সহযোগিতা করবেন না, এটা পরিষ্কার। ইতোমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সেই আলামত দেখাও গিয়েছে। পুলিশ কাজ করছে না ঠিকমতো, প্রশাসনে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সরাকারি নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। মোট প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, তা প্রশ্নের মুখে পড়বে চলমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে। তাই এই সংস্কারে তাদের সহযোগিতা খুব যে পাওয়া যাবে তা আশা করা যায় না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিভিন্ন সমিতি, সংঘ, পেশাজীবী সংগঠন সবাই সংগঠিত এবং অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আরামের সাম্রাজ্যে বসবাস করছে। তারা কোনো কালে জনগণের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে বিশেষ কিছু করেছেন এমন নজির খুব কম। এমন পরিস্থিতিতে দেশের চলমান সংস্কার উদ্যোগে তারা পরিপূর্ণ সহযোগিতা করবেন এমনটা আশা করা ভুল। সুতরাং এ জাতির সামনে কি কোনো মুক্তির পথ নেই? কেউ কি নেই, যে এ জাতির মুক্তির ত্রাতা হয়ে উঠতে পারেন। হয়তো আছেন অথবা নেই। এর জন্য একটি শক্তিশালী জনগণকেন্দ্রিক রাজনৈতিক শক্তিই পারে এ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির পথ খুলে দিতে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা দল কোথায়? আপাতত অপেক্ষা ছাড়া ভাগ্যহত এ জাতির সামনে দ্বিতীয় বিকল্প কি দেখা যাচ্ছে?
মো. সাইফুজ্জামান: শিক্ষাবিষয়ক উন্নয়নকর্মী
shakdip@gmail.com