১৯৪১ সালের আগস্টে পার্ল হারবারে জাপানের হামলার প্রায় চার মাস আগে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও উইনস্টন চার্চিল নিউফাউন্ডল্যান্ডের প্লাসেনশিয়া উপসাগরে যুদ্ধজাহাজে বৈঠক করেন। সেখানে তাঁরা আটলান্টিক চার্টারে সম্মত হন—একটি যুগান্তকারী ঘোষণা, যেখানে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যুদ্ধপরবর্তী পৃথিবীর জন্য ‘সাধারণ নীতিমালা’ নির্ধারণ করেছিল।
চার্টারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মূলনীতি ছিল, কোনো রাষ্ট্র অন্যের ভূখণ্ড দখল করবে না, যারা স্বাধীনতা হারিয়েছে, তাদের সার্বভৌম অধিকার ও স্বশাসন ফিরিয়ে দেওয়া হবে, মানুষ ভয় ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবে, সমুদ্রপথ থাকবে স্বাধীন এবং সব দেশ সমান শর্তে বাণিজ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুযোগ পাবে।
এই চার্টার ছিল আমেরিকার কূটনৈতিক দক্ষতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু শুক্রবার হোয়াইট হাউসে বিশ্ব দেখল তার বিপরীত দৃশ্য। ইউক্রেনের বিপর্যস্ত নেতা ভলোদিমির জেলেনস্কি ওয়াশিংটনে এসেছিলেন। তিনি ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট রাখতে চাইছিলেন। তাঁর দেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ছাড়া সবকিছু দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন তিনি। কিন্তু এর প্রতিদানে তিনি পেলেন কেবল শিষ্টাচারের পাঠ। কেমন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়, তা তাঁকে শেখালেন আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে অসৎ, অশালীন ও অভদ্র প্রেসিডেন্ট।
রুজভেল্ট যদি চার্চিলকে হিটলারের সঙ্গে যেকোনো শর্তে শান্তিচুক্তি করতে বলতেন এবং বিনিময়ে ব্রিটেনের কয়লাসম্পদ যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে দিতে বলতেন, তাহলে সেটি ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠকের কাছাকাছি হতো। জেলেনস্কি হয়তো ট্রাম্পের মনমতো তোষামোদ করতে পারেননি। জেডি ভ্যান্সের উসকানিতে ধৈর্য ধরে রাখা উচিত ছিল তাঁর। কিন্তু যা–ই হোক না কেন, যেভাবেই দেখা হোক, দিনটি আমেরিকার জন্য এক লজ্জাজনক অধ্যায় হয়ে রইল।
এই বিপর্যয়ের মধ্যে একটিই সান্ত্বনার বিষয়, জেলেনস্কি শেষ পর্যন্ত সেই খনিজ সম্পদ–সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট তাঁকে চাপ দিয়েছিলেন এই চুক্তি করতে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য কিছু প্রতিদান আশা করতেই পারে। ইউক্রেন রাশিয়ার বিশাল সামরিক শক্তিকে বিপর্যস্ত করেছে। এটা আমেরিকার জন্য বড় অর্জন। কম খরচে কার্যকর ড্রোন যুদ্ধের যে নতুন কৌশল ইউক্রেন উদ্ভাবন করেছে, সেটিও পেন্টাগনের জন্য এক মূল্যবান শিক্ষা।
রুজভেল্ট ও রিগান, চার্চিল ও থ্যাচার—তাঁরা আজ কবরে শায়িত থেকেও হয়তো ক্ষোভে কাঁপছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব হলো, সেই আমেরিকার সম্মান পুনরুদ্ধার করা, যা হোয়াইট হাউসে বসে কিছু স্বার্থান্বেষী লোক কলঙ্কিত করেছেন।ট্রাম্প প্রশাসন সত্যিই ইউক্রেনের কাছে আর্থিক প্রতিদান চায়? তাহলে এর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে মিলে রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ দখল করে সেই টাকায় ইউক্রেনকে মার্কিন অস্ত্র কেনার সুযোগ দেওয়া। যদি যুক্তরাষ্ট্র এটি করতে না চায়, তাহলে ইউরোপই এগিয়ে আসুক।
ইউক্রেন তখন দাসো, সাব, রাইনমেটাল, বিএই সিস্টেমসের মতো ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর অস্ত্রের ওপর নির্ভর করবে। তখন দেখা যাবে, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সমর্থকেরা এই পরিস্থিতি কতটা মেনে নেন। ইউরোপের জন্যও এটি যত দ্রুত সম্ভব তাদের প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর একটি সুযোগ। ন্যাটোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলে তার বিকল্প গড়ে তোলার জন্যও তা দরকার।
ট্রাম্পের আচরণ অধিকাংশ ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি রিপাবলিকানদের প্রায় ৩০ শতাংশ এখনো বিশ্বাস করে যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়ানোর মধ্যেই রয়েছে। অধিকাংশ আমেরিকান হয়তো চান যে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হোক। কিন্তু তাঁরা নিশ্চয়ই চান না যে সেটি পুতিনের শর্তে শেষ হোক। ট্রাম্প প্রশাসনেরও এটি বোঝা উচিত।
ইউক্রেনে রাশিয়া যদি যুদ্ধবিরতির আড়ালে নিজেদের শক্তি পুনর্গঠনের সুযোগ পায়, তাহলে এর প্রভাব হবে আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়ের মতো। এতে আমেরিকার প্রতিপক্ষরা আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে। লক্ষ করুন, ট্রাম্প ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়ানোর পরপরই তাইওয়ান ঘিরে চীনের সামরিক মহড়া বেড়ে গেছে, ভিয়েতনামের উপকূলে চীনা যুদ্ধজাহাজ লাইভ-ফায়ার মহড়া চালিয়েছে। একটি চীনা যুদ্ধজাহাজ সিডনি থেকে মাত্র ১৫০ নটিক্যাল মাইল দূরত্বে চলে এসেছে।
জো বাইডেন বলেছিলেন যে মুক্ত বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য এই দশক গুরুত্বপূর্ণ। কথাটা ঠিক। তবে তাঁর বার্তাটি ছিল দুর্বল। কিন্তু এমন কিছু কঠোর মনোভাবাপন্ন ডেমোক্র্যাট আছেন, যাঁরা সামরিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে অভিজ্ঞ। তাঁরা ডেমোক্রেটিক পার্টিতে হ্যারি ট্রুম্যান ও জন এফ কেনেডির শক্ত অবস্থান ফিরিয়ে আনতে পারেন। তাঁরা এমন বার্তা দিতে পারেন, যার সঙ্গে এমনকি কিছু ট্রাম্পের ভোটারও একমত হবেন।
বাস্তবতা হলো, শুক্রবার ছিল একটি ভয়ংকর দিন। ভয়ংকর ইউক্রেনের জন্য, মুক্ত বিশ্বের জন্য এবং সেই আমেরিকার জন্য, যে একসময় আটলান্টিক চার্টারের নীতিগুলোর পক্ষে দাঁড়াত।
রুজভেল্ট ও রিগান, চার্চিল ও থ্যাচার—তাঁরা আজ কবরে শায়িত থেকেও হয়তো ক্ষোভে কাঁপছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব হলো, সেই আমেরিকার সম্মান পুনরুদ্ধার করা, যা হোয়াইট হাউসে বসে কিছু স্বার্থান্বেষী লোক কলঙ্কিত করেছেন।
ব্রেট স্টিফেন্স আমেরিকান সাংবাদিক
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করে চাকরি হারানোর ঝুঁকি কতটা?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মস্থল নিয়ে মন্তব্য করার আগে চিন্তাভাবনা করা জরুরি। যদিও কর্মীদের কিছু নির্দিষ্ট আইনি সুরক্ষা রয়েছে, তবে বাস্তবতা বেশ জটিল। সম্প্রতি টেসলার এক ব্যবস্থাপক লিংকডইনে ইলন মাস্ক সম্পর্কে সমালোচনামূলক মন্তব্য করার পর চাকরি হারিয়েছেন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মস্থল নিয়ে মন্তব্য করা কর্মীদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। নিয়োগকর্তারা সাধারণত কর্মস্থল সম্পর্কে প্রকাশ্যে সমালোচনা পছন্দ করেন না। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নীতিমালা রয়েছে, যা লঙ্ঘন করলে কর্মী চাকরিচ্যুত হতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনকি সহকর্মীর কোনো সমালোচনামূলক পোস্টে ‘লাইক’ দিলেও চাকরির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
তবে আইন অনুযায়ী কিছু সুরক্ষা কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য। তাই চাকরির চুক্তিপত্র ও প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নীতিমালা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা জরুরি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মস্থল নিয়ে মন্তব্য করার কারণে চাকরি হারানোর আশঙ্কা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। বিশেষ করে, যদি কেউ অ্যাট-উইল (ইচ্ছানুযায়ী চাকরিচ্যুত করা যেতে পারে) চুক্তির আওতায় কাজ করেন, তাহলে নিয়োগকর্তা যেকোনো সময়, যেকোনো কারণে তাকে বরখাস্ত করতে পারেন। তবে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন, বৈষম্যবিরোধী আইন বা নির্দিষ্ট শর্তযুক্ত চুক্তি। যেখানে চাকরিচ্যুতির নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব অঙ্গরাজ্যে অ্যাট-উইল কর্মসংস্থানের নিয়ম কার্যকর। তবে মন্টানা একমাত্র ব্যতিক্রম। এ অঙ্গরাজ্যে কর্মী ছাঁটাইয়ের জন্য যৌক্তিক কারণ দেখাতে হয় বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল কনফারেন্স অব স্টেট লেজিসলেচারস। এ ছাড়া দেশটির ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস অ্যাক্ট অনুযায়ী, কর্মীদের একত্র হয়ে কর্মপরিবেশ ও চাকরির শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করার অধিকার রয়েছে এবং এটি আইনি সুরক্ষার মধ্যে পড়ে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসংস্থান আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ক্যাথরিন ফিস্ক বলেন, যদি কোনো কর্মী যুক্তি দিতে পারেন যে তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন, তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন বা তাঁদের স্বার্থে কথা বলছিলেন, তাহলে তাঁর বক্তব্য আইনের আওতায় সুরক্ষিত হতে পারে। অধ্যাপক জেফ্রি হির্শের মতে, এমনকি সহকর্মীর কোনো পোস্টে ‘লাইক’ দেওয়া পর্যন্ত আইনি সুরক্ষার মধ্যে পড়তে পারে। তবে পোস্টটি অবশ্যই কর্মপরিবেশ বা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার মতো বিষয়ে হতে হবে এবং পোস্টটি একাধিক কর্মীর ওপর প্রভাব ফেলে এমন হতে হবে।
তবে সাধারণত, যদি কেউ শুধু ‘আমার বস খারাপ’ বা ‘আমার অফিসে কাজের পরিবেশ বাজে’–এর মতো ব্যক্তিগত মন্তব্য করেন, তাহলে তা আইনি সুরক্ষা পাবে না বলে জানিয়েছেন শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ মার্ক ক্লুগার।
সরকারি কর্মচারীরা (যেমন ফেডারেল, স্টেট ও স্থানীয় সরকারি কর্মী) যদি ব্যক্তিগত সময়ে কর্মস্থলের বাইরে থেকে কোনো সামাজিক ইস্যু নিয়ে মতপ্রকাশ করেন এবং সেটি গুরুতরভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে তবে তারা প্রথম সংশোধনী আইনের আওতায় সুরক্ষিত থাকেন। ফিস্ক বলেন, ‘শিক্ষক বা পুলিশ কর্মকর্তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার কারণে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন এমন বহু ঘটনা রয়েছে। যেখানে তারা প্রথম সংশোধনীর অধীনে সুরক্ষা পেয়েছেন।’
প্রতিষ্ঠান কর্মীদের মিথ্যা তথ্য প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে পারে। তবে সরাসরি সমালোচনামূলক পোস্ট নিষিদ্ধ করতে পারে না বলে জানিয়েছেন ক্লুগার।
‘ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস বোর্ড (এনএলআরবি) অতীতে এমন নীতিমালা পর্যালোচনা করে বলেছে, এগুলো খুব কঠোর। কারণ, এতে কর্মীরা কর্মপরিবেশ নিয়ে মতপ্রকাশের অধিকার হারাতে পারেন।’ তবে কর্মীদের ছাঁটাই না করেও প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বা সেবার বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করতে নিরুৎসাহিত করতে পারে। ক্লুগার বলেন, ‘আমি যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নীতিমালা তৈরি করি, তখন তাদের পরামর্শ দিই—কর্মীদের বোঝানো জরুরি যে তাদের ব্যক্তিগত পোস্ট কীভাবে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি প্রভাবিত করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, নীতিমালায় সাধারণত প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপমানজনক মন্তব্য থেকে বিরত থাকা, প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক গোপনীয়তা ফাঁস না করা এবং কর্মীরা যেন স্পষ্ট করেন যে তাঁদের মতামত প্রতিষ্ঠানের অফিশিয়াল মতামত নয়—এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে।
যদি কোনো কর্মী মনে করেন, তাঁকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে, তবে তিনি ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস বোর্ডে (এনএলআরবি) অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
অধ্যাপক হির্শ বলেন, ‘সমস্যা হলো, বেশির ভাগ মানুষ এ বিষয়ে জানেন না, এমনকি অনেক আইনজীবীও বুঝতে পারেন না যে কোনো কর্মী এই সুরক্ষা পেতে পারেন।’ অভিযোগ দায়েরের পরে এনএলআরবির একটি আঞ্চলিক অফিস এ বিষয়ে তদন্ত চালাবে এবং নিয়োগকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যদি নিয়োগকর্তা বিরোধ নিষ্পত্তি না করে, তবে এনএলআরবি বিনা মূল্যে মামলাটি পরিচালনা করবে। যদিও প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ, তবে বিচারক যদি কর্মীর পক্ষে রায় দেন, তাহলে তিনি তার চাকরিতে ফিরে যেতে পারবেন এবং বকেয়া বেতন পাবেন।
সূত্র: সিএনএন