আরবি মাসগুলির মধ্যে অন্যতম বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ মাস হইল রমজান, যাহা ইতোমধ্যে শুরু হইয়া গিয়াছে। এই মাসে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের মুসলমানেরাও সিয়াম সাধনা করিয়া থাকেন। তবে এই সাধনা এইবার কতটুকু নির্বিঘ্ন হইবে উহা লইয়া জনপরিসরে কিছুটা হইলেও উদ্বেগ সৃষ্টি হইয়াছে। বিশেষত নিত্যপণ্যের বাজার রমজান মাসে অস্থিতিশীল হইয়া উঠিবার প্রবণতা বরাবরই লক্ষ্য করা যায়। প্রায় প্রতিবৎসর রোজার পূর্বমুহূর্তে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী সরবরাহ কমিয়া যাইবার অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়াইয়া দিয়া থাকে। দুর্ভাগ্যবশত, অন্তত কতিপয় ক্ষেত্রে এইবারও উহার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। রোজা শুরুর পূর্বেই বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি ও দাম বাড়িয়া যাইবার বিষয়টা আঁচ করা গিয়াছে। বিশেষত বৃহস্পতিবারের সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোজার পূর্বেই ভোজ্যতৈলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হইয়াছে। অভিযোগ রহিয়াছে, বড় আকারে শুল্ককর ছাড় দিবার পরও ব্যবসায়ীদের দর বাড়াইবার আবদারে সরকারি সাড়া না মিলিবার কারণে বিলম্বে আমদানি দেখাইয়া বাজারে তৈলের সরবরাহ হ্রাস করা হইয়াছে। বস্তুত দুই মাসের বেশি সময় ধরিয়াই ভোজ্যতৈলের বাজারে চলিতেছে এক ধরনের অরাজকতা। বুধবারের সমকালের প্রতিবেদক রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরিয়া নিশ্চিত হইয়াছেন, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তৈল পাওয়া মুশকিল। খোলা সয়াবিনের সরবরাহ স্বাভাবিক মনে হইলেও সরকার নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিকতর দাম দিয়া ভোক্তাকে রন্ধন কার্যের প্রধান এই উপকরণটিকে ক্রয় করিতে হইতেছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দাবি করিয়াছে, তৈলের সংকটের বিষয়টি সঠিক নহে; কিন্তু বলিলেও বাস্তবতা ভিন্ন। অস্বীকার করা যাইবে না, চিনি, সবজি, আলু ও পেঁয়াজের দামে কিছুটা হইলেও স্বস্তি রহিয়াছে। বেগুন, ছোলা ও খেজুরের বাজারও অতীতের ন্যায় চড়া নহে। রমজান মাস ও ঈদে চাহিদা বাড়ে এমন ৯টি ভোগ্যপণ্যের আমদানিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়িয়াছে বলিয়া সম্প্রতি সমকালের আরেকটি প্রতিবেদনে উঠিয়া আসিয়াছে। উক্ত পণ্যসমূহের বাজারে সহনীয় পরিস্থিতি সম্ভবত ইহার ফল। কিন্তু মাছ-মাংসের বাজার বরাবরের ন্যায় তাতিয়া রহিয়াছে। মানুষ যাহাতে সহজেই প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মিটাইতে পারে সেইজন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় হইতে সুলভ মূল্যে দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রি করিবার ব্যবস্থা নিয়াছে সরকার। তবে চাহিদা-সরবরাহের বৃহৎ ফারাক এহেন উদ্যোগে কতটা ভরাট করা যাইবে সেই সন্দেহ বহাল আছে। ব্রয়লার মুরগি, লেবু, শসা ও বিদেশি ফলের দাম বাড়িতেছে। রমজানে সাহ্রি ও ইফতারের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে এই সকল পণ্যের গুরুত্ব সর্বজনবিদিত।
আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার নিত্যপণ্যের বাজারে তদারকি জোরদার করিবে এবং ব্যবসায়ীরা যাহাতে সরবরাহ ঘাটতি দেখাইয়া কোনো পণ্যের দাম বাড়াইতে না পারে সেই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে। রমজানের বাজার স্থিতিশীল রাখিবার বিষয়টি সম্মিলিত দায়িত্বও বটে। অধিক মুনাফার জন্য কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হইতে ব্যবসায়ীদের বিরত থাকা কাম্য। ভোক্তাদেরও অনুধাবন করিতে হইবে যে, সম্পূর্ণ মাসের বাজার একত্রে করিয়া নিত্যপণ্যের বাজারে সংকট বাড়াইবার দরকার নাই। আমরা জানি, রমজান সংযমেরও মাস। এই মাসে সব দিক হইতে যতই সংযম প্রদর্শন সম্ভব হইবে সংকটও ততটাই কমিবে। রমজান যেই পরিমিতিবোধের শিক্ষা দেয় তাহার আলোকে আচরণের পরিবর্তনও জরুরি। এইভাবে সকলে তাহার কর্মকাণ্ডে দায়িত্বশীল হইলে রমজানকে কেন্দ্র করিয়া বাজার অস্থিতিশীল হইবে না। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীলতার পাশাপাশি রমজানে স্বস্তি দিতে বিদ্যুৎ সরবরাহও স্বাভাবিক রাখিতে হইবে। রমজান একই সঙ্গে মানবতারও শিক্ষা দেয়। সেই শিক্ষা গ্রহণ করিলেও কাহারও পক্ষে আতিশয্যমূলক কোনো আচরণ করা সম্ভব নহে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: রমজ ন ব যবস য় যপণ য র সরবর হ সরক র রমজ ন হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিস্তিনিরা হামাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন?
এ সপ্তাহের শুরুর দিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার সড়কে কয়েক শ ফিলিস্তিনি নেমে এসে ইসরায়েলি বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তাঁরা অবরুদ্ধ গাজা থেকে হামাসের নিয়ন্ত্রণ অবসানের দাবি জানান। উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়া বৃহত্তম একটা প্রতিবাদ, যেখানে ৫০০ জন বিক্ষোভকারী অংশ নেন।
কিছুসংখ্যক মানুষ হামাস ও ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। বক্তাদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা বেইত লাহিয়ার মানুষেরা শান্তির পক্ষে। আমরা শান্তি ভালোবাসি এবং আমরা চাই এই যুদ্ধের অবসান হোক।’
ইসরায়েলি, ইসরায়েলপন্থী মিডিয়া এবং ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা ফিলিস্তিনিদের এই প্রতিবাদকে ব্যবহার করে। এটিকে ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনকে, বিশেষ করে হামাসকে, আক্রমণ করার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
এমনকি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কার্টজ এই বিক্ষোভে উল্লাস প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে বর্ণবাদী রাষ্ট্র হামাসকে পরাজিত করার প্রচেষ্টায় তাদেরকে বাজি ধরছে।
পাঁচ মাস আগে ইসরায়েলে একজন সাংবাদিক বলেছিলেন, ইসরায়েলি লোকেরা তাঁদের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ নিয়ে বিরক্ত এবং সে কারণে তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন এবং যুদ্ধ শেষ করার দাবি জানাচ্ছেন। এরপর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘গাজার লোকেরা কবে হামাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন?’ তিনি আমাকে বলেছিলেন, ইসরায়েলি নেতারা সেই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছেন।
প্রকৃতপক্ষে, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা চলছে। ইসরায়েলি নেতারা ও তাঁদের মিত্ররা অবরুদ্ধ ছিটমহলে ইসরায়েলি সেনারা যেসব যুদ্ধাপরাধ করে চলেছেন, তার জন্য হামাস এবং ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনকে দায়ী করে চলেছেন। গাজাকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার তাঁদের পূর্বপরিকল্পনায় ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য তাঁরা এটা সাজিয়েছেন।
ফিলিস্তিনিরা যদি তাঁদের অস্ত্র ত্যাগ করেন এবং বৈধ প্রতিরোধ বন্ধ করেন, তাহলে সেটা হবে না। প্রতিরোধ আমাদের মর্যাদা, প্রতিরোধ আমাদের সম্মান। আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের একমাত্র রাস্তা প্রতিরোধ।একজন ফিলিস্তিনি, আরেকজন ফিলিস্তিনি—ইসরায়েল কখনো এভাবে ভাগ করে না। তারা সব ফিলিস্তিনিকে শত্রু বলে মনে করে এবং সবাইকে নির্মূল করা উচিত বলে মনে করে। কারণ হলো, তাঁদের জোর করে নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করার পরও, তাঁদের জমি চুরি করার পরও এবং তাঁদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর পরও তাঁরা প্রতিরোধ ছেড়ে দেননি।
একটা বড় অংশের লোকেদের স্মৃতিশক্তি খুবই স্বল্পমেয়াদি। তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধ ইসরায়েলি নৃশংসতাগুলো এবং ইসরায়েলি নেতাদের অপমানজনক মন্তবগুলো এবং মিথ্যা দাবিগুলো মনে রাখতে অক্ষম। অতএব তাঁরা সেই ইসরায়েলি নেতাকে জানতে আগ্রহী না–ও হতে পারেন, যিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের সেরা বন্ধু হলো সেই ফিলিস্তিনি, যিনি মারা গেছেন।’
গণহত্যা শুরুর পর একটি টেলিভিশন ভাষণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইহুদি বাইবেল থেকে ধার নিয়ে ফিলিস্তিনিদের ‘আমালেক’ বলেছিলেন। এটি ইঙ্গিত করে যে সেখানে একটি আদেশ ছিল, যা নির্ধারণ করে যে ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই ইহুদিদের দ্বারা ধ্বংস করতে হবে।
নেতানিয়াহুর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত ফিলিস্তিনিদের ‘নরপশু’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। এর মাধ্যমে গাজায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার যৌক্তিকতা দিতে চেয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি দখলকৃত জায়গায় এ সবকিছুর সরবরাহ অবশ্যই জনগণকে বিনা মূল্যে দিতে হবে।
এরপর নেসেটের (ইসরায়েলের আইনসভা) উপ–স্পিকার নিসিম ভাতুরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লেখেন, ইসরায়েলের একটি সাধারণ লক্ষ্য হচ্ছে, ‘গাজাকে দুনিয়ার মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা।’ গাজার এতিহ্যবিষয়ক মন্ত্রী আমিচায় ইলিয়াহু গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, গাজায় একজনও বেসামরিক নাগরিক নেই।
গাজার বাসিন্দাদের জোর করে উচ্ছেদ করে দেওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ইসরায়েলের যোগাযোগমন্ত্রী শোহলো কারহি ফিলিস্তিনিদের দ্রুত বের করে দেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলে ফিলিস্তিনিরা মিসরে যেতে বাধ্য হবেন।
ইসরায়েলি নেতাদের কাছে ফিলিস্তিনি মানেই শত্রু। তাঁরা ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা করছেন। কোনো প্রতিরোধযোদ্ধা নেই, সেটা জানার পরও তাঁরা সেই সব এলাকাকে টার্গেট করছেন।
বিক্ষোভকারীরা শান্তির দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন যে ১৯৯৩ সাল থেকে আমাদের শান্তিতে বাস করা উচিত ছিল। কেননা, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন ফাতাহকে নিরস্ত্রীকরণের মধ্য দিয়ে ১৯৯৩ সালে পিএলও ওসলো শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। আমাদের তাতে কী হয়েছে? তারা আমাদের খুন করা অব্যাহত রেখেছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে হবে না যে তারা শান্তিপূর্ণ লোক। সেটা প্রমাণ করতে হবে ইসরায়েলিদের। যা–ই হোক, বিশ্বের ভণ্ড পরাশক্তি ও আরব নেতারা যতক্ষণ ইসরায়েলকে সমর্থন করে যাবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা হবে না।
ফিলিস্তিনিরা যদি তাঁদের অস্ত্র ত্যাগ করেন এবং বৈধ প্রতিরোধ বন্ধ করেন, তাহলে সেটা হবে না। প্রতিরোধ আমাদের মর্যাদা, প্রতিরোধ আমাদের সম্মান। আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের একমাত্র রাস্তা প্রতিরোধ।
মোতাসেম আ দল্লউল গাজার মিডল ইস্ট মনিটরের সংবাদদাতা
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত