আমার একজন আমেরিকান লেখক বন্ধু আছেন, যিনি যুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি করেন। গত কয়েক দশকে তিনি সংঘাতকবলিত দক্ষিণ সুদান, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, আফগানিস্তান, ইরাক, গাজা এবং অন্য জায়গায় গিয়েছেন। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান হলো: এখানে কে আগ্রাসনকারী আর কে ভুক্তভোগী, সেটা নিশ্চিত ছিল। বসনিয়া ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধ যুদ্ধ হলো দুটি ন্যায়সংগত যুদ্ধ।

পুতিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিন বছরের একটি ন্যায় যুদ্ধের পর, আমরা এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি অন্যায্য শান্তি পরিকল্পনা মোকাবিলা করছি। ইউক্রেন তার ভূমি হারাবে, এই ক্ষতির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না। যুদ্ধাপরাধীদের কোনো শাস্তি হবে না। রাশিয়ার ভবিষ্যৎ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য ইউক্রেনীয়দের কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া হবে না।

এটাই এখন বাস্তব চিত্র। ২০০৮ সালের রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। রাশিয়া তার প্রতিবেশী জর্জিয়ায় আক্রমণ করেছিল। সে সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন নিকোলা সারকোজি। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টও তিনি। রাশিয়াকে সন্তুষ্ট করার জন্য জর্জিয়ার ওপর জোর একটি অপমানজনক শান্তিচুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিলেন।

রাশিয়ার সেই জর্জিয়া যুদ্ধের পরবর্তী ফলাফল নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। সেই যুদ্ধে বিজয়ের পর, ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিকল্পনা আঁটেন। জর্জিয়া যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের যে লঘু প্রতিক্রিয়া, তাতে করে পুতিনের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রবল হয় যে তিনি ইউক্রেনে হামলা করলেও তার প্রতিক্রিয়া খুব একটা হবে না।

পুতিন জর্জিয়াতে যে যুদ্ধ করেছিলেন, সেটা ছিল অনেকাংশে ২০০৩ সালের পশ্চিমাপন্থী বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া। ইউক্রেনকে তিনি ‘শাস্তি’ দিয়েছেন ২০০৪ সালের কমলা–বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায়। সেই বিপ্লবে রাশিয়ার কক্ষ থেকে ইউক্রেন বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছিল।

পুতিনের এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়েছিল এবং ২০০৯ সালে এর বিশদ বিবরণ ইউক্রেনের সংবাদপত্রে দুজন ইউক্রেনীয় শীর্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষক একটি নিবন্ধে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সে সময় এটাকে কাল্পনিক কাহিনি বলে বিবেচনা করা হয়েছিল এবং খুব কমসংখ্যক মানুষই তাতে বিশ্বাস করেছিলেন।

২০০৮ সালে পশ্চিমের অনেকে যেমন পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করেছিলেন, পশ্চিমের অনেকে এখনো তাঁর দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করছে। কিন্তু ইতিহাস থেকে যদি আমাদের কিছু শেখার থাকে, তবে তার একটি শিক্ষা হলো: আপনি একজন আগ্রাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। ইউক্রেনের মানুষ কঠিন এক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এটা শিখেছেন।

যা–ই হোক না কেন, ২০১০ সালে রুশপন্থী ভিকতর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতায় এলে পুতিন ইউক্রেনকে রেহাই দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে সবাইকে বিস্মিত করে ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনকে ইউরোপের সঙ্গে একত্রকরণের প্রচেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ভোল পাল্টান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একত্রকরণের ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের আগে তিনি সেই প্রচেষ্টা থেকে সরে আসেন।

এখানে একটি জল্পনা আছে যে পুতিন ইয়ানুকোভিচকে হুমকি দিয়েছিলেন যে ইউক্রেন যদি পশ্চিমা শিবিরে যুক্ত হয়, তাহলে তিনি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একতরফাভাবে সরে আসার ঘটনায় ২০১৩ সালে কিয়েভে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, একসময় সেটাই ইউরো-ময়দান বিপ্লব বলে পরিচিত পায়।
রাজনৈতিক অচলাবস্থা কয়েক মাস স্থায়ী হয়। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে রাশিয়ার আগ্রাসন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এটি আমি বলছি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। ইউরো–ময়দান বিপ্লবের সময় আমি একটি অ্যাডহকভিত্তিক থিঙ্কট্যাংকে কাজ করতাম, পুতিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা জেনেছিলাম। আমরা জেনেছিলাম, সোচিতে অনুষ্ঠেয় শীতকালীন অলিম্পিক শেষ হওয়া পর্যন্ত পুতিন অপেক্ষা করছিলেন। অলিম্পিক শেষ হলেই ক্রিমিয়া দখলের প্রক্রিয়া শুরু হবে। ক্রেমলিন ভেবেছিল, তারা রাশিয়ান বসন্ত সংঘটিত করবে। ইউক্রেনের রুশভাষীরা কিয়েভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করবে। এটা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক ইউক্রেনীয়, তাঁরা যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন, তাঁদের জন্মভূমিতে যুদ্ধ হতে দেননি।

ইউক্রেনে একটা গৃহযুদ্ধের বদলে পুতিন দনবাস অঞ্চলে কম তীব্রতার যুদ্ধ পান, যে যুদ্ধে তিনি কখনোই জিততে পারেননি। কিন্তু পুতিন জানেন কীভাবে অপেক্ষা করতে হয়। পুতিনকে যাঁরা ভালো করে জানেন, তাঁরা বলেন যে পুতিন জুডো খেলার দর্শন মেনে চলেন। পুতিন তাঁর তরুণ বয়স থেকে জুডো খেলার অনুশীলন করেছেন। জুডো খেলায় জেতার নিয়ম হলো, প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ততক্ষণ পর্যন্ত লেগে থাকো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। ২০১৪ সালে ব্যর্থ হলেও পুতিন তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে দেননি। ২০২২ সালে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযানই সেটা প্রমাণ করেছে।

পুতিন ও তাঁর সঙ্গীরা বলেছেন যে ইউক্রেনের সঙ্গে তাঁরা যুদ্ধ করছেন না, বরং ইউক্রেনে পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। পুতিন মনে করেন, ইউক্রেন একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। রাশিয়ার ক্ষমতাকে প্রতিহত করতেই পশ্চিমারা এই রাষ্ট্রকে তৈরি করেছে। স্বাধীন ইউক্রেন পুতিনের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। রোম ও কার্থেজের মধ্যে যুদ্ধে যেমন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, ঠিক একইভাবে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ অস্ত্রবিরতি সম্ভব নয়।

যাহোক, যুদ্ধবিরতি খুব সামান্য কিছুরই সমাধান করতে পারবে। ইউক্রেনের জন্য সেটা আরও বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনীয়রা ন্যায্যতা ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চাইছে। এখন তার বদলে তারা পাচ্ছে নড়বড়ে ও অন্যায্য একটি যুদ্ধবিরতি।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তিন দিনে কিয়েভ দখলে নেওয়ার। পুতিন তাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

এখন আগামী তিন বছরের মধ্যে কিংবা তার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে পুতিনের লক্ষ্য অর্জনে ট্রাম্প তাঁকে সহায়তা করতে পারেন। এরপর পুতিনের সামনে থাকবে গোটা বিশ্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পুতিন পশ্চিমাদের আক্রমণ করবেন।

২০০৮ সালে পশ্চিমের অনেকে যেমন পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করেছিলেন, পশ্চিমের অনেকে এখনো তাঁর দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করছে। কিন্তু ইতিহাস থেকে যদি আমাদের কিছু শেখার থাকে, তবে তার একটি শিক্ষা হলো: আপনি একজন আগ্রাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। ইউক্রেনের মানুষ কঠিন এক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এটা শিখেছেন।

ভুল প্রমাণিত হলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমার ঐতিহাসিক শিক্ষা বলছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বযুদ্ধের এক দশকে প্রবেশ করেছে।

ইয়ারোস্লাভ রিস্টাক একজন ইতিহাসবিদ এবং লিভিভের ইউক্রেনীয় ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন য় ন ইউক র ন ইউক র ন র কর ছ ল ন র জন য উপ ক ষ হয় ছ ল বছর র ইউর প র একট

এছাড়াও পড়ুন:

নাইক্ষ্যংছড়িতে অস্ত্রসহ আটক ১

বান্দরবানে নাইক্ষ্যংছড়িতে দেশীয় অস্ত্রসহ বিকসান মিয়া (৩৪) নামে একজনকে আটক করেছে পুলিশ।

সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে সোনাইছড়ি ইউনিয়নে জারুলিয়াছড়ি লামার পাড়া এলাকায় তামাক ক্ষেত থেকে তাকে আটক করা হয়। 

বিকসান মিয়া নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের নেহের সোলাইমান গ্রামে মোহাম্মদ সোলাইমান মিয়ার ছেলে।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, গভীর রাতে বেশ কয়েকজন সমবেত হয়ে ডাকাতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে স্থানীয়রা সেখানে অভিযান চালায়। এসময় ডাকাত দলের একজন উত্তেজিত হয়ে এনামুল হক নামে একজনের মাথায় অস্ত্র তাক করে। পরে অস্ত্রসহ ঐ ডাকাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার শুরু করলে আশেপাশে থাকা লোকজন গিয়ে তাকে আটক করে। লোকজন দেখে সেসসময় ডাকাতদের অন্য সদস্যরা ভয়ে এদিক সেদিক পালিয়ে যায়।

এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাশরুরুল হক বলেন, “ডাকাতির প্রস্তুতিকালে অস্ত্রসহ ডাকাত দলের এক সদস্যকে আটক করা হয়েছে। একইসাথে দেশীয় তৈরি অস্ত্র ও দুই রাউন্ড রাইফেল গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়াধীন।”

ঢাকা/চাইমং/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুই প্ল্যাটফর্মের সমান সংখ্যক নেতা নিয়ে নতুন দলের কমিটি, আলোচিত সাবেক শিবির নেতারা থাকছেন না
  • আওয়ামী লীগ নেতার মেয়ের বিয়েতে গিয়ে বিতর্কে ওসি
  • সীতাকুণ্ডে শিবচতুর্দশী মেলায় ভিড়ের চাপে ৩ পুণ্যার্থীর মৃত্যু
  • স্তনের বাঁ পাশে একটা ফোড়ার মতো হয়েছে, সমাধান কী?
  • রিমান্ডে তাঁর শরীরে অ্যাসিড ছুড়ে মারেন ইসরায়েলি সেনারা, বললেন মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি
  • অনিবন্ধিত অবৈধ অভিবাসীদের জরিমানা ও কারাদণ্ড দেওয়ার প্রস্তাব ট্রাম্পের
  • সাহিত্যে নারীর উপস্থাপন বরাবরই প্রান্তিক: ফাল্গুনী তানিয়া
  • ‘তৃতীয় শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষক দিয়ে প্রথম শ্রেণির নাগরিক গড়া যায় না’
  • নাইক্ষ্যংছড়িতে অস্ত্রসহ আটক ১