পুতিন পাঁচ বছরের মধ্যে পশ্চিমের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করবেন
Published: 27th, February 2025 GMT
আমার একজন আমেরিকান লেখক বন্ধু আছেন, যিনি যুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি করেন। গত কয়েক দশকে তিনি সংঘাতকবলিত দক্ষিণ সুদান, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, আফগানিস্তান, ইরাক, গাজা এবং অন্য জায়গায় গিয়েছেন। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান হলো: এখানে কে আগ্রাসনকারী আর কে ভুক্তভোগী, সেটা নিশ্চিত ছিল। বসনিয়া ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধ যুদ্ধ হলো দুটি ন্যায়সংগত যুদ্ধ।
পুতিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিন বছরের একটি ন্যায় যুদ্ধের পর, আমরা এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি অন্যায্য শান্তি পরিকল্পনা মোকাবিলা করছি। ইউক্রেন তার ভূমি হারাবে, এই ক্ষতির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না। যুদ্ধাপরাধীদের কোনো শাস্তি হবে না। রাশিয়ার ভবিষ্যৎ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য ইউক্রেনীয়দের কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া হবে না।
এটাই এখন বাস্তব চিত্র। ২০০৮ সালের রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। রাশিয়া তার প্রতিবেশী জর্জিয়ায় আক্রমণ করেছিল। সে সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন নিকোলা সারকোজি। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টও তিনি। রাশিয়াকে সন্তুষ্ট করার জন্য জর্জিয়ার ওপর জোর একটি অপমানজনক শান্তিচুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিলেন।
রাশিয়ার সেই জর্জিয়া যুদ্ধের পরবর্তী ফলাফল নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। সেই যুদ্ধে বিজয়ের পর, ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিকল্পনা আঁটেন। জর্জিয়া যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের যে লঘু প্রতিক্রিয়া, তাতে করে পুতিনের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রবল হয় যে তিনি ইউক্রেনে হামলা করলেও তার প্রতিক্রিয়া খুব একটা হবে না।
পুতিন জর্জিয়াতে যে যুদ্ধ করেছিলেন, সেটা ছিল অনেকাংশে ২০০৩ সালের পশ্চিমাপন্থী বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া। ইউক্রেনকে তিনি ‘শাস্তি’ দিয়েছেন ২০০৪ সালের কমলা–বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায়। সেই বিপ্লবে রাশিয়ার কক্ষ থেকে ইউক্রেন বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছিল।
পুতিনের এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়েছিল এবং ২০০৯ সালে এর বিশদ বিবরণ ইউক্রেনের সংবাদপত্রে দুজন ইউক্রেনীয় শীর্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষক একটি নিবন্ধে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সে সময় এটাকে কাল্পনিক কাহিনি বলে বিবেচনা করা হয়েছিল এবং খুব কমসংখ্যক মানুষই তাতে বিশ্বাস করেছিলেন।
২০০৮ সালে পশ্চিমের অনেকে যেমন পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করেছিলেন, পশ্চিমের অনেকে এখনো তাঁর দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করছে। কিন্তু ইতিহাস থেকে যদি আমাদের কিছু শেখার থাকে, তবে তার একটি শিক্ষা হলো: আপনি একজন আগ্রাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। ইউক্রেনের মানুষ কঠিন এক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এটা শিখেছেন।যা–ই হোক না কেন, ২০১০ সালে রুশপন্থী ভিকতর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতায় এলে পুতিন ইউক্রেনকে রেহাই দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে সবাইকে বিস্মিত করে ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনকে ইউরোপের সঙ্গে একত্রকরণের প্রচেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ভোল পাল্টান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একত্রকরণের ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের আগে তিনি সেই প্রচেষ্টা থেকে সরে আসেন।
এখানে একটি জল্পনা আছে যে পুতিন ইয়ানুকোভিচকে হুমকি দিয়েছিলেন যে ইউক্রেন যদি পশ্চিমা শিবিরে যুক্ত হয়, তাহলে তিনি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একতরফাভাবে সরে আসার ঘটনায় ২০১৩ সালে কিয়েভে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, একসময় সেটাই ইউরো-ময়দান বিপ্লব বলে পরিচিত পায়।
রাজনৈতিক অচলাবস্থা কয়েক মাস স্থায়ী হয়। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে রাশিয়ার আগ্রাসন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এটি আমি বলছি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। ইউরো–ময়দান বিপ্লবের সময় আমি একটি অ্যাডহকভিত্তিক থিঙ্কট্যাংকে কাজ করতাম, পুতিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা জেনেছিলাম। আমরা জেনেছিলাম, সোচিতে অনুষ্ঠেয় শীতকালীন অলিম্পিক শেষ হওয়া পর্যন্ত পুতিন অপেক্ষা করছিলেন। অলিম্পিক শেষ হলেই ক্রিমিয়া দখলের প্রক্রিয়া শুরু হবে। ক্রেমলিন ভেবেছিল, তারা রাশিয়ান বসন্ত সংঘটিত করবে। ইউক্রেনের রুশভাষীরা কিয়েভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করবে। এটা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক ইউক্রেনীয়, তাঁরা যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন, তাঁদের জন্মভূমিতে যুদ্ধ হতে দেননি।
ইউক্রেনে একটা গৃহযুদ্ধের বদলে পুতিন দনবাস অঞ্চলে কম তীব্রতার যুদ্ধ পান, যে যুদ্ধে তিনি কখনোই জিততে পারেননি। কিন্তু পুতিন জানেন কীভাবে অপেক্ষা করতে হয়। পুতিনকে যাঁরা ভালো করে জানেন, তাঁরা বলেন যে পুতিন জুডো খেলার দর্শন মেনে চলেন। পুতিন তাঁর তরুণ বয়স থেকে জুডো খেলার অনুশীলন করেছেন। জুডো খেলায় জেতার নিয়ম হলো, প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ততক্ষণ পর্যন্ত লেগে থাকো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। ২০১৪ সালে ব্যর্থ হলেও পুতিন তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে দেননি। ২০২২ সালে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযানই সেটা প্রমাণ করেছে।
পুতিন ও তাঁর সঙ্গীরা বলেছেন যে ইউক্রেনের সঙ্গে তাঁরা যুদ্ধ করছেন না, বরং ইউক্রেনে পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। পুতিন মনে করেন, ইউক্রেন একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। রাশিয়ার ক্ষমতাকে প্রতিহত করতেই পশ্চিমারা এই রাষ্ট্রকে তৈরি করেছে। স্বাধীন ইউক্রেন পুতিনের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। রোম ও কার্থেজের মধ্যে যুদ্ধে যেমন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, ঠিক একইভাবে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ অস্ত্রবিরতি সম্ভব নয়।
যাহোক, যুদ্ধবিরতি খুব সামান্য কিছুরই সমাধান করতে পারবে। ইউক্রেনের জন্য সেটা আরও বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনীয়রা ন্যায্যতা ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চাইছে। এখন তার বদলে তারা পাচ্ছে নড়বড়ে ও অন্যায্য একটি যুদ্ধবিরতি।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তিন দিনে কিয়েভ দখলে নেওয়ার। পুতিন তাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এখন আগামী তিন বছরের মধ্যে কিংবা তার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে পুতিনের লক্ষ্য অর্জনে ট্রাম্প তাঁকে সহায়তা করতে পারেন। এরপর পুতিনের সামনে থাকবে গোটা বিশ্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পুতিন পশ্চিমাদের আক্রমণ করবেন।
২০০৮ সালে পশ্চিমের অনেকে যেমন পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করেছিলেন, পশ্চিমের অনেকে এখনো তাঁর দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করছে। কিন্তু ইতিহাস থেকে যদি আমাদের কিছু শেখার থাকে, তবে তার একটি শিক্ষা হলো: আপনি একজন আগ্রাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। ইউক্রেনের মানুষ কঠিন এক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এটা শিখেছেন।
ভুল প্রমাণিত হলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমার ঐতিহাসিক শিক্ষা বলছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বযুদ্ধের এক দশকে প্রবেশ করেছে।
ইয়ারোস্লাভ রিস্টাক একজন ইতিহাসবিদ এবং লিভিভের ইউক্রেনীয় ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন য় ন ইউক র ন ইউক র ন র কর ছ ল ন র জন য উপ ক ষ হয় ছ ল বছর র ইউর প র একট
এছাড়াও পড়ুন:
মোটরসাইকেলসহ হালদা নদীতে পড়ে যান দুই যুবক, ৮ ঘণ্টা পর একজনের লাশ উদ্ধার
ক্রিকেট খেলা দেখে বাড়ি ফিরছিলেন নুরউদ্দিন মোহাম্মদ (৩৫) ও তাজ উদ্দিন (৩৬)। পথে কাঠ ও বাঁশের সেতু পার হওয়ার সময় মোটরসাইকেলসহ হালদা নদীতে পড়ে যান তাঁরা। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে ঘটনাস্থলের কয়েক শ মিটার দূরে প্রবাসী নুরউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়।
গতকাল বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সুয়াবিল ইউনিয়নের সীদ্ধাশ্রম ঘাট এলাকায় হালদা নদীর ওপরের কাঠ ও বাঁশের সেতু থেকে ছিটকে পড়ে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় লোকজন তাজ উদ্দিনকে নদী থেকে উদ্ধার করতে পারলেও অপরজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন রাত ১২টায় অভিযান বন্ধ করে চলে যান। পরে রাত সাড়ে তিনটার দিকে নুরউদ্দিনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
নুরউদ্দিন স্থানীয় সুয়াবিল ইউনিয়নের পাঁচ পুকুরিয়া চন্দ্রঘোনা গ্রামের আবদুল ইসলামের ছেলে। গত রমজানে তাঁর বিয়ে হয় বলে জানায় পরিবার। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে থাকতেন তিনি। তাঁর সঙ্গে মোটরসাইকেলের পেছনের আসনে থাকা তাজ উদ্দিন স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
নুরউদ্দিনের চাচা মো. জহুরুল আলম বলেন, ঈদের কয়েক দিন আগে বিয়ে করেন নুরউদ্দিন। এর মধ্যে এমন দুর্ঘটনায় পরিবারটি এলোমেলো হয়ে গেল। কিছুদিন পর কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু দুর্ঘটনায় না–ফেরার দেশে যেতে হলো তাঁকে।
গতকাল বিকেলে প্রবাসী নুরউদ্দিন ও শিক্ষক তাজ উদ্দিন মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ির কাছে একটি মাঠে ক্রিকেট টিমের খেলা দেখতে যান। খেলা শেষে বাজার করে বাড়ি ফিরছিলেন দুজন। নুরউদ্দিন মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন আর তাজ উদ্দিন ছিলেন পেছনের আসনে বসা। হালদা নদীর কাঠ ও বাঁশের বেড়ার সেতু দিয়ে পার হওয়ার সময় মোটরসাইকেলসহ দুজন নদীতে পড়ে যান। সেতুটি মানুষ কিংবা গাড়ি উঠলেই কাঁপে। পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনীও নেই বলে জানান জহুরুল আলম।
আজ সকালে ফটিকছড়ি ফায়ার অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন কর্মকর্তা মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ঘটনার পর নদী এলাকায় অভিযান চালিয়ে নিখোঁজ প্রবাসীর খোঁজ পাননি। পরে রাত সাড়ে তিনটার দিকে ফোনে খবর পান, স্থানীয় লোকজন তাঁর লাশ উদ্ধার করেছেন নদী থেকে।
ফটিকছড়ির ভূজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পরিবারের অভিযোগ না থাকায় নুরউদ্দিনের লাশ বিনা ময়নাতদন্তে হস্তান্তর করা হয়েছে।