বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন বড় একটা প্রশ্ন উঠেছে; বিএনপি কি সত্যিই ‘কিংস পার্টি’? কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে বিএনপি আসলে ১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে তৈরি হওয়া সামরিক-সমর্থিত দল। এই অভিযোগ উঠছে এমন এক সময়ে, যখন দেশের রাজনীতিতে নতুন এক শক্তির আবির্ভাব হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই নতুন দল রাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন পাচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনের জন্য কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে। বিএনপি বলছে, যারা তাদের কিংস পার্টি বলছে, তারাই আসলে রাজনীতিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
তবে এই বিতর্ক শুধু বিএনপির সূচনা নিয়ে নয়। এটি আসলে বড় একটি প্রশ্ন তোলে; রাজনৈতিক দলগুলোর সত্যিকারের বৈধতা কী? গোপনে দল গড়া বা রাজনীতিতে লুকিয়ে কাজ করার ফলাফল কী হতে পারে? এসব বিষয় নিয়েই এখন দেশের রাজনীতিতে আলোচনা চলছে।
আরও পড়ুন‘কিংস পার্টি’ নিয়ে গুঞ্জন ও বিএনপির ভয় ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪কিংস পার্টি বলতে সাধারণত এমন রাজনৈতিক দলকে বোঝায়, যা সেনাবাহিনী বা কোনো শক্তিশালী শাসকের সহায়তায় তৈরি হয়। এসব দল তৈরি করা হয়, যাতে শাসকগোষ্ঠী সরাসরি ক্ষমতায় না থেকেও দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ইতিহাসে অনেক দেশেই এমন দল গড়ে উঠেছে—এক.
যদি বিএনপিকে এই কাঠামোর মধ্যে বিচার করা হয়, তাহলে এর জন্ম, বিকাশ ও রাজনৈতিক পথচলার সঠিক ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করা দরকার।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উত্থান ও বিএনপির জন্ম কোনো সাধারণ ‘কিংস পার্টি’ গঠনের মতো ঘটনা ছিল না। ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হলেও, জিয়াউর রহমান জোর করে ক্ষমতা দখল করেননি। বরং ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার ধারাবাহিকতায়, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে, তাঁর নেতৃত্ব উঠে আসে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীর ভেতর টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। এ সময় জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়, কিন্তু নিম্নপদস্থ সেনাসদস্য ও জনগণের একটি বড় অংশ তাঁকে সমর্থন করে, বিশেষ করে তাঁর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার কারণে।
প্রশ্ন করে উত্তর খোঁজা উচিত। যদি বিএনপি সত্যিই কিংস পার্টি হতো, তাহলে জিয়াউর রহমানকে রাজনৈতিক হত্যার শিকার হতে হতো না, আর আজ বিএনপিকে কোণঠাসা করার এত চেষ্টা করা লাগত না। কাজেই সব পক্ষ যদি সময়মতো বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইতিহাস হয়তো আবারও মোড় নেবে, যার ফলাফল প্রত্যাশার চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে।জিয়াউর রহমান যখন দেশের দায়িত্ব নেন, তখন বাংলাদেশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর তাঁর দ্রুত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে, যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। কৃষিকাজের উন্নতির জন্য খাল কাটা প্রকল্প চালু হয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে। তৈরি পোশাকশিল্পের প্রসারের জন্য নেওয়া তাঁর উদ্যোগ আজকের বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাতের ভিত্তি তৈরি করে। তিনি কৃষি ও বস্ত্রশিল্পের উন্নয়নের জন্য স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করেন, যা দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানো হয়, যে রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব: আপসহীন এক রাজনীতিকবাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শক্তিশালী নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সব সময় দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন। কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অটুট রেখেছেন এবং বিএনপির আদর্শের সঙ্গে কখনো আপস করেননি। তাঁর নেতৃত্ব দেশ-বিদেশে ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে ভুলভ্রান্তি ছিল, অনেক সীমাবদ্ধতাও ছিল। তবে তাঁদের মতো দূরদর্শী, ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব বাংলাদেশ এখনো পায়নি। তাঁদের অবদান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে গভীর ছাপ রেখে গেছে।
বড় দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্বএকটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ওপর বড় ধরনের দায়িত্ব রয়েছে। ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করায় বিএনপির সামনে এখন আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়ার চ্যালেঞ্জ এসেছে। সব বড় রাজনৈতিক দলের মতো বিএনপির কিছু নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তবে এটি শুধু বিএনপির সমস্যা নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি বাস্তবতা, যা এক দিনে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের শাসনের ফলে বিএনপির অনেক নেতা–কর্মী বাড়িঘর, জীবিকা ও পারিবারিক স্থিতিশীলতা হারিয়েছেন। ফলে অনেকের মধ্যে হারানো জায়গা পুনরুদ্ধারের মনোভাব তৈরি হয়েছে। বিএনপির নেতৃত্ব এসব চ্যালেঞ্জ বুঝতে পারলেও, গত ১৭ বছর কার্যকর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বাইরে থাকায়, ঠিকমতো কমিটি না করায়, সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা যথাযথভাবে এসব সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। সংগঠনের ভেতর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা বিএনপির জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে যে চাঁদাবাজি কি বিএনপি একাই করছে? অন্য দলগুলো কি এর বাইরে? বাস্তবতা হলো, যে দল যেখানে শক্তিশালী, সেখানেই চাঁদাবাজি হয়। বিএনপি বড় দল, তাই তাদের নিয়ে আলোচনা বেশি হয়। কিন্তু অন্য দলগুলোও কি একেবারে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা? এটা শুধু বিএনপির সমস্যা নয়, পুরো দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমস্যা। নতুন কোনো দল এলেই চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটা ভাবা ভুল। তাই একে অপরকে দোষারোপ না করে, সবাই মিলে কীভাবে এটা বন্ধ করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। তবে বড় দল হিসেবে বিএনপিকে সব সময় চাপে রাখতে হবে যেন তার কর্মীরা কোনো প্রকার চাঁদাবাজি করতে না পারেন।
আরেকটা নতুন বিপ্লব, নাকি রাজনৈতিক অচলাবস্থা?গত ১৭ বছর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া হয়েছে, যার ফলে মানুষ এখনো সেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই দীর্ঘ দমন-পীড়ন ও নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক পরিবেশ সব পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাসকে আরও গভীর করেছে। বিএনপি, দেশের অন্যতম প্রধান বড় দল হিসেবে, গণতান্ত্রিক চর্চাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে তরুণদের প্রয়োজন এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে তারা মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারবে এবং গণতান্ত্রিক আলোচনায় অংশ নিতে পারবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ আলোচনায় অংশ নেওয়ার সক্ষমতার ওপর। গোপন রাজনৈতিক কৌশল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা জনগণের মধ্যে শুধু হতাশাই বাড়াচ্ছে না, বরং সব পক্ষকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যদি এই ধারা চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে আরেকটি বিপ্লব দেখা দিতে পারে; শুধু ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধেও যারা গোপন কৌশল ও অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে।
ইতিহাসের ভুল যেন আবার না ঘটে, তাই রাজনৈতিক নেতাদের উচিত—এক. গোপন চক্রান্তের বদলে খোলামেলা রাজনৈতিক আলোচনা করা। দুই. স্বল্পমেয়াদি সুবিধার জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল না করে বরং আরও শক্তিশালী করা। তিন. বিভক্তির রাজনীতি এড়িয়ে সুস্পষ্ট ও সুশৃঙ্খল লক্ষ্যের অধীনে বিরোধী শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা।
যদি কিছু গোষ্ঠী লুকিয়ে রাজনৈতিক কৌশল চালিয়ে যেতে চায়, তাহলে তারা খুব শিগগির সচেতন ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় জনগণের প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে। এখনই সময় রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের প্রশ্ন করার, তারা কি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করছে, নাকি অতীতের ভুলই আবারও করছে? প্রশ্ন করে উত্তর খোঁজা উচিত। যদি বিএনপি সত্যিই কিংস পার্টি হতো, তাহলে জিয়াউর রহমানকে রাজনৈতিক হত্যার শিকার হতে হতো না, আর আজ বিএনপিকে কোণঠাসা করার এত চেষ্টা করা লাগত না। কাজেই সব পক্ষ যদি সময়মতো বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইতিহাস হয়তো আবারও মোড় নেবে, যার ফলাফল প্রত্যাশার চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে।
● মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল দ শ র র জন ত দ শ র র জন ত ত গণত ন ত র ক র জন ত ক প ন র জন ত ক র র জন ত ক ব এনপ র স দল হ স ব ব এনপ ক র রহম ন ব স তবত র জন য ক ষমত সমস য দলগ ল
এছাড়াও পড়ুন:
সাজেকে রিসোর্টে আগুন
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার পর্যটন কেন্দ্র সাজেকের একটি রিসোর্টে আগুন লেগেছে।
সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১টার দিকে ‘অবকাশ রিসোর্ট’ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন আশপাশের রিসোর্টে ছড়িয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিরিন আকতার বলেন, “আজ দুপুরের দিকে সাজেকের একটি রিসোর্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সেনাবাহিনী ও স্থানীয়রা আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালায়। সাজেকে দমকল বাহিনীর কোনো ইউনিট না থাকায় খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে ফায়ার সার্ভিস রওনা হয়েছে।”
আরো পড়ুন:
সাভারে কারখানার গুদামে আগুন, এক ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে
মুন্সীগঞ্জে হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড
ঢাকা/শংকর/মাসুদ