চলতি মাসে ইউরোপের দেশগুলো বুঝতে পেরেছে, তাদের সবচেয়ে কাছের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ৮০ বছর ধরে যে বিশ্বাসযোগ্য সহযোগিতায় আগ্রহী ছিল, এখন আর তারা সে অবস্থানে নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখন মিত্রদের অবজ্ঞা করছে; ইউক্রেনকে চাপে ফেলছে এবং ইউরোপের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। এতে তারা ইউরোপের প্রধান সহযোগী ও ইউক্রেনের শক্তিশালী সমর্থক থেকে ধীরে ধীরে তাদের প্রতিপক্ষে পরিণত হচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তখন আসলে কেউই (এমনকি মার্কিনরাও) ঠিক জানে না, যুক্তরাষ্ট্র কী পরিকল্পনা করছে।

তবে গত সপ্তাহে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে স্পষ্ট হয়ে গেছে, ন্যাটোর প্রতিরক্ষা খরচ ভাগাভাগি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অসন্তোষ ইউরোপ আর উপেক্ষা করতে পারবে না। শুধু খরচই সমস্যা নয়, যুক্তরাষ্ট্র এখন এশিয়া ও নিজের স্বার্থের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে ইউরোপকে এখন বড় রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে যে বড় পরিবর্তন এসেছে, তা তাদের ইউক্রেন নীতিতেই স্পষ্ট। ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। আগে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের দৃঢ় সমর্থক ছিল। কিন্তু এখন তারা ইউক্রেনকে চাপ দিয়ে আলোচনায় বসাতে চাইছে এবং ইউক্রেনকে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে বাধ্য করছে।

বাইডেন প্রশাসন ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করেছে, যাতে ইউক্রেনকে সাহায্য করা যায়, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় এবং ইউক্রেনের পুনর্গঠন নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। তারা ইউরোপীয়দের সঙ্গে সমন্বয় করে এই বিষয়গুলো পরিচালনা করছিল। তবে ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য এসব আলোচনায় কোনো ভূমিকা নেই। তারা আলোচনার ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের অংশগ্রহণ দেখতে চায় না।

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের মিউনিখে দেওয়া বক্তৃতা থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের ভূরাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে ইউরোপীয়রা অনেক কিছু শিখেছে। ওই বক্তৃতায় তিনি জার্মানির রাশিয়া–সমর্থক দক্ষিণপন্থী দলকে সমর্থন জানিয়েছেন। জার্মানির নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে ভ্যান্সের এই প্রকাশ্য সমর্থনদানকে দেশটির নির্বাচনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যদি এই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সফল হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র শুধু জার্মানিকেই নয়, পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই দুর্বল করে দেবে।

মিউনিখ স্পষ্ট করেছে, পরবর্তী যুদ্ধোত্তর আটলান্টিক সম্পর্কের দীর্ঘ যুগ শেষ। একটি শক্তিশালী পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এখন এই আশা করা খুব বড় ধরনের ভুল হবে যে ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে হওয়া ক্ষতি ভবিষ্যতে সারাই করে ফেলা যাবে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, ইউরোপকে তার শক্তির ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং ন্যাটোর নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে হবে।

এ মুহূর্তে কী করা উচিত, তা নিয়ে কিছুটা সময় বিভ্রান্ত থাকার পর ইউরোপের নেতারা মহাদেশে স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নিজেদের মতো করে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ১৭ ফেব্রুয়ারির অনানুষ্ঠানিক জরুরি বৈঠক ছিল তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ। সেটিকেই এখন দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে।

প্যারিস বৈঠকটি হয়েছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক সম্মেলনের (এআই অ্যাকশন সামিট) এক সপ্তাহ পর। এআই সম্মেলনে ইউরোপীয়রা প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। দুটো বৈঠক আলাদা বিষয়ের হলেও উভয় বৈঠক একই সমস্যার কথা বলছে। সেটি হলো ইউরোপকে নিজের সার্বভৌমত্ব নিজেকেই রক্ষা করতে হবে।

ইউরোপের সামনে ইউক্রেন বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ইউরোপীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা একটি অনেক বড় ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হবে। ইউরোপীয়দের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। যদি ইউক্রেন ও রাশিয়া কোনো চুক্তিতে পৌঁছায়, তাহলে ইউরোপীয়দের দায়িত্ব হবে সেটি নিশ্চিত করা। কারণ, ইউরোপ বুঝতে পারছে, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি কমাতে চায় এবং দেশটি আর ইউরোপের কোনো বিশ্বস্ত অংশীদার নয়।

এ পরিস্থিতিতে ইউরোপীয়দের ইউক্রেনের শান্তি বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার পাশে থাকা অন্যান্য এলাকা, যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা বাল্টিক অঞ্চলের সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে।

যদি ইউক্রেন ইউরোপীয় প্রতিরক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অংশ হয়ে ওঠে, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে ইউরোপীয়রা অনেক ভালো থাকবে। নিজের শক্তিশালী সেনাবাহিনী, উদ্ভাবনী প্রতিরক্ষা খাত এবং সহনশীল ও সৃজনশীল জনগণকে কাজে লাগিয়ে ইউক্রেন ইউরোপের জন্য একটি শক্তিশালী উৎস হতে পারে।

ইউরোপীয় দেশগুলোকে এখনই নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও শক্তিশালী করতে হবে। অর্থাৎ ইউরোপে একটি নতুন নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যাতে ন্যাটোর মধ্যে সদস্যদেশগুলো একে অপরের ওপর থেকে কিছু বোঝা ভাগ করে নিতে পারে। এমনকি যদি যুক্তরাষ্ট্র তার সহায়তা কমায় বা ন্যাটো থেকে সরে যায়, তবু ন্যাটো ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যবস্থা হিসেবে থাকবে।

প্যারিসে জরুরি বৈঠকে এবং তার দুই দিন পর দ্বিতীয় বৈঠকে যেসব দেশ প্রতিনিধিত্ব করেছে, তারা পরিস্থিতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মূল ভূমিকায় থাকতে পারে। ফ্রান্স, পোল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং বাল্টিক দেশগুলো (যেগুলো সবচেয়ে সরাসরি হুমকির সম্মুখীন) এর জন্য প্রস্তুত আছে বলে মনে হচ্ছে।

একইভাবে ইউক্রেনকে শক্তিশালী সমর্থন দেওয়া যুক্তরাজ্যও এর জন্য প্রস্তুত আছে। যুক্তরাজ্য ন্যাটোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পারমাণবিক শক্তি হিসেবে তার অবস্থানও রয়েছে। তাই যুক্তরাজ্যকে এই গ্রুপের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে ন্যাটো ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও তার সীমানা রক্ষা এবং দেশে উদার গণতন্ত্র রক্ষা ইস্যুতে আরও বেশি পদক্ষেপ নিতে হবে।

যদিও ইইউ প্রতিরক্ষা ইউনিয়নে পরিণত হবে না বা একটি ইউরোপীয় সেনাবাহিনী তৈরি করবে না, তবু এটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা সরবরাহের জন্য আরও কিছু করতে পারে। আগামী বছরগুলোতে জ্বালানি নিরাপত্তা ও দেশীয় উদ্ভাবন বাড়ানো ইউরোপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। যৌথ তহবিলের মাধ্যমে শেয়ার করা কৌশলগুলো ইউরোপীয়দের এই অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক খাতে শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হতে পারে।

ইউরোপীয়দের শক্তি আবার গড়ে তুলতে হবে। কারণ, পুরোনো জোটগুলো ভেঙে যাচ্ছে এবং ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তা ইউরোপীয়দের জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও ভালো করতে এবং চীনকে নিয়ে নিজেদের সম্পর্ক ভালোভাবে চালাতে সাহায্য করবে।

মিউনিখ স্পষ্ট করেছে, পরবর্তী যুদ্ধোত্তর আটলান্টিক সম্পর্কের দীর্ঘ যুগ শেষ। একটি শক্তিশালী পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এখন এই আশা করা খুব বড় ধরনের ভুল হবে যে ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে হওয়া ক্ষতি ভবিষ্যতে সারাই করে ফেলা যাবে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, ইউরোপকে তার শক্তির ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং ন্যাটোর নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে হবে।

ইইউ, যুক্তরাজ্য ও নরওয়ের মোট জনসংখ্যা ৫০ কোটির বেশি এবং তাদের যৌথ ক্রয়ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া ঘরোয়া রাজনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও তাদের সেই প্রতিষ্ঠিত স্থিতিশীলতা রয়েছে, যা এই সংকটকাল পার করার জন্য দরকার।

ইউরোপের কাছে প্রযুক্তি, ডিজিটাল অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ রয়েছে। আশার কথা, মিউনিখ দেখিয়েছে, ইউরোপ সময় নষ্ট না করে দ্রুত এগিয়ে যেতে প্রস্তুত রয়েছে।

ড্যানিয়েলা শোয়ার্জার বার্টেলসম্যান স্টিফটুং-এর নির্বাহী পর্ষদের সদস্য ও জার্মান ফরেন রিলেশনস কাউন্সিলের সাবেক পরিচালক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর ইউক র ন র পর স থ ত র জন ত ক ইউর প র ইউর প য় র জন য কর ছ ন ত করত র ওপর সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

বিবিসির সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের পর ফেরত পাঠাল তুরস্ক

বিবিসির সাংবাদিক মার্ক লোয়েনকে গ্রেপ্তারের পর ফেরত পাঠিয়েছে তুরস্ক। তিনি দেশটিতে কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী বিক্ষোভের খবর সংগ্রহ করছিলেন। লোয়েনকে ফেরত পাঠানোর ঘটনাকে বিবিসি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছে।

বিবিসি জানায়, লোয়েনকে বুধবার ইস্তাম্বুলে গ্রেপ্তার করা হয়। চলমান বিক্ষোভের খবর সংগ্রহে কয়েক দিন তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। গত সপ্তাহে ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুকে গ্রেপ্তারের পর এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

এক বিবৃতিতে বিবিসি জানায়, ‘বুধবার সকালে বিবিসি নিউজের প্রতিবেদক মার্ক লোয়েনকে ইস্তাম্বুল থেকে ফেরত পাঠিয়েছে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ। যে হোটেলে তিনি অবস্থান করছিলেন, সেখান থেকে আগের দিন তুলে এনে তাকে ১৭ ঘণ্টা আটক রাখা হয়। সাম্প্রতিক বিক্ষোভের খবর সংগ্রহে মার্ক লোয়েন তুরস্কে অবস্থান করছিলেন। আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হওয়ায় তাকে তুরস্ক ছাড়তে বলা হয়।’

দেশজুড়ে চলা সাম্প্রতিক বিক্ষোভে ১ হাজার ৮৫০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তুরস্কের ১১ জন সাংবাদিকও রয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ