সৌদি আরবের রিয়াদে ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে উচ্চপর্যায়ের যে কূটনৈতিক বৈঠক হয়ে গেল, সেটাকে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষই সফল বলেছে। ট্রাম্পের এক নম্বর তুরুপের তাস স্টিভ উইটকফ বলেছেন, ‘ইতিবাচক, গঠনমূলক, উৎসাহব্যঞ্জক ও খুবই নিরেট একটা সভা হয়েছে।’

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ও তাঁর সমকক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, রিয়াদের সভাটি ‘অত্যন্ত ফলপ্রসূ’ হয়েছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দিয়েছেন পররাষ্ট্রন্ত্রী মার্কো রুবিও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ ও উইটকফ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলে আর কারা ছিলেন, সে সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য নেই।

রুবিও বলেছেন, বৈঠকে তিনটি মূল বিষয়ে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে।
এক.

মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য একটা কূটনৈতিক দল গঠন করা।

দুই. ইউক্রেনে ‘সংঘাতের প্যারামিটারগুলো’ খুঁজে বের করার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের দল গঠন।

তিন. ইউক্রেন সংঘাত অবসান হওয়ার পর অর্থনৈতিক সহায়তার সুযোগগুলো খুঁজে বের করা। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এটিকে বলা হয়েছে, রাশিয়ার জন্য সম্ভাবনাময় একটি ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক সুযোগ।

লাভরভও ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ট্রাম্প–পুতিনের বৈঠকের বিস্তারিত ঠিক করার জন্য দুই দেশের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ট্রাম্প–পুতিন বৈঠকের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঠিক হয়নি।

রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতৃতে সের্গেই লাভরভ ও পুতিনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ। রাশিয়ার প্রতিনিধিদলে কিরিল দিমিত্রিয়েভও ছিলেন। তিনি রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (আরডিআইএফ) এবং রাশিয়ান ন্যাশনাল ওয়েলথ ফান্ডের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন। এ ছাড়া রাশিয়ার পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ভ্লাদিমির প্রসকুরিয়াকভ ও দিমিত্রি বালাকিন।

রিয়াদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যুদ্ধবিরতি অথবা ইউক্রেনের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, সেটা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। সব দায়িত্বশীল গণমাধ্যমে যে খবর বেরিয়েছে, তা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একটা বন্দোবস্তে পৌঁছাতে সম্ভাব্য শর্তগুলো মূল্যায়নের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এ নিয়ে দুই পক্ষ যদি একমত হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

প্রসকুরিয়াকভ কানাডায় রাশিয়ান দূতাবাসে কাজ করেন এবং আর্কটিক মহাসাগরীয় অঞ্চল বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। আর্কটিক অঞ্চলের সম্ভাব্য সহযোগিতা বিষয়টি রিয়াদে হয়ে যাওয়া সংলাপে একটি বিষয় ছিল। আর্কটিক বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছে, তার বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও, ধারণা করা হচ্ছে আর্কটিক মহাসাগরে সম্পদ আহরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্কটিক মহাসাগরে বরফ গলা অব্যাহত থাকায় জাহাজ চলাচলের পথ কীভাবে বিকাশ করা যাবে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

খবরে প্রকাশিত যে রিয়াদে মূল বৈঠকের পাশাপাশি দিমিত্রিয়েভের সঙ্গে অর্থনীতি ও বিনিয়োগ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তাঁর সমকক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কে ছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে সম্ভাব্য ব্যক্তি স্টিভ উইটকফ হতে পারেন। কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে গেলে, মস্কোয় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এবং ওয়াশিংটনে অবস্থিত রাশিয়ান দূতাবাস পরিচালনায় যেসব বিধিনিষেধ আছে, সেগুলো উঠিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। কূটনৈতিক পরিসরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে গেলে সেটা জরুরি।

বৈঠকের পর এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে লাভরভ বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসন যেসব বাধা তৈরি করেছিল, সেগুলো দূর করা প্রয়োজন। কেননা, সেগুলো কূটনৈতিক কাজে বাধা তৈরি করে। এর মধ্যে ক্রমাগত বহিষ্কার (কূটনীতিকদের বহিষ্কার) এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত।’

ইউক্রেন নিয়ে বৈঠকে কোনো উপসংহারে পৌঁছানো না গেলেও লাভরভ বলেন, ‘আমরা শুধু শুনিনি, আমরা প্রকৃতপক্ষে একে অন্যকে মনোযোগ দিয়ে শুনেছি।’
বৈঠকে ইউক্রেনের কোনো প্রতিনিধিকে ডাকা হয়নি। ইউরোপের কোনো রাষ্ট্র কিংবা সংস্থার প্রতিনিধিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এই প্রত্যাখ্যান ইউরোপের জন্য বজ্রঝড় বয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। ফ্রান্স তড়িঘড়ি করে ‘জরুরি’ বৈঠক (যদিও বৈঠকে ন্যাটোর সেই সব সদস্যরাষ্ট্রকে ডাকা হয়নি, যেগুলো ইউক্রেন যুদ্ধের বিরোধিতা করে) ডাকে।

ন্যাটো মহাপরিচালক মার্ক রুট প্যারিসের সেই বৈঠকে যোগ দেন। ন্যাটোর অনেক সদস্যরাষ্ট্রকে যেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, সেখানে কেন তিনি যোগ দিলেন, সেটা স্পষ্ট নয়।

প্যারিস বৈঠকে একটা ফলাফল এসেছে। সেটা হলো, ইউক্রেনে ‘শান্তিরক্ষার’ অংশ হিসেবে সেনা পাঠানোর ব্যাপারে ওয়াশিংটন ও লন্ডন প্রাথমিকভাবে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে ব্যাপারে কঠোর ভাষায় বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে শান্তি রক্ষার কাজে ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর জন্য যুক্তরাজ্য যখন প্রস্তাব দিয়েছিল, তখনই জার্মানি, ইতালি ও পোল্যান্ড বিরোধিতা করেছিল।

রিয়াদ বৈঠকের পর রাশিয়া এক বিবৃতিতে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছে যে শান্তিরক্ষী হিসেবে ন্যাটোর সেনাদের তারা স্বাগত জানাবে না।

বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে লাভরভ বলেছেন, ইউক্রেনের জন্য কথিত তিন ধাপের পরিকল্পনাটি ভুয়া। কথিত পরিকল্পনা মার্কো রুবিওর নামে ছড়িয়েছে। কথিত এই পরিকল্পনার তিনটি ধাপ হলো, যুদ্ধিবিরতি, ইউক্রেনে নির্বাচন ও চূড়ান্ত চুক্তি।

রিয়াদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যুদ্ধবিরতি অথবা ইউক্রেনের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, সেটা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। সব দায়িত্বশীল গণমাধ্যমে যে খবর বেরিয়েছে, তা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একটা বন্দোবস্তে পৌঁছাতে সম্ভাব্য শর্তগুলো মূল্যায়নের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এ নিয়ে দুই পক্ষ যদি একমত হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

কোনো ভণিতা কিংবা দোষারোপ ছাড়াই অত্যন্ত পেশাদারত্বের সঙ্গে রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার উচ্চপর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা বড় একটা পরিবর্তন।

স্টিফেন ব্রায়েন এশিয়া টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা এবং মার্কিন প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র ক টন ত ক পরর ষ ট ত হয় ছ পর য য় বল ছ ন র জন য ল ভরভ

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানকে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে হবে: স্টিভ উইটকফ

যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেছেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে তেহরানকে অবশ্যই তাদের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বন্ধ করে তা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার তিনি এ মন্তব্য করেন। এর মাধ্যমে ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আরেক দফা আলোচনা শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের চাহিদার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এর আগের দিন জ্বালানি উৎপাদনের জন্য সীমিত পরিসরে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণকে যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে বললেও উইটকফের গতকালের বক্তব্য সে অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

গতকাল এক বিবৃতিতে উইটকফ  বলেন, ‘যেকোনো চূড়ান্ত সমঝোতার মাধ্যমে এমন একটি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে—এর অর্থ হচ্ছে, ইরানকে অবশ্যই তার পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ ও অস্ত্রায়ন কর্মসূচি বন্ধ করে তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করতে হবে।’ 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক এই দূত আরও বলেন, ‘বিশ্বের স্বার্থেই আমাদের একটি কঠোর, তবে ন্যায্য ও স্থায়ী চুক্তি তৈরি করা জরুরি। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাকে ঠিক সেই কাজটিই করতে বলেছেন।’

উইটকফের আনুষ্ঠানিক পদবি ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ দূত’ হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে এই অঞ্চলের বাইরেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে আলোচনার নেতৃত্ব দেওয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ এই দূত গত শনিবার ওমানে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিলেন এবং ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক দফা আলোচনা করেন। পরবর্তী দফার আলোচনার দিন নির্ধারিত হয়েছে ১৯ এপ্রিল।

গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র চায়, ইরান তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ‘বাতিল’ করুক। এর পাশাপাশি হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওমানের সুলতান হাইথাম বিন তারিক আল সাঈদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আলোচনার মাধ্যমে শেষ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পারমাণবিক কর্মসূচি: যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পিছু হটবে না ইরান
  • ইরানকে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে হবে: মার্কিন
  • ইরানকে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে হবে: স্টিভ উইটকফ
  • চুক্তির জন্য ‘প্রস্তুত’ পুতিন, ‘যুদ্ধ শুরুর’ জন্য জেলেনস্কিকে দুষলেন ট্রাম্প