এক সপ্তাহ ধরে আমেরিকা ও ইউরোপের সম্পর্ক বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইউরোপ নিয়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কার করেছে, তারা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার জন্য আলোচনা করতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্র চায় ইউরোপ তার নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজে নিক। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন আভাস দিয়েছে, তারা চায় ইউরোপ ও আমেরিকার রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন একটি জোট গড়ে উঠুক। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের এ ধরনের টানাপোড়েন এর আগে অনেকবার দেখা গেলেও সাধারণত কিছুদিন পর পরিস্থিতি আগের মতো হয়ে যেত। কিন্তু এবারের ঘটনা ভিন্ন। 

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ট্রাম্পের কর্মকর্তারা ইউরোপের নেতাদের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিয়েছেন। এটি সম্মেলনজুড়ে উত্তেজনা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের কথাবার্তা শুনে তখনই সবাই বুঝতে পারছিলেন, ইউরোপের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।

এখন প্রশ্ন উঠছে, ইউরোপ কি নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষায় শক্তিশালী ভূমিকা নিতে পারবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বড় রাজনৈতিক খেলায় একপ্রকার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করবে? অন্যদিকে ইউক্রেন কি এ দফায় রাশিয়ার দখল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে? আরও প্রশ্ন উঠছে, যদি পশ্চিমা দেশগুলোর ঐক্য ভেঙে যায়, রাশিয়া যদি আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে ও যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়, তাহলে এর প্রভাব সারা বিশ্বের রাজনীতিতে কেমন হবে? 

এ পরিস্থিতি শুধু ইউরোপের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত বুধবার থেকে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, তিনি ও ভ্লাদিমির পুতিন মিলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শেষ করার জন্য আলোচনার একটি পরিকল্পনা করেছেন। এ খবর শোনার পর ইউরোপ ও ইউক্রেন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ, তারা ভয় পাচ্ছিল এই ভেবে যে তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, অথচ তাদের এই আলোচনার অংশই করা হয়নি। 

ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দপ্তরে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ঘোষণা করেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইউরোপকেই সামলাতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা খুবই সীমিত থাকবে। এই ঘোষণায় ইউরোপের দেশগুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ, তারা মনে করে, এ ধরনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তারা যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। এ ছাড়া হেগসেথ বিদ্যমান মার্কিন নীতির বিপরীত অবস্থান নিয়ে বলেন, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে না।

বিষয়টি পরিহাসের, কারণ ২০০৮ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রথমবার ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। অবশ্য জার্মানি ও ফ্রান্স তখন এর বিরোধিতা করেছিল। কারণ, তারা মনে করত, এতে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হতে পারে। 

ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে আলোচনার চ্যালেঞ্জ বিশাল। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাস যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে। কারণ, পুরো প্রক্রিয়া এখনো গঠনপর্বে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করছে না। তবে গত সপ্তাহের ঘটনাগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের এমন এক বড় প্রচেষ্টার সূচনা হিসেবে দেখতে হবে, যার লক্ষ্য ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের শর্ত পুনর্মূল্যায়ন করা। ট্রাম্প প্রশাসন এ ক্ষেত্রে কত দূর এগোতে পারবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। 

মিউনিখের মঞ্চে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স প্রবেশ করেন, তখন উপস্থিত সবাই দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা জানতে চাইছিলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের ইউক্রেন বিষয়ে প্রকৃত পরিকল্পনা কী? কিন্তু তাঁরা ভ্যান্সের মুখে যা শুনলেন, তা ইউরোপে কোনো আমেরিকান রাজনৈতিক নেতার দেওয়া সবচেয়ে বিতর্কিত ভাষণগুলোর একটি হয়ে থাকবে। 

ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি কিছু না বলে জেডি ভ্যান্স একধরনের আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। তিনি অভিযোগ তোলেন, ইউরোপ মুক্ত মতপ্রকাশ দমন করছে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে। তিনি বলেন, তারা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলোর অগ্রযাত্রা রোধ করছে। ভ্যান্সের এই বক্তব্য যেন গলিত সিসার মতো শ্রোতাদের ওপর নেমে আসে। গণতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত ইউরোপীয় নেতাদের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। ভ্যান্স ইচ্ছা করেই সবাইকে হতবাক করতে চেয়েছিলেন, এটি স্পষ্ট। তবে তিনি অপমান করার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি দুটিই করেছেন—অবাকও করেছেন, অপমানও করেছেন। 

 বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলেছেন ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার স্টাব। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে বলেছেন, ইউরোপের মতামত ছাড়াই যদি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে ইউরোপের নিরাপত্তাব্যবস্থার নতুন রূপরেখা তৈরি করে, তাহলে সেটি হবে আরেকটি ইয়াল্টা মুহূর্ত (‘ইয়াল্টা মুহূর্ত’ বলতে মূলত ১৯৪৫ সালের ইয়াল্টা সম্মেলনের প্রসঙ্গ বোঝানো হয়)। তবে তিনি চেয়েছেন সেটিকে একটি ‘হেলসিংকি মুহূর্তে’ পরিণত করতে, যেখানে ভবিষ্যৎ শান্তি ও সম্পর্কোন্নয়নের নীতিমালা নির্ধারণ করা হবে। 

অন্যদিকে কিছু নেতা ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এবং নিজের পথ অনুসরণ করে ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধ জয় করার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ধরনের বক্তব্যগুলো তিন বছর আগে বাস্তবভিত্তিক ছিল, তবে আজকের দিনে এর বাস্তবতার অভাব ইউরোপের সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এর ফলে ইউরোপের নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ সুরক্ষিত করার চেষ্টা ব্যাহত হতে পারে। 

এদিকে এশিয়ার দুই বড় দেশ চীন ও ভারত পশ্চিমের এই পরিবর্তন দেখে বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। পশ্চিমের এই বিভাজন দেখে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই খুব শান্তভাবে বক্তব্য দিয়েছেন। আসলে চীন নিজেই দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমের মধ্যে এমন বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর হয়তো কিছুটা সতর্ক ছিলেন; তবে তাঁকেও আশাবাদী মনে হয়েছে। চীন ও ভারতের মতো দেশগুলোর জন্য পশ্চিমের এই বিভক্তি এমনই এক সংকেত, যা তাদের ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে যে বাকি এই শতাব্দী তাদেরই হবে। 

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সৌদি আরবে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে পুতিন ও ট্রাম্পের পরবর্তী আলোচনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই দুই নেতার আলোচনায় মূলত ইউক্রেন ও সমগ্র ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে। অন্যদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ইউরোপীয় নেতাদের একত্র করার চেষ্টা করছেন, যাতে তাঁরা এই সংকট মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন। তবে তা করা অত্যন্ত কঠিন হবে। 

ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে আলোচনার চ্যালেঞ্জ বিশাল। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাস যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে। কারণ, পুরো প্রক্রিয়া এখনো গঠনপর্বে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করছে না। তবে গত সপ্তাহের ঘটনাগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের এমন এক বড় প্রচেষ্টার সূচনা হিসেবে দেখতে হবে, যার লক্ষ্য ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের শর্ত পুনর্মূল্যায়ন করা। ট্রাম্প প্রশাসন এ ক্ষেত্রে কত দূর এগোতে পারবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। 

এটুকু স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এই মৌলিক সম্পর্ক পরিবর্তনের পথে রয়েছে। আর এর সঙ্গে আধুনিক গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও জড়িয়ে আছে। 

ক্রিস্টোফার এস চিভিস কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের আমেরিকান স্টেটক্রাফট প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো ও পরিচালক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পরর ষ ট রমন ত র র পরর ষ ট ইউক র ন র র ইউর প ইউর প র কর ছ ন ন র পর মন ত র র জন ত আম র ক র জন য ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পের চিঠির জবাব দিয়েছে ইরান

পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নতুন চুক্তির আহ্বান জানিয়ে ইরানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চিঠির জবাব দিয়েছে তেহরান। ওমানের মাধ্যমে এই জবাব দেওয়া হয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এ কথা জানিয়েছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনার বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক নিবন্ধে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ট্রাম্পের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের জবাব ‘ওমানের মাধ্যমে যথাযথভাবে পাঠানো হয়েছে’।

আরাগচি বলেন, ‘সর্বোচ্চ চাপ ও সামরিক হুমকির মধ্যে থাকা অবস্থায় সরাসরি আলোচনায় যুক্ত না হওয়ার আমাদের নীতি এখনো বহাল আছে। তবে অতীতের মতো পরোক্ষ আলোচনা চলতে পারে।’

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের জবাবের মধ্যে একটি চিঠি রয়েছে, যেখানে বর্তমান পরিস্থিতি ও ট্রাম্পের চিঠির বিষয়ে আমাদের অভিমত বিস্তারিত তুলে ধরেছি।’

আরও পড়ুনইরানের নেতাকে ট্রাম্পের চিঠি০৭ মার্চ ২০২৫

‘সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের’ নীতির অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৮ সালে তাঁর প্রথম মেয়াদে ইরানের সঙ্গে হওয়া পারমাণবিক চুক্তি থেকে একতরফা সরে আসেন এবং দেশটির ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার শর্তে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে ওই চুক্তি করেছিল ইরান।

৭ মার্চ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় বসতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে তিনি চিঠি লিখেছেন। তেহরান আলোচনায় বসতে রাজি না হলে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাধ্যমে ওই চিঠি দেওয়া হয়েছিল। চিঠিতে আলোচনায় বসার জন্য ইরান দুই মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

সম্পর্কিত নিবন্ধ