শহীদুল্লা কায়সার (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭—১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১)। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক; প্রগতিশীল লেখক। লেখাটি ছাপা হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিধ্বনি পত্রিকায়, ১৯৬৪ সালে।
প্রবন্ধ: একুশে ফেব্রুয়ারিএকুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিসীম গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। সে শুধু অবাধ, শুধু আবেগজাত নয়—যুক্তি ও বিচারের মাপকাঠিতেও তার তারতম্য হয়।
বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার কর্মসূচি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির একমাত্র লক্ষ্য। এমন কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের একটি দিন একটি জাতির ইতিহাসে যুগান্তরের কাল বলে বিবেচিত হলো কেন? তার কারণ এই, ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত ছিল কতগুলো মূলনীতির প্রশ্ন। সেই মূলনীতিগুলোই আমাদের জাতীয় জীবনে তরঙ্গ তুলছে বারবার, প্রশ্ন তুলেছে, সমাধান খুঁজেছে, মীমাংসা পেয়েছে।
ভাষাগত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তার সঙ্গে তাই জড়িত ছিল সাংস্কৃতিক চেতনা, রাজনৈতিক আদর্শ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগ স্বীকারের প্রবৃত্তি। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাই কর্মসূচি অতিক্রম করে এ আন্দোলনকে বিশিষ্ট গৌরব দান করেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি একই সঙ্গে সংস্কৃতিচেতনার প্রকাশ ও বিকাশের দিন। তাই ১৯৫২ সালের পর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যেকোনো চক্রান্তই ব্যর্থ হয়েছে। বাংলা ভাষার জন্য আরবি ও রোমান হরফের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, হরফ সংস্কারের প্রচেষ্টাও সাধারণের সমর্থন পায়নি। অন্যদিকে সংস্কৃতিক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে দেশবাসী সচেতন হয়েছেন। ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য সম্পর্কে এই সদা জাগ্রত মনোভাবই রবীন্দ্রবিরোধী সকল কর্মকৌশলকে পযুর্দস্ত করেছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ ভূমিকা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নকে সামনে তুলে ধরা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে দলগত সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ না করেও বলা যায় যে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবই এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জনসাধারণের সর্বসম্মত দাবি ছিল। এই সঙ্গে অর্থনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটিও দেখা দিয়েছে। তা-ও হলো ১৯৫২ সালের চেতনার ফল।
অবশ্য এ কথা স্মরণ রাখা দরকার, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের মূলে যা ক্রিয়াশীল ছিল, তা শুধু সাংস্কৃতিক চেতনা নয়, রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও অর্থনৈতিক হতাশা। এ জন্যই ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলন নিতান্ত সীমাবদ্ধ ছিল, ১৯৫২ সালে তা অমন সর্বব্যাপী হতে পেরেছিল।
কিন্তু এ কথাও সত্য যে একুশে ফেব্রুয়ারিই সেই চেতনা, বিক্ষোভ ও হতাশাকে একটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ দিয়েছিল। এদিনের পরীক্ষায় উন্নীত হবার পরই ব্যাকুল জিজ্ঞাসা, অস্পষ্ট উপলব্ধি ও সচেতন দাবিদাওয়া একটা সুস্পষ্টরূপ লাভ করেছিল, জমাট বেঁধেছিল। জনসাধারণের শক্তির পরিচয় যেমন সেদিন পাওয়া গিয়েছিল, তেমনি আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছিল সকলের মনে। নেতাদের দ্বিধা ও জড়তাকে পায়ে দলে জনসাধারণ অগ্রসর হয়েছিল সেদিন এবং জেনেছিল যে
অধিকার অর্জনের অনন্ত সম্ভাবনা তার মধ্যেই নিহিত ছিল।
১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এসব কথা নতুন করে মনে পড়ছে। সেই অনন্ত সম্ভাবনাকে দেশের মানুষ আবার কাজে লাগিয়েছে। নেতৃত্বের দ্বিধা, জড়তা ও অনৈক্যকে পশ্চাতে ফেলে দেশবাসী আবার এগিয়ে গেছে। যে মানুষের ভাষার অধিকার দাবি করে একুশে ফেব্রুয়ারি দেখা দিয়েছিল ১৯৫২ সালে, এখন সেই মানুষের অধিকারের দাবিতে সংগ্রাম সূচিত হয়েছে। সেই আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি—ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে আবার দেখা দিয়েছে। এ সংগ্রামের ব্যাপকতা ও বিস্তার বিস্ময়কর। জনশক্তির এই প্রচণ্ড অভ্যুত্থান, তার সর্বব্যাপী চেতনা, তার সংগ্রামী চরিত্র—এসবের বিশ্লেষণে এ কথা মনে না হয়ে পারে না যে এই আন্দোলনের মূল নিহিত ছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেই। ১৭ বছরে তা ব্যাপক, বিস্তৃত ও সর্বপরিপ্লাবী হয়েছে। কিন্তু এর মূলনীতি রচিত হয়েছিল সেই কালান্তরের দিনে।
এ জন্যই মনে হয় একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের দিন নয়—তা আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার দিন, আত্মসাক্ষাৎকারের দিন, আত্মবিশ্বাসের দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শুভসূচনার দিন, জনশক্তির বিজয়যাত্রার দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিস্মরণীয় রক্তবর্ণ দিন।
আনিসুজ্জামান.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ১৯৫২ স ল র জন ত আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
আজ অমর একুশে
মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ভাষা শহীদদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে স্মরণ করে জাতি আজ শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ‘অমর একুশে’, ভাষা শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হবে।
এবার দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে— ‘মেক ল্যাঙ্গুয়েজেস কাউন্ট ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’।
ভাষা আন্দোলনের বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে খালি পায়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গাইতে গাইতে হাতে ফুল নিয়ে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া এবং পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ছাত্র ও সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস থেকে ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও কয়েকজন বাঙলার বীর সন্তান।
এই অমর একুশের পথ ধরেই বাঙালির স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হয় তীব্রভাবে। সেই আন্দোলনের পরিণতি- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন।
দিবসটি উপলক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার বাণীতে বলেছেন, শত বছরের শোষণে ও শাসনে জর্জরিত বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের প্রথম জয়যাত্রা ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে। বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়েছিল। এ দিনে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিক উদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ আরও অনেকে।
বাণীতে তিনি আরও বলেন, ১৯৫৬ সালে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ ও দেশের ভাষাগুলোর মর্যাদা রক্ষায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে, যা দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতেও সরকার কাজ করছে। এছাড়াও, ব্রেইল বইসহ বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সবাইকে মহান শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৫ এর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। এ উপলক্ষে নেওয়া সব কর্মসূচির সাফল্য কামনা করছি।
এএ