ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি আলোচনার পরিপেক্ষিতে জরুরি সম্মেলন ডেকেছেন ইউরোপীয় নেতারা। আগামী সপ্তাহে এই সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

রবিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ইউরোপকে বাদ দেওয়া হতে পারে, বিষয়টি নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো উদ্বিগ্ন।

আরো পড়ুন:

ট্রাম্প-পুতিন ফোনালাপ: ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আলোচনার ঘোষণা

রাশিয়ায় ১০৪ ড্রোন দিয়ে ইউক্রেনের হামলা

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বলেছেন, “ইউরোপকে অবশ্যই ন্যাটোতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে।”

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত কিথ কেলোগ জানিয়েছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনায় ইউরোপীয় নেতাদের পরামর্শ নেওয়া হবে, তবে তারা সরাসরি এতে অংশ নিতে পারবেন না।

আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওসহ হোয়াইট হাউজের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সৌদি আরবে রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধবিরতি নিয়ে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, ইউক্রেনকেও বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তার দেশ এই ধরনের কোনো আমন্ত্রণ পায়নি।

ইউরোপ মিনস্ক চুক্তিবদ্ধ, যা ২০১৫ সালে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি ব্যর্থ যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছিল। ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত ওই আলোচনায় পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াতে পারে কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ দূত মন্তব্য করেছেন যে, পূর্ববর্তী আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে কারণ অনেক পক্ষ জড়িত ছিল।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ইউক্রেনে শান্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে একত্রিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এই মাসের শেষে হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করার সময় ইউরোপীয় নেতাদের মতামত নিয়ে আলোচনা করার কথা রয়েছে। 

স্যার কিয়ার স্টারমার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এলে ইউরোপীয় নেতাদের আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও উপস্থিত থাকবেন। 

কিয়ার স্টারমার বলেছেন, যুক্তরাজ্য ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে একসঙ্গে রাখার জন্য কাজ করবে। তিনি আরো বলেন, উভয়ই বহিরাগত শত্রুদের থেকে জোটের কোনো বিভাজনকে বিভ্রান্ত করতে দেবে না।

তিনি বলেন, “আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটি এমন এক মুহূর্ত যেখানে আমরা আজকের বিশ্বের বাস্তবতা এবং রাশিয়ার কাছ থেকে আমরা যে হুমকির মুখোমুখি হচ্ছি তার সঙ্গে জড়িত।”

“এটা স্পষ্ট যে ইউক্রেনের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে এবং রাশিয়ার কাছ থেকে আমরা যে হুমকির মুখোমুখি হচ্ছি তা মোকাবেলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করার সময় ইউরোপকে ন্যাটোতে আরো বৃহত্তর ভূমিকা নিতে হবে।”

পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাডোস্লা সিকোরস্কি বলেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইউরোপীয় নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন ডেকেছেন।

জার্মানির মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে বক্তৃতাকালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ইউরোপের নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের সময় এসেছে। তিনি আরো জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে ইউরোপ ও আমেরিকার পুরনো সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে এবং ইউরোপকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।

জেলেনস্কি আরো বলেছেন, “আমাদের অগোচরে কোনো চুক্তি হলে তা আমরা কখনোই মেনে নেব না।”

ঢাকা/ফিরোজ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইউক র ন ইউর প য় ন ত ইউক র ন র বল ছ ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করে সন্‌জীদা খাতুনের বিদায়

আজীবন দেশের সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে বিদায় নিলেন সন্‌জীদা খাতুন। গতকাল মঙ্গলবার ৯২ বছর পূর্ণ করার কিছু আগে প্রয়াত হলেন দেশের এই অগ্রগণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আগামী ৪ এপ্রিল তিনি ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। জন্মদিনের পরিবর্তে সেদিনে হবে তাঁর স্মরণসভা।

রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বেলা ৩টা ১০ মিনিটে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় সন্‌জীদা খাতুনের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ ও পুত্রবধূ লাইসা আহমদ লিসা জানিয়েছেন, তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি সুস্থ ছিলেন না। তাঁর ছিল কিডনির জটিল রোগ। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯ মার্চ তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর নেওয়া হয় আইসিইউতে। অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।

সন্‌জীদা খাতুনের বড় মেয়ে অপালা ফরহাদ নভেদ আগেই প্রয়াত। ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ আর মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম নভেদসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও দেশ-বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন বহু গুণের অধিকারী অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা এই মানুষটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা জানিয়েছেন, মরদেহ রাতে হিমঘরে রাখা হবে।

সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আনা হবে তাঁর হাতে গড়া দেশের অগ্রগণ্য সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে। সন্‌জীদা খাতুনের অনেক নাতি–নাতনি ও ঘনিষ্ঠ বহু আত্মীয় বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা শেষবিদায় জানাতে আসবেন। সে কারণে দাফনের দিনক্ষণ পরে ঠিক করা হবে। ৪ এপ্রিল সন্‌জীদা খাতুনের জন্মদিনে ছায়ানটে স্মরণসভা করার পরিকল্পনা করা হলেও সময় এখনো ঠিক হয়নি।

সন্‌জীদা খাতুনের কীর্তির ধারা বিচিত্র। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সংগঠক ও সক্রিয় সাংস্কৃতিক নেত্রী। ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি। ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা। জনসাধারণের সাংস্কৃতিক বোধের উন্নয়ন এবং মুক্ত–উদার মানবিক সমাজ নির্মাণের অবিরাম প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে দেশের শিল্প–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তাঁর সহযোদ্ধা, সহশিল্পী, ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধরা শোকার্ত চিত্তে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক হাসপাতালে প্রথম আলোকে বললেন, তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন এবং জীবনকালটা মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। জনমানসে সংগীত, শিল্প, সাহিত্যের বোধ সৃষ্টি এবং এর সঙ্গে সামাজিক–সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার বোধ সঞ্চার করে গেছেন। বিপুলভাবে তিনি বাঙালির জীবন সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ করেছেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ নেই।

রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি ও শিল্পী বুলবুল ইসলাম বলেন, দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও সন্‌জীদা খাতুন—এই তিনজনের ভূমিকা পথিকৃতের মতো। তাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ সুগম করেছেন। দুজন আগেই প্রয়াত। এখন তৃতীয়জনও চলে গেলেন। নিজেকে অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে।

ছায়ানটের তবলার শিক্ষক এনামুল হক ওমর বললেন, যে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীদের সংগঠিত করেছেন, ছায়ানটকে পরিচালনা করেছেন, তার তুলনা হয় না। তাঁর প্রয়াণ জাতির জন্য অপরিমেয় ক্ষতি।

সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ছায়ানট, উদীচী, চারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।

সন্‌জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্‌জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই এতে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় সংগঠিত করেন বাংলাদেশের শিল্পীদের। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে সন্‌জীদা খাতুন ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।

সন্‌জীদা খাতুনের প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি দীক্ষা নেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতির। প্রথমে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর তালিম নেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনদের মতো বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের কাছ থেকে।

আইয়ুব খানের কঠোর শাসনকালে নানা বাধা অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে তিনি ও সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটের যাত্রা শুরু। ১৯৬৭ সালে তাঁরা রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে আয়োজন করে প্রভাতি গানের আসর। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান থেকেই প্রাণিত হয়ে নববর্ষ উদ্‌যাপন এখন দেশজুড়ে বিপুল এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ছায়ানটের এই প্রভাতি গানের আসরে ২০০১ সালে ভয়াবহ বোমা হামলা চালালেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।

এসব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সন্‌জীদা খাতুনের গবেষণা ও রচনার কাজও কম নয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টির অধিক। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, নজরুল মানস ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

সন্‌জীদা খাতুন দেশে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া সম্মানিত হয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দেশিকোত্তম পুরস্কার এবং কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র–তত্ত্বাচার্য উপাধিতে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ