নওগাঁর সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে বসবাস করেন নিঃসন্তান জাহানারা বেগম (৬০)। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া পাঁচ শতক জমি বিক্রি করে দুই লাখ টাকা পেয়েছিলেন। বেশি লাভের আশায় সেই টাকা একটি সমিতিতে রেখেছিলেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর টাকার লভ্যাংশ দিয়ে নিজের খরচ চালাতেন। জাহানারার সেই টাকা নিয়ে পালিয়েছে সমিতি।

জাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচ মাসত থ্যাকে আর লাভের টাকা দ্যাছে না। মূল টাকাও দ্যাছে না। এখন তো অফিসই বন্ধ। অফিসের সবাই প্যালে গেছে। একটু ভালো থাকার আশায় সহায়সম্বল সব সমিতিত র‍্যাখে নিঃস্ব হয়ে গেছি। ম্যানষের বাড়িত কাজ করে এখন কোনো রকম খ্যায়ে-পরে ব্যাঁচে আছি।’

জাহানারা বেগম লাভের আশায় নিজের শেষ সম্বল দুই লাখ টাকা ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সমিতিতে রেখেছিলেন। জাহানারার মতো নওগাঁ সদর ও আশপাশের এলাকার পাঁচ হাজারের বেশি গ্রাহকের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন।

প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় তফসিলভুক্ত ব্যাংক ও সংস্থার চেয়ে বেশি মুনাফা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ব্যাংকের আদলে মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ ও স্থায়ী আমানতের বিপরীতে গত দেড় দশকে এই টাকা তুলে নেয়। কিন্তু এখন লাভ তো দূরের কথা; আসল টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন চালু করেছিলেন নাজিম উদ্দিন ওরফে তনু নামের এক ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠানটি চালুর আগে তিনি ঢাকায় এমএলএম কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চাকরির অভিজ্ঞতা দিয়ে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছিলেন। নওগাঁ শহরের খাস-নওগাঁ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় করা হয়। এ ছাড়া শহরের সরিষাহাটির মোড়, বালুডাঙ্গা বাসস্টান্ডসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা এবং পাশের জয়পুরহাট, রাজশাহী ও বগুড়ায় প্রতিষ্ঠানটির মোট ৭৫টি কার্যালয় ছিল। গত ১২ নভেম্বর থেকে সব কার্যালয় বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন ছাড়াই এত দিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।

জেলা সমবায় কর্মকর্তা খন্দকার মনিরুল ইসলাম বলেন, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন কোনো সমিতি বা বেসরকারি সংস্থা নয়। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে সংস্থাটি কার্যক্রম চালাচ্ছিল। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সনদ ছিল না। এরপরও বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের নামে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেন।

নওগাঁ শহরের মাস্টারপাড়া এলাকার জাহিদুল ইসলাম ২০২০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। তখন তিনি ১৫ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকার মধ্যে ১০ লাখ টাকা তিনি বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে মাসিক আমানত প্রকল্পে জমা রাখেন। প্রতি লাখে ২ হাজার টাকা করে লভ্যাংশ পাচ্ছিলেন। কিন্তু জুলাই মাস থেকে লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ হয়।

জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার আগে এলাকার অনেকেই বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে টাকা জমা রেখেছিলেন। তাঁদের কাছে জানতে পারি, সেখানে টাকা রাখলে লাখে ২ হাজার টাকা লাভ পাওয়া যায়। এটা শুনে সরল বিশ্বাসে পেনশনের ১০ লাখ টাকা আমানত রাখি। শুরুতে লাভের টাকা নিয়মিত দিচ্ছিল। পরে গড়িমসি শুরু করে। এক মাস দিলে আরেক মাস দেয় না—এ রকম অবস্থা। জুলাই থেকে একেবারে বন্ধ করে দেয়। এখন টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চিন্তায় আছি।’

জাহিদুলের মতো টাকা উদ্ধার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন নওগাঁ পৌরসভার আরজি নওগাঁ এলাকার সাইফুল ইসলাম। বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা চার বছর ধরে জমা করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটিতে। সাইফুল বলেন, ‘সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা জমা রাখছিলাম। চার বছরে ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা করিছিলাম। চার বছরের লভ্যাংশে টাকা বেড়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকা হয়। এখন জমানো টাকা ফেরত ল্যাওয়ার জন্য থানা, ডিসি অফিস ও এসপি অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কিন্তু কোনো কাম হছে না।’

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জুলাই থেকে গ্রাহকদের লভ্যাংশ ও মূলধনের টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। তাঁরা গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করে পালাতে পারেন, এমন আশঙ্কায় কয়েকজন গ্রাহক সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় মালিকপক্ষ ও গ্রাহকদের মধ্যে একাধিকবার বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ও চেয়ারম্যান ৩০ নভেম্বরের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এর আগেই ১২ নভেম্বর নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন ও চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ পালিয়ে যান। এরপর থেকে অন্য কর্মকর্তারাও আত্মগোপনে। নির্বাহী পরিচালকের পালানোর খবর পেয়ে গ্রাহকেরা থানা ও আদালতে একাধিক মামলা করেন। এসব মামলায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদসহ এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নওগাঁর পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মানুষকে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। গ্রাহকদের অভিযোগ ছিল, তাঁদের জমানো টাকার বিপরীতে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। এমনকি মূলধনের টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে গ্রাহক ও মালিকপক্ষের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মূল ক্রীড়নক নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন ধাপে ধাপে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতারণা করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি পালিয়ে যান। তাঁকে ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।

জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়াল বলেন, গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের আইনিভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি গ্রাহকেরা কীভাবে তাঁদের সঞ্চিত টাকা ফেরত পাবেন, সে বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা পেলে সেটি বাস্তবায়ন করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ র হকদ র ল ইসল ম গ র হক এল ক র র বছর

এছাড়াও পড়ুন:

১৯ বছর পর সোমবার গোপালগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ, প্রস্তুতি সম্পন্ন

১৯ বছর পর আগামীকাল সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) আওয়ামী লীগের দুর্গখ্যাত গোপালগঞ্জে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিএনপির জনসভা। সভা সফল করতে ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন দলটির নেতারা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ও নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণাসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অংশ হিসেবে এই সভার আয়োজন করা হচ্ছে।

জনসভাকে ঘিরে গোপালগঞ্জে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে বইছে আনন্দের জোয়ার। কেন্দ্রীয় নেতাদের বরণ করতে বিভিন্ন সড়কে নির্মাণ করা হয়েছে তোরণ। ব্যানার ও ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে সড়কের দুইপাশ।

ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৬ সালের পর গোপালগঞ্জে আর কোনো জনসভা করতে পারেনি বিএনপি। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদে গোপালগঞ্জে বিএনপিকে প্রকাশ্যে কোনো মিছিল-মিটিংও করতে দেখা যায়নি। ঘরোয়া আলোচনার মাধ্যমেই সীমাবন্ধ ছিল তাদের কর্মসূচি বলে জানিয়েছেন নেতারা। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে গোপালগঞ্জের রাজপথ দাঁপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

আরো পড়ুন:

প্রধান উপদেষ্টাকে দুদু
আপনাকে ফুলের মালা দিয়ে বিদায় দিতে চাই

অস্ত্র হাতে বাজারে গিয়ে হুমকি, যুবদল নেতা বহিষ্কার

সোমবার গোপালগঞ্জ জেলা শহরের পৌর পার্কে সকাল ১০টায় শুরু হওয়া সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপনের। প্রধান বক্তা হিসেবে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) শামা ওবায়েদ উপস্থিত থাকবেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন- কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) সেলিমুজ্জামন সেলিম, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) খন্দকার মাশুকুর রহমান, সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদিন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম পটুসহ অন্য নেতারা। সভায় সভাপতিত্বে করবেন গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রফিকউজ্জামান।

সমাবেশ সফল ও রেকর্ড সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিএনপি ও দলটির সহযোগী সংগঠনগুলো দফায় দফায় প্রস্তুতি সভা, প্রচারণা ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে।

বিএনপির দলীয় সূত্র জানা যায়, গোপালগঞ্জ শহরের শেখ কামল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ২০০৪ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সর্বশেষ ফরিদপুর বিভাগীয় ইউনিয়ন সভা করেছিলেন। যা জনসভায় পরিণত হয়েছিল। সে সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সভা-সমাবেশ করতে পেরেছে। ১৯ বছর পর গোপালগঞ্জে আয়োজন করা জনসভায় ৩০-৪০ হাজর লোক সমাগমের টার্গেট নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। 

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি সিকদার শহিদুল ইসলাম লেলিন বলেন, ‍“দীর্ঘদিন আমরা উন্মুক্তভাবে রাজনীতি করতে পারিনি। ২৪ তারিখের সমাবেশকে ঘিরে নেতাকর্মীরা মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইছে। কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) সেলিমুজ্জামন সেলিমের নির্দেশনায় জনসভা সুন্দরভাবে সফল করতে কাজ করে যাচ্ছি।”

গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য অ্যাভোকেট তৌফিকুল ইসলাম তৌফিক বলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর উন্মুক্ত পরিবেশে আগামীকাল সোমবার পৌর পার্ক মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হবে।”

গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রফিকউজ্জামান বলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গোপালগঞ্জে স্বাধীনভাবে একটি কর্মসূচিও পালন করতে দেয়নি। বিগত সময় জাতীয়তাবাদী ধারার সমর্থকরা ভয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এখন আর কোনো ভয় নেই। ১৯ বছর পর কোনো বাধা ছাড়াই মুক্ত ও স্বাধীনভাবে জনসভার আয়োজন করা হবে। এতে ৩০- ৪০ হাজার লোকের সমাগম ঘটবে।”

তিনি আরো বলেন, “আমরা ২৪ তারিখের জনসভাকে কেন্দ্র করে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। কোনো বাধা ছাড়াই জনসভার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে নেতাদের তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে।”

ঢাকা/বাদল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ