‘জীবনে ফেলে আসা রাতগুলোর মধ্যে ওইটায় জঘন্যতম রাত’
Published: 13th, February 2025 GMT
সালটা ২০২৩। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ দিবাগত রাতটা আর সব শিক্ষার্থীর জন্য স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু ফুলপরী খাতুন নামে এক শিক্ষার্থীর জন্য ছিল যেন ‘কালরাত’। ইবির ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে ওই রাতে অমানবিক নির্যাতন করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা আবাসিক হলের গণরুমে নিয়ে ফুলপরীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। ফুলপরী তখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী। নির্যাতনের ঘটনা জানিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেন। এরপর বিষয়টি জানাজানি হলে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন এক আইনজীবী। তদন্তে নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়ায় ছাত্রলীগের নেত্রীসহ পাঁচজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সেই ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। গণরুমে ডেকে নির্যাতনের সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট লিখেছেন ফুলপরী। গতকাল বুধবার রাতে দেওয়া সেই পোস্ট তুলে ধরা হলো-
‘২০২৩ সালের ১১, ১২, ১৩, ১৪ ফেব্রুয়ারির সময়টায় আমি যে কত অসহায় ছিলাম! জীবনটা যে একান্তই নিজের, তাই নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে না পারা বোকামি। রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো শুধু উপদেশ ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। তারা ছোটবেলায় খাওয়ায়ে, পড়ায়ে, উপদেশ, ন্যায়-নীতি শিক্ষা দিয়ে হাত ধরে সামনে এগিয়ে দিয়ে সুন্দর করে হাতটা ছেড়ে দিয়ে উপদেশ দিতে শুরু করে- এখন একা বাঁচাতে শেখো।
যখন একাই সামনের দিকে এক পা দু’পা করে হাঁটতে শুরু করি; তখন কিছু কিছু রক্তের সম্পর্কের মানুষদের শিরায় শিরায় হিংসা, বিদ্বেষ জমতে থাকে। তারা সুযোগে সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা-বোধ করে না। অথচ তারা ইচ্ছে করলেই পারে সুন্দর কোনো বই উপহার দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে। কিন্তু তারা দিবে না, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার সুযোগে থাকে।
লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমরা অপরিচিত, অজানা মানুষদের সাথে চলতে, পরিচিত হতে শুরু করি। একটা মানুষ যাকে চিনি না, জানি না তার মুখের ওপর বারবার কেন আঙ্গুল তুলবো! মানুষের সাথে কেনোই বা খারাপ ব্যবহার করবো! সেই ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ভাবতেছিলাম, আমি কি এমন করলাম; যার জন্য এত বড় তুচ্ছতাচ্ছিল্য অপমানের শিকার হলাম! তাহলে কি তিনতলায় উঠায় আমার পাপ ছিল?
ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য নিজেই ছোট হয়েছি, ক্ষমা চেয়েছি, শান্তি চেয়েছি। আর যাই হোক এটা কোনো অপরাধ নয়। রাতে আপামণি ইবি ছাত্রলীগের আরাফাত (সভাপতি), জয় (সাধারণ সম্পাদক)-এর সাথে পরিকল্পনা করে ১১টায় আমার রুমে এসে এত ভালো ব্যবহার করতেছিল, রুমের আপুদের বলেছিল মাত্র টি-শার্ট বিক্রি করে আসলাম এখনই ফুলপরীকে গণরুমে সবকিছু নিয়ে যেয়ে থাকতে হবে। সন্ধ্যায় মামুন ভাই বলছিল- ওই আপু তোমায় গণরুমে নিয়ে যাবে। মানুষের প্রতি অগাধ ইতিবাচক ধারণার কারণে আর বেশি বোকা হওয়ার কারণে আমি তাদের সাথে চলে গেলাম। সেই চলে যাওয়াটা চিরদিনের জন্য চলে যাইনি যে, এটা আমার ভাগ্য!
জীবনে ফেলা আসা রাতগুলোর মধ্যে ওটায় জঘন্যতম রাত। মনে হচ্ছিল কোনো মার্ডার করা আসামির রিমান্ড চলছে, সাথে সুইসাইড নোট। আর শ্বাসকষ্টের জন্য আমারই ইনহেলার চেয়েও পাইনি। চলছে তো চলছেই। রাত শেষ হয়ে যায় তাও প্রতিহিংসা বিন্দু মাত্র কমে না। তারা বলতেছিল- আমাদের এমপি-মন্ত্রী আছে, ডাকেক এখন তোর স্যারকে, কে বাঁচাবে এখন?
আমার মনটা পাথরের মতো শান্ত, শ্বাস-প্রশ্বাসগুলো ছোট হয়ে আসতেছিল। তিনদিন হলো ঠিকঠাক মতো খাওয়া নাই, ঘুমও নাই। মনে হচ্ছিল, কখন যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। শীতে কাঁপতেছিলাম; মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল মুখে আঙ্গুলের দাগ, ঘুষির দাগ মুছে যাওয়ার জন্য। আমার কাছে মনে হয়েছিল এই অত্যাচারের ধরণগুলো কোনো কাপুরুষের শিখিয়ে দেওয়া।
কত মেয়ে ছিল ওই রুমে কেউ কিছুই বলছিল না। কেউ একটাবারের জন্যও বলল না- থাক আর মারিস না। আর যে যা পারতেছিল এটা-সেটা বলে তাদের মারের পরিমাণটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমি একবারের জন্যও বলিনি কেন মারছেন? জানি, মনুষ্যত্ববোধহীন প্রাণের মাঝে ন্যায়বোধ থাকে না।
তারা যা করছে তা লোকসমাজের সামনে বলা মানে নিজের মুখে ভাষা আর ব্যক্তিত্বকে ছোট করা তাই সেই রাতে কী কী হয়েছিল কেউ জিজ্ঞেস করলেও বলিনি। এখনও কিছুই বলিনি বললেই চলে। তারা যা করছে, এটা কি কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনের ক্ষমতার অপব্যবহার নয়?
তবুও মানুষ আমার চোখ মুখের সামনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আঙ্গুল তুলছে যে, আমাকে কেউ উস্কানি দিচ্ছে এগুলোর প্রতিবাদ করার জন্য। নিজের সম্মান, নিজের অধিকার কীভাবে আদায় করে নিতে হয়, তা আমি ছোট থেকেই খুব ভালো করে জানি। পৃথিবীর কোনো প্রাণীকে ভয় পাওয়ার জন্য জন্ম হয় নাই আমার। তারা ভয় দেখায় যে, মাঝরাতে হল থেকে বের করে দিব শেয়াল কুকুর ছিঁড়ে খাবে। বোকা চন্দ্রবিন্দুরা জানে না- আমি ছোট থেকে শিয়াল-কুকুরের সাথেই অন্ধকারে থেকে বড় হয়েছি, ভয় দেখায়ে লাভ নাই বিন্দুমাত্র।
যাদের চিনি না, যাদের সাথে কোনো শত্রুতা নেই, তারা শুধুমাত্র ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করার জন্য সাধারণ একটা নিরুপায় মনকে দুমড়েমুচড়ে পঙ্গু করে দেয়। মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকারটা হরণ করে নিতে চায়। নিষ্পাপ মনগুলোর হাহাকার, আত্মচিৎকার আপনা-আপনিই অভিশাপে রূপ নেয়। তাদের কর্মফল নিশ্চয়ই বেটার হয়েছে।
সুশীল সমাজের সুশীল নাগরিক যারা তখন ছিলেন, পাঁচটা মেয়ের জন্য তখন খুব মায়া লাগছে, তাও আবার আপনাদের সংগঠনেরই! একটা মেয়েকে জিম্মি করে রাখতে যা যা দরকার তার কোনোটাই বাদ দেয় নাই, যা সদ্য একবছর ক্যাম্পাসে আসা মেয়ের মাথায়ও আসবে না সে যতই উশৃঙ্খল হোক না কেন।
ওইতো একটু সুযোগ পেলেই মানুষ সদ্ব্যবহার করতে শুরু করে। কত মানুষের কত কথা নিঃশব্দে হজম করেছি, এলাকার মানুষ কত বাজে কথা বলেছে; এখনও বলে। শিক্ষিত চশমা আটা মানুষও আমার মুখে উপরই আঙ্গুল তুলেছে। আর মূর্খ এলাকার মানুষদের কী বলবো!
আমি আগেও কোনো অরাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম না। এখন ও নাই। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোঝার মতো ক্ষমতা যদি না থাকে তাহলে এত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে লাভ কি!
এলাকার রাজনৈতিক নেতারা বলত- আমার জন্য তাদের পাঁচটি মেয়ের জীবন নষ্ট। এতো মায়া! কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে যে শাস্তিটা দিতে পারতাম তা ইচ্ছাকৃতভাবেই দেয়নি!
পুলিশের অফিসার এসে বলে- আমার স্কুল কোনটা? মানে মাদ্রাসাতে পড়ছি কিনা এটা জানতে চায়। নিজেকে সামলাতে অনেক সময় লেগেছে, যা আমি কখনোই প্রত্যাশা করি নি। এ সমাজ একটা মানুষকে সুন্দরভাবে বাঁচতে দিতে চায় না। পিছন থেকে হাত-পা ধরে টানতে থাকে।
আমাদের মতো পরিবারের মেয়েদের কথা আর না বলি। তাই বলে ভালো মানুষ নাই নাকি পৃথিবীতে! আছে, অনেক আছে। সুন্দর মনের মানুষ, সুশিক্ষিত, মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মানুষ আছে বলেই তো আমরা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সময় বেঁচে থাকতে চাই।
জীবন থেকে, চারপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা সুন্দর করে বাঁচতে চাই। তাই তেমন কাউকে ভক্তি করি না, মানুষের থেকে দূরে-দূরে থাকি। সে ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। নিজের সৎ লক্ষ্য পূরণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
আমি বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের, এখনও চুপচাপ থাকি। কে কী বলল- এসব কানে নেই না। মানুষ হাজার কথা শুনিয়ে দিলেও কিছুই মনে করি না। কেউ আমার ওপর রাগ দেখিয়ে যদি শান্তি পায়, পেয়ে বড় হোক। কিন্তু বিপদে পড়লে পরিবার ছাড়া কেউ পাশে থাকে না। এজন্য এখন বন্ধু-বান্ধবী নেই বললেই চলে। যারা সামনে প্রশংসা করবে, আড়ালে সমালোচনার এমন মানুষ না থাকায় ভাল।
এখানে (ইবি) পড়তে এসেছি পড়া শেষ হলে চলে যাব, ন্যূনতম যেটুকু পরিচিত হওয়া দরকার ওইটুকুই যথেষ্ট। তবু ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এর রাত মস্তিষ্ক যতদিন সুস্থ থাকবে ততো দিন স্মৃতি হয়ে থাকবে।’
প্রসঙ্গত, ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের দায়ে বহিস্কৃতরা হলেন- ইবি শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী, হালিমা আক্তার, ইসরাত জাহান, তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জাহান।
ফুলপরী জানান, তিনি বর্তমানে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে থাকেন। পড়ছেন দ্বিতীয় বর্ষে। সেই রাতের ঘটনার পর থেকে খুব কমই শেখ হাসিনা হলে গিয়েছেন। শুরুর দিকে তাঁর সঙ্গে তেমন কেউ মিশতেন না; তবে এখন অনেকটা স্বাভাবিক।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবহ র র র জন র জন য স ন দর গণর ম
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনৈতিক স্বার্থে প্রতিষ্ঠান ব্যবহার, বাড়ছে দুর্নীতি
দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশে সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহারে বিস্তার ঘটছে দুর্নীতির। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছর বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের চাক্ষুষ প্রমাণ সত্ত্বেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২৪’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রতিবেদন তুলে ধরেন। আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্থার উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের ও পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
২০২১ সালের নভেম্বর থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ওপরের দিকেই রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ১০ম থেকে ২০২৪ সালে অবস্থান ১৪তম। চার ধাপ এগোলেও টিআইর ভাষ্য, বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়, দুর্নীতির সূচক স্কেলে ১০০ স্কোরের মধ্যে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ পেয়েছিল ২৪, এবার তা ২৩। বাংলাদেশের স্কোর কমলেও অন্য দেশ বেশি খারাপ করায় তালিকায় চার ধাপ উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। স্কোর কমায় দুর্নীতির ধারণা সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৫১তম, যা ২০২৩ সালে ছিল ১৪৯। এবার বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে ১৫১তম কঙ্গো ও ইরান।
সংবাদ সম্মেলনে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে যেসব সংস্থা করা হয়েছে, তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে।’ সরকারি প্রকল্পের কেনাকাটায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার (আওয়ামী লীগ) মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও বাস্তবে প্রশ্রয় এবং লালন করেছে। এমনকি দুর্নীতি সংঘটনে সহায়তা ও অংশ নিয়েছে। দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রীয়ভাবে তোষণ, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা ও সার্বিক কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের অবস্থানের ক্রমাবনতি হয়েছে।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘দুর্নীতিবিরোধী বাগাড়ম্বর ছাড়া এ নিয়ে পতিত আওয়ামী সরকারের কোনো বিকার বা চিন্তা দেখা যায়নি। এমনকি দুর্নীতি দমনে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও প্রকৃত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও দখলদারি-চাঁদাবাজি বহাল রয়েছে; শুধু লোক বদল হয়েছে। তবে দুদক বড় বড় দুর্নীতিবাজকে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। দেখা যাক তারা কতটুকু সফল হয়। সফল হলে পরের তালিকায় ফল পাওয়া যাবে।’
সিপিআই অনুযায়ী, দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে শূন্য থেকে ১০০-এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। এ পদ্ধতি অনুসারে স্কেলের শূন্য স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বোচ্চ এবং ১০০কে ব্যাপকতা সর্বনিম্ন ধারণা করা হয়। ২০২৪ সালে সবচেয়ে কম দুর্নীতি হয়েছে ডেনমার্কে। বিপরীতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির মাত্রা ছিল দক্ষিণ সুদানে।
১০০ স্কোরের মধ্যে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩। অর্থাৎ, বৈশ্বিক গড় স্কোরের চেয়েও বাংলাদেশের স্কোর ২০ কম, যে কারণে অত্যন্ত গুরুতর দুর্নীতি সমস্যাযুক্ত ১০১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। শুধু তাই নয়, গত ১৩ বছরের মধ্যে এবার সর্বনিম্ন স্কোর বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে দুর্নীতির তালিকায় বাংলাদেশের পরে আছে শুধুই আফগানিস্তান। দুর্দশাগ্রস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির পাকিস্তানও ওপরে রয়েছে বাংলাদেশের।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তালিকার শীর্ষে থাকা দক্ষিণ সুদানের স্কোর মাত্র ৮। তালিকায় তাদের পরে যথাক্রমে– সোমালিয়া (৯) ও ভেনেজুয়েলা (১০)। বিপরীতে সবচেয়ে কম দুর্নীতির ডেনমার্কের স্কোর ৯০। এ সারিতে ৮৮ নম্বর নিয়ে ফিনল্যান্ড দ্বিতীয়, ৮৪ নিয়ে সিঙ্গাপুর তৃতীয়, ৮৩ নিয়ে নিউজিল্যান্ড চতুর্থ ও ৮১ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম দুর্নীতি হয় ভুটানে। ১৮তম অবস্থানে তাদের স্কোর ৭২। ২০২৩ সালের চেয়ে ভুটানে দুর্নীতি কমেছে। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই গত বছর দুর্নীতি বেড়েছে।
দুদক শক্তিশালী করার সুপারিশ
দুর্নীতি কমাতে টিআইর পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রথমে দুদককে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে সংস্থাটি পুনর্গঠন করতে হবে। চাক্ষুষ প্রমাণ রয়েছে– এমন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দুদক, জনপ্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পেশাদার সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সরকারি কেনাকাটা, ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি ও অবকাঠামো খাতকে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিস্বার্থ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চর্চায় জনবান্ধব পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে টিআই।
তবু তারা কম দুর্নীতিগ্রস্ত
বাংলাদেশে থেকে পাচার অর্থ যেসব দেশে যায়, তাদের অবস্থানও কম দুর্নীতির তালিকায় রয়েছে। সিঙ্গাপুর ৮৪ পয়েন্ট নিয়ে ভালোর দিকে তৃতীয়, সুইজারল্যান্ড ৮১ স্কোরে পঞ্চম, অস্ট্রেলিয়া ১০ম, কানাডা ১৫তম, হংকং ১৭তম, যুক্তরাজ্য ২০তম, সংযুক্ত আরব আমিরাত ২৩তম, যুক্তরাষ্ট্র ২৮তম, মালয়েশিয়া ৫৭তম ও ভারত ৯৬তম। এ বিষয়ে ইফতেখারুজ্জমান বলেন, ‘দেশগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কম হলেও আইনের কিছু সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজরা পাচার অর্থ বিভিন্ন সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করে।’