দেশের রপ্তানিপণ্যে বৈচিত্র্য না থাকার বিষয়ে অনেক দিন ধরেই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। মোট রপ্তানি আয়ে তৈরি পোশাকের হিস্যা বছর বছর শুধু বাড়ছেই। সম্ভাবনাময় অনেক রপ্তানি পণ্য শেষ পর্যন্ত আর এগোতে পারেনি। এ বাস্তবতার বিপরীতে আশা জাগাচ্ছে কৃষিপণ্য। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও রপ্তানি আয় ৮ শতাংশ বেশি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য-উপাত্ত বলছে, চলতি অর্থছরের প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ৬০ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল ৫৪ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছর কৃষিপণ্য থেকে ১১২ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।
কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি উৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা সুবিধা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। একসময় এ হার ২০ শতাংশ ছিল। পরে তা ১৫ শতাংশ করা হয়। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে তা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
কৃষিপণ্য খাত থেকে রপ্তানি তালিকায় রয়েছে শুকনো খাবার, বিভিন্ন ধরনের সবজি, ফল, চা, তামাক, বিভিন্ন ধরনের মসলা, তেলবীজ, পান, সুপারি ইত্যাদি। কিছুটা অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তামাক। কৃষিপণ্যের মোট রপ্তানি আয়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে তামাক রপ্তানি থেকে। গত ছয় মাসে এসেছে ১৮ কোটি ডলার বা প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
কৃষিপণ্যের মধ্যে দ্বিতীয় বড় রপ্তানি খাত হচ্ছে শুকনো খাবার। গত ছয় মাসে ১১ কোটি ডলারের শুকনো খাবার রপ্তানি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। তৃতীয় বড় খাত হচ্ছে ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যানিম্যাল ফ্যাট। ছয় মাসে প্রায় ১০ কোটি ডলার এসেছে এসব পণ্য রপ্তানি করে।
প্রাণ-আরএফএল শুকনো খাবারের বড় রপ্তানিকারক। শত রকমের শুকনো খাবার এখন রপ্তানি হয়। তার পরও রপ্তানির পরিমাণ তামাকের তুলনায়ও কম কেন– জানতে চাইলে গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তৌহিদুজ্জামান সমকালকে বলেন, শুকনো খাবার রপ্তানিতে অনেক বড় সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাবনা অনুযায়ী রপ্তানি না বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ তেল, চিনি, আটার মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এ কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। ভারত ও পাকিস্তান এসব পণ্যের বড় রপ্তানিকারক দেশ। এ ছাড়া বড় বাজার ভারতে রপ্তানিতে নানা অশুল্ক, আধা শুল্ক বাধায় দেশটিতে চাহিদামতো রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
কৃষিপণ্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সবজির সম্ভাবনা নিয়ে অনেক কথা হয় বিভিন্ন ফোরামে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ৬০ ধরনের ২০০ জাতের সবজি ফলান বাংলাদেশের কৃষক। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয়। তবে ইপিবির তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত ছয় মাসে ৩ কোটি ডলারের কম মূল্যের সবজি রপ্তানি হয়েছে। মসলা আমদানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ধরনের মসলা রপ্তানি হয়েছে সবজির চেয়েও বেশি। ৩ কোটি ডলারের মসলা রপ্তানি হয় এ সময়।
রপ্তানিকারকদের মতে, বড় সম্ভাবনা সত্ত্বেও একাধিক কারণে সবজি রপ্তানি গতি হারাচ্ছে। বড় কারণের মধ্যে রয়েছে বাড়তি উৎপাদন খরচ। দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে ব্যাপক। উপকরণ, চারা-বীজের দামও বেড়েছে। বর্ধিত উৎপাদন ব্যয় অনুযায়ী ন্যায্য দর পাওয়া যায় না। প্রতিযোগী দেশগুলোতে এই সমস্যা নেই। সে কারণে তারা ভালো করছে। পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম সবজির প্রতিযোগী রপ্তানিকারক দেশ। অন্য কারণের মধ্যে রয়েছে ফ্রেইট কস্ট অর্থাৎ বিমান ভাড়া। করোনার সময় যে বিমান ভাড়া বেড়েছে, তা কিছুটা কমলেও এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই যায় বাংলাদেশের সবজি। এ ছাড়া গত কয়েক মাস দেশের বাজারেই সবজির দাম চড়া ছিল। এ কারণে রপ্তানি লাভজনক ছিল না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ভ ন ন ধরন র সবজ র র সবজ
এছাড়াও পড়ুন:
টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দেড় মাস ধরে বন্ধ সীমান্ত
কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরের সঙ্গে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন ও আকিয়াব বন্দরের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় দেড় মাস ধরে বন্ধ রেখেছে সে দেশের সরকার। কারণ, ইয়াঙ্গুন ও আকিয়াব বন্দর থেকে টেকনাফে আসার পথে পণ্যবাহী নৌযানগুলো আটকে দেয় দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সদস্যরা।
টেকনাফভিত্তিক আমদানি–রপ্তানিকারকেরা জানান, গত ১৬ জানুয়ারি তিনটি নৌযান আটকের পর ইয়াঙ্গুন ও আকিয়াব বন্দর থেকে আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত কোনো পণ্যবাহী নৌযান টেকনাফে আসেনি। ওই ঘটনার চার দিন পর পণ্যবাহী দুটি নৌযান ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যটি ছাড়ে ১৬ দিন পর। এ ছাড়া গত ১০ ফেব্রুয়ারি শাহপরীর দ্বীপের গোলারচর থেকে স্পিডবোটে ধাওয়া করে কাঠবোঝাই একটি ট্রলার অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। সেটি এখনো ছাড়েনি তারা। তবে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের সঙ্গে টেকনাফ স্থলবন্দরের বাণিজ্য সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে।
স্থলবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা বলেন, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সংঘাতের কারণে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। এতে টেকনাফের ব্যবসায়ীরা বেকায়দায় ও বিপাকে পড়েছেন।
টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর বলেন, নাফ নদী ও সাগরে আরাকান আর্মি পণ্যবাহী নৌযান আটেক দেওয়ায় টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে সীমান্ত বাণিজ্য প্রায় দেড় মাস ধরে বন্ধ রেখেছে মিয়ানমার সরকার।
এদিকে সরেজমিনে টেকনাফ স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা গেছে, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কোনো কর্মব্যস্ততা নেই। জেটিতে শুধু চালভর্তি একটি ট্রলার রয়েছে। আরেকটি ট্রলারে সিমেন্ট ও পানির বোতল ভর্তি করে রাখা হয়েছে।
স্থলবন্দরের শ্রমিকনেতা আজগর আলী বলেন, ‘শুধু মংডুর সঙ্গে টেকনাফের বাণিজ্য থেমে থেমে চলছে। গত দুই দিনে মংডু থেকে ৪ হাজার ৩০০ বস্তা চাল নিয়ে দুটি ট্রলার এসেছে। কোনো পণ্য না আসায় বসে থাকতে হচ্ছে। আমাদের আর কোনো আয়-রোজগারও নেই। খুব বেকায়দায় আছি আমরা।’
শুল্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৪৯ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে ২৯৫ কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে সরকার। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানির বিপরীতে ৯১ কোটি টাকার রাজস্ব পায় সরকার। রাখাইনে সংঘাতের কারণে পণ্য আমদানি কম হওয়ায় রাজস্ব আদায় কমে গেছে। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় এক কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল দুই কোটি টাকা মূল্যের ১ হাজার ৮২৮ মেট্রিক টন পণ্য।
টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক এনাম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী এনামুল হক বলেন, সীমান্ত বাণিজ্য মূলত ইয়াঙ্গুন ও আকিয়াব বন্দরের সঙ্গে হয়। কিন্তু দুঃখজনভাবে গত দেড় মাস ধরে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ রেখেছে মিয়ানমার সরকার। তিনি আরও বলেন, ‘দেশটিতে সংঘাতের কারণে উভয় দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি সীমান্ত বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা হতাশ।
মাছ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সুফিয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এম কায়সার জুয়েল বলেন, ‘মিয়ানমারের রুই, কাতলা ও ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। বিশেষ করে রমজানে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে চাহিদা বৃদ্ধি পায়; কিন্তু এবার কোনো মাছই আসছে না। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে দুই দেশের সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।’
টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট টেকনাফ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গত দেড় মাসে ইয়াঙ্গুন-আকিযাব বন্দর থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে কোনো পণ্যবাহী নৌযান আসেনি। তবে মংডু টাউনশিপ থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি থেমে থেমে হচ্ছে। তা–ও আবার সীমিত পরিসরে।’
স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা বিএম আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, মিয়ানমার থেকে পণ্য আসা বন্ধ থাকায় দৈনিক ৪ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
মিয়ানমার থেকে সাধারণত ছোলা, পিঁয়াজ, রসুন, জিরা, হিমায়িত মাছ, শুঁটকি, আচার, শুকনা সুপারি ও নারকেলসহ বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়।
জানতে চাইলে টেকনাফর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের জলসীমায় সে দেশের বিদ্রোহী আরাকান আর্মি তল্লাশির নামে পণ্যবাহী জাহাজ আটকে দেয়। এতে টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।