Risingbd:
2025-01-31@12:02:55 GMT

মুদ্রিত বই মানেই সাহিত্য নয়

Published: 20th, January 2025 GMT

মুদ্রিত বই মানেই সাহিত্য নয়

এ তো জানা কথাই, মুদ্রিত প্রায় সব বইয়ের গায়ে দাম লেখা থাকে। সেই দামের সঙ্গে বইয়ের বিষয়, লেখকের মান সম্পর্কযুক্ত না-ও হতে পারে। বইয়ের ক্রয়-বিক্রয় মূল্য দিয়ে সাহিত্য বিচার করা যায় না। বই নিজে একটা পণ্য এবং প্রকাশনা একটা ব্যবসা। আর সব ব্যবসাতেই খাঁটি-ভেজাল আছে। কাজেই বই প্রকাশনার সঙ্গে ভালো-মন্দ থাকবেই। জগতের এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যেখানে ভালো-মন্দের মিশেল থাকবে না। বেশি দাম দিয়ে কিনলেই ভালো জিনিস পাওয়া যাবে সেটাও সঠিক নয়। হালের অনেক লেখক মোটা বই লিখে ত্যানা পেঁচিয়েছেন। জিনিস মোটা হলে ভালো, দামি হলেই ভালো তা কিন্তু নয়।

‘সাইজ ডাজন্ট ম্যাটার’ কথাটি আমরা ছোটবেলা শুনেছি। শিশুসাহিত্যের যাদুকর লেখক উইলিয়াম জি বেনট্রিমের একটা কথা আছে: ‘শারীরিক আকার কখনোই হৃদয়, আত্মা বা মানস গঠনের তীব্রতা বা কোমলতা নির্ণয় করতে পারে না। যথার্থ অর্থে একজন মানুষ খাটো না লম্বা তা আদৌ পরিমাপের বিষয় না।’

কথাটিকে বইয়ের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায়। একটা বই কতো পৃষ্ঠার, কতো দামের, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই বইয়ের বিষয়, ভাবনা বা আত্মা। এরিস্টটলের ‘পোয়েটিকস’ বিশ্বব্যাপী পাঠ্য। সেই বই তো আকারে ছোট, দামে কম, অথচ প্রভাব বিস্তারে প্রবল। ‘পোয়েটিকস’ পাঠ না-করে সাহিত্যের তাত্ত্বিক আলোচনায় যাওয়া যায় না। অন্যদিকে, মার্কেজের শেষ উপন্যাস ‘মেমোরিজ অব মাই মেলানকোলি হোর্স’ আমার বিবেচনায় তার সেরা কাজ। কিন্তু সেটি একশ পাতার বইও নয়। তুলনায় মার্কেজের অন্য বইয়ের চেয়ে এটি দামেও কম। কিন্তু সাহিত্য মানের কথা বলতে গেলে তার এই বই নিয়ে মূল বইয়ের চেয়ে বৃহত্তর আলোচনায় যাওয়া যায়। আমার প্রিয় আরেকটা বই ‘জোনাথন লিভিংস্টন সীগাল’ (রিচার্ড বাখ)- এটিও আকারে পাতলা এবং দামে শস্তা। কিন্তু এর প্রকাশনা মান যেমন উঁচু দরের, সাহিত্য মানও উঁচু দরের। যে কোনো বিষণ্ণ কিংবা ডুবন্ত মানুষকে উড়বার প্রেরণা দিতে পারে ছোট্ট এই বই। মোদ্দা কথা হলো বই, বইয়ের প্রকাশনা মান ইত্যাদির সঙ্গে সাহিত্য মান গুলিয়ে ফেলা যাবে না। বিশেষত বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বইয়ের মূল্য সাহিত্যমূল্য বিবেচনায় হয় না। 

আরো পড়ুন:

আমাদের বইমেলা: হতাশা ও আশা

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি বন্ধ হচ্ছে, পাঠকদের প্রতিবাদ

ছাপাখানার খরচ আর সাহিত্য সৃষ্টির খরচ তো এক নয়। আমাদের দেশে গড়পরতা প্রকাশকরা সাধারণত ফর্মা হিসাবে, ছাপার খরচ ধরে বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করেন। প্রতি বছর কাগজের দাম, কালির দাম, বাঁধাই খরচ ইত্যাদির সঙ্গে এই দাম নির্ভর করে। মোটাদাগে বিষয়বস্তু হিসাবেও অনেক সময় বইয়ের দাম ধরা হয়। মানে নোট বই চলে বেশি, তার দাম কম রাখলেই হয়। বাজার চলতি লেখকের বইয়ের দামও সেইদিক থেকে কম হয়। আবার অতি গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের বই বাজারে কম চলে, খরচ ওঠানোর জন্যে তাই তার দাম বেশি রাখতে হয়। বাজারে যে বই বেশি চলে তার দাম কম রাখলে পোষায়, যে বই কম চলে তার দাম বেশি রাখতেই হয়। হিসাবটা অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত, সাহিত্য-রীতির সঙ্গে নয়। 

বইয়ের মূল্যের সঙ্গে মুদ্রণসংখ্যার হিসাবও জড়িত। যতো বেশিসংখ্যক বই ছাপা হবে মুদ্রণ খরচ ততো কম হবে। ফলে যে বই সংখ্যায় বেশি ছাপা যায় তার মূল্য কম হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কোনো লেখকই নিশ্চিত করে জানেন না তার বই কতো কপি ছাপা হয়েছে। কেউ যদি জানেনও সেটা মৌখিক, লিখিত কোনো ডকুমেন্ট লেখককে দেওয়া হয় না। সোজা কথায়, প্রকাশক যা বলেছেন তাই বিশ্বাস করতে হচ্ছে। এখন ধরা যাক প্রকাশক চুক্তিপত্রে ৩০০ কি ৫০০ বই লিখলেন, সেটাও যাচাই করার সুযোগ লেখকের নেই। কোনো রকম বই প্রকাশ হলেই খুশিতে বাকবাকুম টাইপ লেখকরা তা যাচাই করতেও যান না। আর যাচাই করা তো দূরের কথা, বই কতো কপি বিক্রি হয়েছে তা জানতে চাইলেও প্রকাশক বড় ব্যথিত হন। অতি বড় প্রকাশকও দেখা যায় বছরে বই বিক্রির হিসাব দিতে পারেন না, যদিও প্রায় প্রতিটি বই বিক্রির রশিদ থাকার কথা এবং প্রকাশকের হিসাবরক্ষকও থাকার কথা। ব্যবসায়ীকে তো তার পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব রাখতেই হবে। প্রকাশক ব্যবসায়ী হিসাবে সে হিসাব রাখেনও, কিন্তু লেখককে দিতে বড় গড়িমসি করেন। 

এ সব কথার চেয়েও বড় কথা, প্রকাশক কখনোই সাহিত্য সস্পর্কে খোঁজ রাখেন না, যতোটা খোঁজ রাখেন লেখকের বাজার দরের। লেখক কতো বড় আমলা, অধ্যাপক, কর্পোরেট কর্তা প্রকাশক তার খোঁজ রাখেন বেশি। বিষয়টি প্রকাশকের জন্য দোষের নয়। বই বিক্রি করেই তো তাকে চলতে হয়। সাহিত্যের সেবা করলে তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক উন্নতি হবে না হয়তো। 

সাহিত্যের হিসাব দিয়ে ব্যবসা হয় না। বরং ফেসবুকে কার লাইক, শেয়ার কতো তার খোঁজ রাখা বই ব্যবসায়ীর জন্য, প্রকাশকের জন্য জরুরি। দিন শেষে, বই বিক্রির হিসাবটাই প্রকাশকের কাছে দরকারি। হুমায়ূন আহমেদ বড় লেখক কিনা, তার সাহিত্যমান অসাধরণ কিনা সেটা না-দেখেই প্রকাশকরা আগাম টাকা নিয়ে তার বাড়িতে চলে যেতেন। কারণ বাজারে হুমায়ূনের বই বিক্রি হয় দেদারসে। কাজেই বাজারের হিসাবটাই বই ব্যবসায়ীদের কাছে মুখ্য। তেমনটা হওয়া উচিত বই বাজারের হিসাবে। কিন্তু সাহিত্যের হিসাব? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? 

আবার সব বই তো সাহিত্য না। নানা পদের বই ছাপা হয়। এর মধ্যে পবিত্র কোরান শরীফ, পবিত্র গীতা বা বাইবেলের মতো গ্রন্থও এবং সে সব গ্রন্থের অনুবাদও প্রচুর ছাপা হয়। এ সব ধর্মীয় কিতাবকে কেন্দ্র করে আলোচনা, ব্যাখ্যা সম্বলিত বইও কম প্রকাশ হয় না। বলা দরকার, অন্য যে কোনো গ্রন্থের চেয়ে এ সব বই সচারাচর কম মূল্যে বিতরণ করা সম্ভব হয়। অবশ্য ধর্মগ্রন্থ অনেক সময় বিনামূল্যেও বিতরণ করা হয়। পাঠক বা ক্রেতার কাছে বিনামূল্যে পৌঁছালেও তার মূল্য ভর্তুকি আগেই কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পূরণ করে দিয়েছে। আবার এ সব ধর্মগ্রন্থের অনেক দামের রাজকীয় সংস্করণও হয়। কাজেই এগুলোর বিপণন, মুদ্রণ, বিতরণ পদ্ধতি আলাদা। আর এ সব ধর্মগ্রন্থ আমরা সচারাচর সাহিত্য সমালোচনার মূল আসরে আনি না। কারণ এগুলো অমূল্য, আসমানী। 

জমিনে উৎপন্ন বইয়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী রান্নার বই, বিশেষত রেসিপির একটা বড় বাজার আছে। বাংলাদেশেও রান্নার বই খুব চলে। কিন্তু আর যাই হোক এই বইকে সাহিত্য আসরে ঠাঁই দেওয়া যায় না। বাজারে তার যতো মূল্যই থাক, সাহিত্যে তা মোটেও মূল্যবান নয়।

আজকের দিনে এসে বইয়ের মূল্য যাই হোক তা দিয়ে ভেতরের মাল-মশলার বিবেচনা করা ঠিক হবে না। বিনা মূল্যেই কিনুন বা বহুমূল্যে কিনুন, আমরা কেউ কেউ আদতে বইকে পণ্য হিসাবে বিবেচনা করি না। বিশেষত আমরা যারা লিখি এবং লেখার জন্য পড়ি, বই কিনি তারা বইকে বিবেচনা করি পাঠ্যমান কিংবা সাহিত্যমানের দিক থেকেই। অবশ্যই প্রকাশক, মুদ্রাকর বা বই ব্যবসায়ী সে দিক থেকে বিবেচনা করেন না। প্রকাশক সাহিত্যসেবী নন। তাকে বই বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়। তাই বইয়ের কাগজ, ছাপা খরচ এবং বইটির সম্ভাব্য ক্রেতার সংখ্যাই প্রকাশকের বিবেচ্য। আবার বাংলাদেশে এমন প্রকাশকও আছেন যারা সাহিত্যের খোঁজ রাখার মতো যোগ্যও নন। তারা হয়তো বই বাঁধাই, বিপণন, ছাপাখানার কর্মী ইত্যাদি থেকে প্রকাশক হয়েছেন। তারা বইয়ের বাজার বোঝেন, সাহিত্য বোঝেন না। 

বইয়ের পাইকারি বা খুচরা বিক্রেতারা বইকে স্রেফ গায়ে লেখা দাম দিয়ে বিচার করেন। তবে আজকের দিনে এসে কোনো কোনো বই বিক্রেতা তার দোকানে উচ্চসাহিত্য মানসস্পন্ন বইও রাখেন। কারণ তিনি অন্য সব পণ্য বিক্রেতার মতো কেবল পণ্য বিক্রি করেন না। তারা বই বিক্রি করেন, যা পণ্য হলেও চিরন্তন আবেদন রাখতে পারে। তবে সবাই এক নন। সাধারণ একজন বই  প্রকাশক এবং বিক্রেতা প্রায়শই যে বইটি শত কিংবা হাজার কপি বিক্রি করেন সেই বইটিও তারা পড়ে দেখেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতরা বই পড়েন না। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি সম্ভবত এটাই। বইয়ের সঙ্গে জড়িত ৮০ ভাগ লোক (বাঁধাইকারী, মুদ্রাকর, ছাপাখানার লোক) অশিক্ষিত। প্রকাশকদের মধ্যেও বাংলাবাজার এলাকায় বহু প্রকাশক আছেন যারা বই পড়েন না, বা পড়ার যোগ্যতা রাখেন না। এরা আরামসে যার বই খুশি ছেপে দেয়। এরা দেদারসে শরৎ রচনাবলী কেটে ছোট করে দেয়, শেক্সপিয়র রচনাবলীর নামে শেক্সপিয়রের নাটকের সংক্ষিপ্ত গল্প ছেপে দেয় এবং ভারতের অনেক অনুবাদ গ্রন্থ অন্যের নামে চালিয়ে দেয়। 

তবে আশার কথা, চিত্রটা পাল্টাচ্ছে। একদল তরুণ শিক্ষিত প্রকাশক এসেছেন বইয়ের বাজারে। এরা চার্লস বুকোস্কির লেখার খোঁজ রাখেন, এরা কপিরাইট, লেখক সম্মানী ইত্যাদির চর্চাও করেন। হয়তো এমন দিন খুব দূরে নয় যে, আমাদের বই প্রকাশনায় সাহিত্য মূল্যটি বিবেচ্য হবে। আমি অন্তত দুচারজন তরুণ প্রকাশকদের চিনি যারা বই আর সাহিত্য দুটোই বোঝেন। বয়স অর্থে নয়, চিন্তার পরিধি বা মানসিকতায় যারা বুড়ো আর লেখক ও সাহিত্যের প্রতি অসৎ সেইসব প্রকাশকদের দিন হয়তো ফুরিয়ে আসবে ক্রমে। তরুণরা জাগছে। তারা খালি টাকার অঙ্ক দিয়ে রাজত্ব করবে না, তারা বাংলা সাহিত্যকে মূল্যায়ন করবে, করছে। 

জয় হোক সেই প্রকাশকের যিনি সাহিত্য বোধ নিয়ে এগুচ্ছেন। প্রকাশনার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তার হাতে আসুক।

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বইম ল বই বইয় র ম ল য বই ব ক র ব যবস য় বইয় র ব র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

সামারিক শক্তিতে মিয়ানমারের চেয়ে ২ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ

চলতি বছর সামরিক শক্তির দিক থেকে মিয়ানমারের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। চলতি সপ্তাহে সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার প্রকাশিত সূচকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সামরিক বাজেট। সেনাবাহিনীর আকার, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর শক্তিকেও বিবেচনা করা হয়েছে সমীক্ষায়।

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এরপরে পরে রয়েছে রাশিয়া, চীন, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। পরমাণু শক্তিধর হলেও পাকিস্তানের অবস্থান ১২ নম্বরে। তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৩৫তম অবস্থানে। বাংলাদেশের আগে রয়েছে উত্তর কোরিয়া ও আর্জেন্টিনা। আর বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমার রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৬ কোটি ৬১ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে মোট সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৬৩ হাজার। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৭ হাজার ৪০০ সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ২৫ হাজার ১০০ সেনা। 

অন্যদিকে, মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যা ৫ কোটি ৭৫ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। মিয়ানমারের সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার। মিয়ানমারের রিজার্ভ সৈন্য রয়েছে ২০ হাজার। দেশটির বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৫ হাজার সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ১৬ হাজার সেনা। 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ