চাহিদা অপেক্ষা বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অত্যধিক হইবার কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবিকে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র নামক এক প্রকার শ্বেতহস্তী পালন করিতে হইতেছে বলিলে ভুল হয় না। কারণ চুক্তি অনুযায়ী এই সকল কেন্দ্র হইতে বিদ্যুৎ ক্রয় না করিয়াও পিডিবিকে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। ফলে একদিকে গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায় অনাকাঙ্ক্ষিতরূপে, অন্যদিকে জনগণের উপর ইহার চাপ হ্রাসকল্পে ফি বৎসর ভর্তুকির পরিমাণ বর্ধমান। উদাহরণস্বরূপ, শনিবার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, বর্তমানে চাহিদা অপেক্ষা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশের অধিক; যদিও এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ২০ শতাংশ। ইহার ফলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বৎসরে ১ লক্ষ ৩৩ সহস্র কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেটস্থ হইয়াছে। সমস্যার এইখানেই ইতি ঘটে নাই। এই ক্রমবর্ধমান ব্যয় সামলাইতে সরকারকে উক্ত সময়ে অস্বাভাবিক হারে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করিতে হইয়াছে। দিন শেষে সরকারের ভ্রান্ত নীতির কাফফারা দিতে হইয়াছে সাধারণ জনগণকে। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ছিল প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৩ পয়সা, যাহা বর্তমানে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। যাহা অধিকতর উদ্বেগজনক, বিশেষজ্ঞদের মতে, আরও দুই যুগের অধিক সময় দেশবাসীকে এই ঘানি টানিতে হইবে।
এহেন পরিস্থিতির পশ্চাতে বিগত সময়ে বিদ্যুৎ খাতে সম্পাদিত অসম চুক্তি, ভ্রান্ত নীতি ও অনিয়ম দায়ী হইলেও সকল কিছুর মূলে ছিল উক্ত সরকারের ভয়াবহ স্বজনতোষণ নীতি। বিষয়টি সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ইতোপূর্বে বহুবার প্রকাশিত হইয়াছে, বিগত সরকারের সময় স্থাপিত প্রায় সকল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তাগণ ছিলেন হয় সরাসরি সরকারি দলের সহিত যুক্ত অথবা ঐ দলের আশীর্বাদপুষ্ট। উহাদের হীনস্বার্থেই একদিকে বিদ্যুতের চাহিদা না থাকিবার পরও নূতন নূতন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন পাইয়াছে, অন্যদিকে চুক্তির শর্তে রাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল রাখিয়া এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মানহীন যন্ত্রপাতিসম্পন্ন ও অস্বাভাবিক জ্বালানিখেকো বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হইয়াছে। শুধু উহাই নহে, রীতিমতো আইন করিয়া উক্ত অনিয়মকে সুরক্ষা দিবার প্রয়াসও চালাইয়াছে তৎকালীন সরকার। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়া সেই সকল অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি দফায় দফায় নবায়ন করা হইয়াছে।
বিগত সময়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আয়োজিত বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি-সংক্রান্ত একাধিক গণশুনানিতে আমরা বিশেষজ্ঞদের তথ্য-উপাত্ত সহকারে বলিতে শুনিয়াছি, অলস থাকা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিকে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান বন্ধের পাশাপাশি সিস্টেম লসরূপী চুরি প্রতিরোধ করিতে পারিলেই বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাসকরণ সম্ভব। এমনকি উক্ত উপায়ে ব্যয় সাশ্রয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে প্রতিবৎসর প্রদেয় ভর্তুকি হইতেও মুক্তি অসম্ভব নহে। কিন্তু সেই পথে হণ্টন না করিয়া উক্ত সরকার বরাবর লোকসান হ্রাসকরণের ‘সহজ’ পন্থাস্বরূপ মূল্য বৃদ্ধির অপ্রিয় সিদ্ধান্তই গ্রহণ করিত।
আমরা মনে করি, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের কল্যাণে বিদ্যুৎ খাতে জনবান্ধব নীতি-কৌশল অবলম্বনের সময় আসিয়াছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক বিগত সরকারের চুক্তি খতাইয়া দেখিবার জন্য জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি গঠনকে আমরা স্বাগত জানাইয়াছি। সমকালের সহিত আলাপচারিতায় কমিটির সদস্য এবং বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী যথার্থ বলিয়াছেন, কোনো পক্ষ ইচ্ছা করিলেই একটি চুক্তি বাতিল করা যায় না। তজ্জন্য যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ প্রয়োজন। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা হইতে মুক্তি যে সম্ভব– তাহা তিনি স্বীকার করিয়াছেন। বিশেষত পুরাতন ও অদক্ষ কেন্দ্র বাতিল, চুক্তি নবায়ন না করা, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নূতন কেন্দ্রের চুক্তি না করিয়া রিজার্ভ মার্জিন হ্রাসের ন্যায় যেই সকল পরামর্শ তিনি দিয়াছেন, সেইগুলির বাস্তবায়ন কঠিন নহে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত সরক র সরক র র হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
কালোবাজারির থাবা
বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বাজারে বিক্রয় হইবার বিষয়টি উদ্বেগজনক। সমস্যা এতই ব্যাপক যে, বুধবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান সত্ত্বেও বাজারে পুস্তক মিলিতেছে।
বস্তুত প্রায় প্রতি বৎসরই কালোবাজারে বিনামূল্যের পুস্তক বিক্রয় হইয়া থাকে। কিন্তু চলতি বৎসর অধিক হারে বিক্রয়ের কারণ হইল, শিক্ষার্থীদের বিপুলাংশের এখনও পাঠ্যপুস্তক হস্তগত হয় নাই। এই সুযোগে এক শ্রেণির কালোবাজারি স্বল্প বিনিযোগে অতি মুনাফার আশায় বেআইনিভাবে স্বীয় উদ্যোগে মুদ্রণ করিয়া পাঠ্যপুস্তক বিক্রয় করিতেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবির কার্যাদেশপ্রাপ্ত অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানও এহেন অপকর্মে লিপ্ত। উপরন্তু, অনেক অসাধু উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও অতিরিক্ত চাহিদা প্রদর্শনপূর্বক সংগৃহীত পাঠ্যপুস্তক কালোবাজারিদের নিকট বিক্রয় করিয়া দিতেছেন বলিয়া অভিযোগ উত্থাপিত হইয়াছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা প্রতি বৎসর বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরকারের তরফ হইতে পাইবার বিষয়টি একদিকে যদ্রূপ স্বস্তিদায়ক, তদ্রূপ শিক্ষার্থীদের জন্যও উদ্দীপকরূপে কার্যকর। তদুপরি, ইতোপূর্বে শিক্ষার্থীরা সাধারণত বৎসরের প্রথম দিবস বা মাসের প্রথমার্ধেই পাঠ্যপুস্তক হস্তগত করিতে পারিত। এইবার উহা সম্ভব হয় নাই বলিয়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এক প্রকার ব্যাকুলতার উদ্ভব হইয়াছে। ইহার সুযোগ লইতেছেন মুনাফালোভী পুস্তক ব্যবসায়ীগণ। ইহা সত্য, গত বৎসর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্বেকার শিক্ষাক্রম বাতিল এবং নূতন করিয়া পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন হেতু পুস্তক মুদ্রণে বিলম্ব ঘটিয়াছে। তবে এই বিষয়ে এনসিটিবির পক্ষ হইতে পরিষ্কার অগ্রিম ঘোষণা থাকিলে হয়তো এহেন পরিস্থিতি পরিহার করা সম্ভব হইত।
এনসিটিবি জানাইয়াছে, বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ নাই। বিষয়টি খতাইয়া দেখিতে এনসিটিবি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করিয়াছে। আমরা প্রত্যাশা করি, তাহারা প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করিতে সক্ষম হইবে। তবে কালোবাজারি বন্ধের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা জরুরি। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাইয়া কিছু পাঠ্যপুস্তক উদ্ধার করিলেও উহা হয়তো হিমশৈলের চূড়ামাত্র। সরকারের বিনামূল্যের পুস্তক যেহেতু কিন্ডারগার্টেনগুলি সহজে পায় না; অতিরিক্ত চাহিদার পুস্তক তাহাদের দেওয়া হয়। সেই কারণেই বিনামূল্যের পুস্তক বিক্রয় বন্ধে কেবল বাজারে অভিযান চালাইলেই হইবে না, বরং শিক্ষা প্রশাসনের কাহারা এই কালোবাজারির সহিত সংযুক্ত, তাহাদেরও চিহ্নিত করিতে হইবে। একই সঙ্গে যেই সকল মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ইহার সহিত সংশ্লিষ্ট, তাহাদের স্বরূপও উন্মোচন করিতে হইবে।
সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন শ্রেণির এক প্রস্থ পুস্তক বাজারে পাঁচ হইতে ছয় সহস্র টাকায় বিক্রয় হইতেছে। যেইখানে শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যেই সরকারিভাবে এই পুস্তক লাভ করিবার কথা, সেইখানে এইরূপ অবৈধ বাণিজ্যে কেবল শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে না; একই সঙ্গে সরকারে শুভ উদ্যোগেও কালো ছায়া পড়িতেছে। কালোবাজারিতে পুস্তক বিক্রয় বন্ধে তজ্জন্য অভিভাবকদের সচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরাও এই ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করিতে পারেন। বিশেষ করিয়া সকল পাঠ্যপুস্তক ইতোমধ্যে যেহেতু এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া হইয়াছে, সেইখান হইতে ডাউনলোড করিয়াও শিক্ষকরা পাঠদান করিতে পারেন। বাকি পাঠ্যপুস্তক যাহাতে দ্রুত সকল শিক্ষার্থীর নিকট পৌঁছানো যায় তজ্জন্য শিক্ষা প্রশাসনকে অধিক তৎপর হইতে হইবে। আমরা বিশ্বাস করি, সবাই আন্তরিক হইলে এতদিনে সকল পুস্তক পৌঁছানো কঠিন বিষয় ছিল না।
আগামী শিক্ষাবর্ষেও যাহাতে পাঠ্যপুস্তকের এহেন কালোবাজারি না হয়, তজ্জন্য এখন হইতেই তৎপরতার সূচনা আবশ্যক। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন, সংশোধনসহ সকল কার্য জুনের মধ্যেই সম্পাদন করা চাই, যাহাতে পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া মুদ্রিত পুস্তক ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
একই সঙ্গে আমরা ইহাও মনে করি, প্রতি বৎসর পুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের কর্মযজ্ঞ হ্রাসকল্পে পুস্তকের মান ও মুদ্রণ উন্নততর করা যাইতে পারে, যাহাতে দুই-তিন বৎসর একই পুস্তক বিতরণ সম্ভব হয়। ইহাতে অর্থেরও যথেষ্ট সাশ্রয় করা সম্ভব হইবে।