উপন্যাস বা চলচ্চিত্র—যেভাবেই হোক নামটা কম-বেশি সবারই জানা। অবধারিতভাবে এটি আছে ‘বইয়ের পোকা’দের পছন্দের তালিকায়। আর সৃজনশীলতার সঙ্গে এ অবধি সেলুলয়েডে বন্দী করা হয়েছে আমেরিকান ধ্রুপদি সাহিত্যের যত গল্পকাহিনি, সেগুলোরও অন্যতম এ উপন্যাস। পাঠক এতক্ষণে কয়েকটি নামের মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছেন। লেখকের নামই না হয় প্রথমে বলি, ফ্রান্সিস স্কট ফিটজেরাল্ড, যিনি স্কট ফিটজেরাল্ড নামে সমধিক পরিচিত। এখন যে কেউই বলতে পারবেন, মার্কিন এই ঔপন্যাসিকের অমর সৃষ্টি দ্য গ্রেট গ্যাটসবির কথাই বলা হচ্ছে।
১৯২৫ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম প্রকাশিত হয় এ উপন্যাস, প্রকাশনা সংস্থা স্ক্রিবনার। আজ প্রকাশের শত বছর পূর্ণ হচ্ছে উপন্যাসটির। এখনো এটি সমানভাবে আলোচিত, পাঠকনন্দিত এবং প্রাসঙ্গিকও বটে। তাহলে আর কী বাকি থাকে একটি বইয়ের ‘কালজয়ী’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের? থাকে না।
তবে অবাক করার বিষয়, ভূয়সী প্রশংসা ও ইতিবাচক পর্যালোচনার পরও শুরুর দিকে উপন্যাসটির বিক্রি ছিল হতাশাজনক। ত্রিশের দশক পেরিয়েও এর পাঠক ছিল সীমিত। ১৯৪০ সালের ২১ ডিসেম্বর মাত্র ৪৪ বছরে মারা যান স্কট ফিটজেরাল্ড। পরের বছর ১৯৪১ সালে স্ক্রিবনার নতুন করে বাজারে আনে দ্য গ্রেট গ্যাটসবি এবং এ পর্যায়ে দান উল্টে যায়। পণ্ডিত ও বিদগ্ধ পাঠকমহলে বিপুল সাড়া পড়ে। বিক্রি বাড়তে থাকে হু হু করে। যার ফল হয়েছে এই: বিশ শতকের কোনো মার্কিন ঔপন্যাসিকের লেখা বেশি পঠিত উপন্যাসের একটি দ্য গ্রেট গ্যাটসবি।
উপন্যাসটির পটভূমি আমেরিকার গত শতকের বিশের দশকের উত্তাল সময়, ডামাডোলপূর্ণ ‘জ্যাজ এজ’। এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘আমেরিকান স্বপ্ন’, প্রণয়, ধনসম্পদ ও নৈতিক অধঃপতনের এক নিটোল চিত্র, অনবদ্য দক্ষতায়।
উপন্যাসটি প্রথম পুরুষে বর্ণিত, তিনি নিক ক্যারাওয়ে। এই ইয়েল গ্র্যাজুয়েট মিডওয়েস্ট থেকে ওয়েস্ট এগে (কল্পিত স্থান) যান বন্ড ব্যবসার জন্য। তিনি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জে গ্যাটসবির বিশাল প্রাসাদের পাশে একটি ছোট বাড়ি ভাড়া নেন। কোটিপতি গ্যাটসবি বাইরের মানুষের কাছে অনেকটাই রহস্যাবৃত। তিনি জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি দেওয়ার জন্য সুপরিচিত। উপসাগরের ওপারে ইস্ট এগে (এটিও কল্পিত স্থান) থাকেন ক্যারাওয়ের কাজিন ডেইজি বুকানন ও তাঁর ধনকুবের স্বামী টম বুকানন।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্যাটসবি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে বিপুল ধনসম্পদের মালিক বনে যান। তাঁর সম্পদ ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন ‘আমেরিকান স্বপ্নে’র প্রতীক, কিন্তু গ্যাটসবির স্বপ্নের দুই পিঠেই রয়েছে ডেইজি, তাঁর প্রথম প্রেম। ডেইজি উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। গ্যাটসবি ধনকুবের হওয়ার পর ডেইজিকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে পড়েন, শেষ পর্যন্ত তাঁর এই বাসনাই ধ্বংস ডেকে আনে।
তবে গ্যাটসবি ও ডেইজির সম্পর্ককে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমায়িত করা যায় না, বরং এটি সমাজের শ্রেণিগত বিভেদ ও ‘বস্তুবাদী’ সমাজেরও প্রতীকী উপস্থাপন। অর্থাৎ উপন্যাসটিতে আমেরিকার সেই সময়ের সমাজচিত্রই প্রতিফলিত, যেখানে বিত্ত ও বিলাসিতা নৈতিকতাকে গ্রাস করে। ডেইজি ও টম স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, অন্যদিকে গ্যাটসবি স্বপ্নের পেছনে অন্ধভাবে ধাবমান। গ্যাটসবি খুন হওয়ার পর ক্যারাওয়েও নিজেকে গুটিয়ে নেন; কারণ, তিনি বুঝতে পারেন—এই জাঁকালো জীবনযাত্রায় চোখ ধাঁধানো আবরণ আছে, কিন্তু ভেতরে কিছু নেই—শাঁসশূন্য।
উপন্যাসটিকে উপজীব্য করে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯২৬ সালে, সেটি ছিল নির্বাক। এরপর ১৯৪৯ ও ১৯৭৪ সালে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া হয় এর কাহিনি। সবশেষ ২০১৩ সালে এটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ‘মৌলিন রুজ’-খ্যাত পরিচালক ব্যাজ লারম্যান। এতে গ্যাটসবি চরিত্রকে ‘জীবন্ত’ করে তুলেছে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর দারুণ অভিনয়। এক উপন্যাস নিয়ে চার-চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণও হতে পারে এর জনপ্রিয়তার আরেক ‘মানদণ্ড’। এ ছাড়া বহু নাটক তো মঞ্চস্থ হয়েছেই এর গল্প নিয়ে।
স্কট ফিটজেরাল্ডের লেখনশৈলী পদ্যময়, চিত্রময়। উপন্যাসে বর্ণিত ‘সবুজ আলো’, ড. একলবার্গের ‘চোখ’, ইস্ট এগ এবং ওয়েস্ট এগের মতো কাল্পনিক স্থান প্রতীকীভাবে গভীর অর্থ বহন করে। সবুজ আলো গ্যাটসবির আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, আর একলবার্গের চোখ যেন নৈতিকতার ‘দেবতাসুলভ’ পর্যবেক্ষণ। উপন্যাসের অসাধারণ সব বাক্যের গাঁথুনিতে মুগ্ধ হন পাঠক, তৃপ্ত হন সমালোচক। এ কারণেই অনেকেই বলে থাকেন, গল্পের জন্য নয়, বরং লেখনশৈলী ও গল্প বলার অনবদ্য কৌশলের জন্যই উপন্যাসটি ‘গ্রেট ক্ল্যাসিক’।
গ্যাটসবির ট্র্যাজেডি আমাদের শেখায়, প্রকৃত সুখের বসতিতে অর্থ ও মোহের ঠাঁই নেই। উপন্যাসটি আজও প্রাসঙ্গিক; কারণ, এটি মানুষের লাগামহীন লালসা, ‘আকাশ ছোঁয়া’র বাসনা ও পাথরকঠিন বাস্তবতার মধ্যে চিরন্তন দ্বন্দ্বের কথা বলে। দ্য গ্রেট গ্যাটসবি তাই শুধু উপন্যাস নয়, কালজয়ী জীবনদর্শনও বটে।