রাশমিকা যেভাবে ‘জাতীয় ক্রাশ’
সাফল্য দিয়েই কেউ তারকা হন, আবার কেউ হয়ে ওঠেন মহাতারকা। লাভ করেন মানুষের ভালোবাসা, জনপ্রিয়তা। সবটা ‘সাফল্য’কে কেন্দ্র করেই নির্ধারিত হয়। বলতে চাইছি, এ ক্ষেত্রে ‘সাফল্য আর সাফল্যের মাত্রা’ই একমাত্র নির্ধারক। তা ছাড়া পৃথিবীতে কর্ম দিয়ে যত সহজে কৃতি স্থাপন করা যায়, অন্য কোনো পথে তা সম্ভব হয় না। পাড়ার সংগঠন থেকে সাজানো-গোছানো করপোরেট অফিস, সুন্দর মঞ্চ এমনকি শিল্প-সাহিত্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনেও এই একই দৃষ্টিপাত এবং অসংখ্য দৃষ্টান্ত খুঁজে নিতে কষ্ট হবে না।
আজ ৫ এপ্রিল, তেমনই এক নারীর জন্মদিন। যে নিজের কাজ দিয়ে কেবল নিজের দেশ নয়, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে গেছেন। পৌঁছে গেছেন অগণিত মানুষের হৃদয়ে। তিনি আর কেউ নন ভারতের ‘জাতীয় ক্রাশ’খ্যাত অভিনেত্রী রাশমিকা মান্দানা। ভারতের ‘জাতীয় ক্রাশ’ হিসেবে যদিও তাঁকে অভিহিত করা হচ্ছে। তবে কেবল ‘ভারত’ই নয় বিশ্বের বহু দেশে তাঁকে দেখে, তাঁর সিনেমা কিংবা ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে তাঁর ছবি দেখে দর্শক বলে ওঠেন ‘হায়, মান্দানা!’
‘পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন তাঁর মধ্যে, কোনো কমতি নেই। হাসি, চাহনি সব ভয়ংকর সুন্দর, অতুলনীয়।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ছবি পোস্ট করে ভক্তদের অনেককে এভাবেই ভালো লাগা, ভালোবাসা প্রকাশ করতে দেখা যায়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।/ ওই-যে সুদূর নীহারিকা/ যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়,/ ওই যারা দিনরাত্রি/ আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি,/ তুমি কি তাদের মতো সত্য নও।’ ভক্তদের অনেকে রাশমিকাকে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ‘সত্যে’র মতো ‘সত্য’ও মনে করে থাকেন।
শুরুতে বলেছিলাম, ‘সাফল্য দিয়েই কেউ তারকা হন আবার কেউ হয়ে ওঠেন মহাতারকা। লাভ করেন মানুষের ভালোবাসা, জনপ্রিয়তা।’ তবে রাশমিকার ক্ষেত্রে কেউ কেউ বিষয়টা উপেক্ষা করতে চান। রাশমিকার জনপ্রিয়তার নেপথ্যে তাঁরা কেবল ‘সৌন্দর্য’কে দাঁড় করান। বিষয়টা নিয়ে সম্প্রতি কটাক্ষের স্বীকারও হয়েছেন অভিনেত্রী। কিন্তু সত্যিটা আসলে কী, রাশমিকা কেন এত জনপ্রিয়? আর কীভাবেই–বা ভারতের ‘জাতীয় ক্রাশ’ হয়ে উঠলেন তিনি?
যদিও কনফুসিয়াস বলেছেন, ‘সবকিছুরই সৌন্দর্য আছে, কিন্তু সবাই তা দেখতে পায় না।’ প্রকৃতপক্ষে এটিই সত্য, সৌন্দর্য মূলত উপলব্ধিরই বিষয়। কিন্তু হলে কী হবে, সমাজে, সংসারে বাহ্যিক সৌন্দর্যের মূল্য যে অসীম। সেই বাস্তবতা থেকেই তো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সৌন্দর্য হৃদয়ে প্রেম জাগ্রত করিয়া দেয় এবং প্রেমই মানুষকে সুন্দর করিয়া তোলে।’ তা ছাড়া চলচ্চিত্রজগতে নির্দিষ্ট শারীরিক গঠন থেকে শুরু করে নানা তকমা বিশেষ মূল্য পায়। তবে তকমাগুলোই শেষ কথা নয়। কারণ, তকমাগুলোকে থোড়াই কেয়ার করে চলচ্চিত্রশিল্পে ফুল ফুটিয়েছেন এমন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। আবার সব নির্দিষ্ট তকমা নিয়েও সফল হতে পারেননি এমন উদাহরণও আছে অনেক। তাই ‘সৌন্দর্য’ রাশমিকার জনপ্রিয়তার ‘একটি কারণ’ হলেও ‘একমাত্র কারণ’ দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, ‘রাশমিকা’ এই সাফল্য এক দিনে পাননি।
মডেলিং দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতাতেও অংশ নিতে থাকেন। ‘ক্লিন অ্যান্ড ক্লিয়ার ফ্রেশ ফেস অব ইন্ডিয়া’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে হয়ে যান এই ক্যাম্পেইনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। তারপর বেঙ্গালুরুর লামোড টপ মডেল হান্টে জেতেন ‘টিভিসি’ খেতাব। ভারতীর গণমাধ্যমের তথ্যমতে, এই প্রতিযোগিতায় নির্মাতা ও কলাকুশলীদের নজর কাড়তে সমর্থ হন তিনি। যে সূত্রে সুযোগ পান ‘কিরিক পার্টি’ চলচ্চিত্রে। ২০১৬ সালের কন্নড় সিনেমা ‘কিরিক পার্টি’ দিয়েই বড় পর্দায় তাঁর অভিষেক হয়। তেলেগু সিনেমায় নাম লেখান ২০১৮ সালে। অভিনয় করেন ‘গীতা গোবিন্দম’ চলচ্চিত্রে। অপেক্ষাকৃত কম বাজেটের এই সিনেমা সুপারহিট হয়। সিনেমাটিতে রাশমিকার বিপরীতে ছিলেন বিজয় দেবরাকোন্ডা। আজ দর্শকের কাছে রাশমিকা-বিজয় দেবরাকোন্ডা জুটি যে বিশেষ মূল্য পায়। ‘গীতা গোবিন্দম’ দিয়েই তাঁর শুরুটা হয়েছিল। রোমান্টিক–কমেডি জনরার এই সিনেমা তরুণ-তরুণীরা ভীষণভাবে গ্রহণ করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন মান্দানা-বিজয়। মান্দানা চলে আসেন দর্শকের কাছে, আলোতে। সাফল্যের পরশ পাথর তাঁকে যেন স্পর্শ করে। ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া কন্নড় সিনেমা ‘ডিয়ার কমরেড’ দিয়েও প্রশংসিত হন তিনি। এই সিনেমাতেও তাঁর বিপরীতে ছিলেন বিজয় দেবরাকোন্ডা। নারী ক্রিকেটার চরিত্রটিকে গল্পের আলোকে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরে মান্দানা আলোচিত হন। পরে তেলেগু সিনেমা ‘সারিলেরু নিকিভারু’, ‘ভীষ্ম’ ও তামিল সিনেমা ‘সুলতান’ দিয়েও ভালো সাড়া পান তিনি।
তবে ২০২১–কে মান্দানার ক্যারিয়ারের ‘বর দানে’র বছর বলা চলে। কেননা ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ দিয়ে রাশমিকা তুমুল পরিচিতি পেয়েছেন। অর্জন করে নিয়েছেন অগণিত মানুষের প্রিয় অভিনেত্রীর স্থান।
‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ ছিল পুষ্পার উত্থানের গল্প। সংগত কারণেই শ্রীবল্লীর অভিনয়ের জায়গা ততটা ছিল না। আর সেই আক্ষেপই যেন ‘পুষ্পা ২’ দিয়ে মিটিয়ে নিয়েছেন পর্দার শ্রীবল্লী, বাস্তবের রাশমিকা।
সন্দীপ রেড্ডির সিনেমা ‘অ্যানিমেলে’র কথাও বলতেই হবে। সিনেমাটিতে ‘গীতা’ চরিত্রে নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে গেছেন রাশমিকা। তা ছাড়া ‘ছাবা’, সিনেমাটি তো বক্স অফিসের রেকর্ড ওলট–পালট করে দিয়েছে। সম্ভাজি মহারাজের স্ত্রী মহারানি ইয়েসুবাইয়ের চরিত্রে আলো ছড়িয়েছেন এই অভিনেত্রী।
তাই এই কথা বলতে কোনো রাখঢাক নেই যে নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রে নয়, বরং সব চরিত্রেই সহজ-সাবলীলভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারেন রাশমিকা। তাঁর লুকগুলো যেমন কৃত্রিমতাবর্জিত। এক্সপ্রেশনও তেমন সহজ সুন্দর। তাই তো তিনি একটা হাসি দিলেই তরুণদের হৃদয়ে ঢেউ খেলে যায়। আর এ কারণেই তিনি ভারতের ‘জাতীয় ক্রাশ’ হয়ে উঠতে পেরেছেন।
সেই সঙ্গে একটা প্রশ্নও চলে আসে, কেবল সৌন্দর্য দিয়ে এত বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়া কি সম্ভব?