পৃথিবীতে খারাপ মানুষ আছে—এটা বুঝতে পেরে অকালে ঝরেছে যে আর্জেন্টাইন প্রতিভা
‘সব সময়ের জন্য তোমার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল এটা বুঝতে না পারা যে পৃথিবীতে খারাপ মানুষও আছে।’
বড় ভাই মিরকো সারিচের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে লেখা আবেগমথিত চিঠিতে এ কথা লিখেছেন মার্টিন সারিচ। মার্টিন বোঝাতে চেয়েছেন, মিরকো এতটাই সৎ ও ইতিবাচক মানসিকতার মানুষ যে কখনো বিশ্বাসই করতে পারতেন না, কেউ খারাপ হতে পারে বা কারও মন্দ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সরলতা ও বিশ্বাসই ছিল তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
দুই ভাই–ই ছিলেন ফুটবলার। দুজনই মিডফিল্ডার। বয়সে এক বছরের বড় ভাইয়ের সঙ্গে আর্জেন্টিনার ক্লাব সান লরেঞ্জোর বয়সভিত্তিক দলে মার্টিনের বেড়ে ওঠা। কিন্তু ভাইয়ের মতো নাম কামাতে পারেননি। আর্জেন্টাইন ফুটবলে এখনো তাঁর ভাইকে স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অনেকেই।
সেই সময়ে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিময় তরুণ ফুটবলারদের একজন হয়ে উঠেছিলেন মার্টিনের ভাই মিরকো। আর্জেন্টিনা তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল। এই ছেলে দেশের খ্যাতি বয়ে আনবে, ইউরোপে নাম কামাবে—এমন সব আলোচনা হতো তাঁকে ঘিরে।
কিন্তু স্বপ্ন পূরণ করতে কিছু সময় তো লাগবে। দুর্ভাগ্য, মিরকো সারিচ নিজেকে সেই সময়টুকু দেননি। তাঁর ভাই মার্টিনের লেখা চিঠির সেই বাক্য ধরেই বলা হয়, পৃথিবীতে খারাপ মানুষও আছে—মিরকো এটা বুঝতে পারার পরই আত্মহত্যা করে বসেন মাত্র ২১ বছর বয়সে!
আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে ক্রোয়াট মা–বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া মিরকো দেখতে সুদর্শন ছিলেন। আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম ক্লারিনের ভাষায়, অসাধারণ ফুটবলার তো ছিলেনই, পাশাপাশি তাঁকে দেখে মনে হতো, এইমাত্রই কোনো বড় ব্র্যান্ডের মডেল হিসেবে মঞ্চে ক্যাটওয়াক শেষ করে এলেন।
সংবাদমাধ্যমটি এ নিয়ে একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। সেটা নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক। সান লরেঞ্জোর ড্রেসিংরুম থেকে বের হচ্ছিলেন মিরকো। সবাই তাঁর কুশলাদি জিজ্ঞেস করছিল, মিরকো ধৈর্য ধরে সবার প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছিলেন। অনতি দূরে কিছু ভক্ত, যাঁরা ড্রেসিংরুমের আশপাশে যেতে পেরেছিলেন। সেখান থেকে একচিলতে দীর্ঘশ্বাসের শব্দও পাওয়া গেল। মিরকোরই বয়সী সান লরেঞ্জোর পাঁড়ভক্ত প্রেমিককে তাঁর প্রেমিকা বলছে, ‘দেখেছো, মিরকো কতটা আবেদনময়!’ প্রেমিকটির কণ্ঠে ফুটল হাল ছেড়ে দেওয়ার হতাশা, ‘তাহলে...হ্যাঁ।’
আর্জেন্টিনার শীর্ষ লিগের দল লরেঞ্জোয় ছিলেন ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। খেলেছেন আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২৩ দলেও। সান লরেঞ্জোর হয়ে ৪১ ম্যাচে ৪ গোলের পরিসংখ্যান দিয়ে মিরকোকে বোঝা যায় না। যদিও আর্জেন্টিনার সাময়িকী এল গ্রাফিকোর দাবি, মিরকো ৫২ ম্যাচে ৫ গোল করেছেন। কিন্তু তাতেও তাঁর প্রতিভাটা ঠিক ফুটে ওঠে না।
১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে রিভার প্লেটের বিপক্ষে বাঁ পায়ের লিগামেন্টে মারাত্মক চোট পান মিরকো। মৃত্যুর আগপর্যন্ত আর মাঠে ফেরা হয়নি। সেই চোটের আগে সান লরেঞ্জোর তৎকালীন কোচ অস্কার রুগেরির সঙ্গে পজিশন নিয়ে বনিবনা ছিল না। সে জন্য বেঞ্চেও বসে থাকতে হয়।
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কা ঘটনাটা জানিয়েছে রুগেরির মুখে, ‘একদিন সে আমার দরজায় এসে বলল, কথা বলতে পারি? আমি কী প্রত্যাশা করেছিলাম? সে বলবে, “বাঁ প্রান্তে খেলতে ভালো লাগে না।” কারণ, আমি তাকে বাঁ প্রান্তে খেলাই। ঠিক জানি না...বিছানায় আমি বসার পর সে বলল, “আমি জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পাই না”—ঠিক এভাবেই একদম হঠাৎ করে।’
কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের টগবগে সময়ে থাকা কোনো যুবকের মুখে জীবনের অর্থ খুঁজে না পাওয়ার কথা শুনলে একটু খটকা লাগাই স্বাভাবিক। রুগেরিরও সেদিন লেগেছিল। মাঠের মাঝখানে খেলার ইচ্ছা ছিল মিরকোর, ওটাই তাঁর পজিশন।
রুগেরি তা জানতেন। কিন্তু শুধু খেলার পজিশন পাল্টে যাওয়ায় কুড়ি ছোঁয়া কোনো তরুণ জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে না, তা হয় না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো সমস্যা! রুগেরি তেমন ভেবেই মিরকোকে বুঝিয়েছিলেন, ‘তোমার মা–বাবা আছে, ভাই আছে, বন্ধুরাও আছে। দলের সবাই তোমাকে ভালোবাসে। তুমি ফুটবল খেলো। চুক্তিপত্রে সইও করেছ। এসবই তো তোমার চাওয়া।’ মিরকো উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি এসব নিয়ে ভাবছি না।’
মিরকোর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে রুগেরি খুব বেশি জানতেন না। তাঁর বাবাকে ফোনে সবকিছু জানান ’৮৬ বিশ্বকাপজয়ী সাবেক এই ডিফেন্ডার। কোচকে বাবা আশ্বস্ত করেন এই বলে, ‘চিন্তা করবেন না। সে মনোবিদের অধীন আছে।’ কিন্তু সবাই ভুল ছিলেন। রুগেরিকে জীবনের অর্থ খুঁজে না পাওয়ার কথাটি বলার কয়েক দিন পরই অপ্রত্যাশিত সেই কাজ করে বসেন মিরকো।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন? উত্তরটা মর্মন্তুদ। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে মিরকোকে নিয়ে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখতে হয়। তাঁর খেলার ধরনের সঙ্গে ফের্নান্দো রেদোন্দোর মিল ছিল। এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোকেও মেলান কেউ কেউ।
১৯৯৬ সালের ২২ ডিসেম্বর সান লরেঞ্জোর মূল দলে অভিষেকের পর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রায় নিয়মিতই খেলেছেন মিরকো। পরের বছর ছিল তাঁর ক্যারিয়ারেই সেরা। কিন্তু সে বছরই লিগামেন্টের সেই চোট এবং রিয়াল মাদ্রিদে যোগদানের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েন মিরকো। রিয়ালে তখন রেদেন্দো থাকতেও হয়তো তাঁর মতো আরেকজনকে পেতেই মিরকোর জন্য ১ কোটি ডলার সেধেছিল মাদ্রিদের ক্লাবটি।
সান লরেঞ্জো রাজি হয়নি। মিরকোর মতো প্রতিভাবানের জন্য তারা ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দলবদলটি হয়নি। এমনকি পায়ের চোটে ভোগার সময় মায়োর্কা তাঁর জন্য ৫০ লাখ ডলার সেধেছিল। সেই দলবদলও ভেস্তে যায়।
শুধু প্রত্যাশিত দলবদল না হওয়ার হতাশায় মিরকো সেই অপ্রত্যাশিত কাজই করেছিলেন, তা ভাবলে ভুল হবে। মিরকোর জীবনে আরও বড় ও গভীর ক্ষত ছিল। সেদিন সেই ক্ষতের কথাই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন রুগেরিকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গাড়ি দুর্ঘটনার শিকারও হয়েছিলেন মিরকো। অন্য এক গাড়ির সঙ্গে সংর্ঘষ হয়েছিল।
তাঁর ভাই মার্টিনের ভাষায়, ‘মিরকো অবিচার সইতে পারত না। একবার সে বাবার গাড়ি নিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছিল। অন্য গাড়িটির চালক, যে জানত সে সান লরেঞ্জোর খেলোয়াড়, তার গাড়ির ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আঘাত পাওয়ায় মামলাও করে। আমার ভাই এসব বিশ্বাসই করেনি। সে এসব বুঝত না। দিনের পর দিন দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছে।’
মিরকো যেদিন সকালে আত্মহত্যা করলেন, সেদিন অনুশীলনেও যাননি, সেই দুর্ঘটনার মামলায় সেদিন আদালতে তাঁর হাজির হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তত দিনে গাড়ি দুর্ঘটনার চেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে তাঁর মনের ভেতরে। কুরে কুরে খেয়েছে বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে।
বুয়েনস এইরেসের ফ্লোরেসে মা–বাবার সঙ্গে থাকতেন মিরকো। সেখানে তাঁর এক প্রেমিকা ছিলেন। প্রায় এক বছরের প্রেম, মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার পর বন্ধুবান্ধব ও পরিবারকে খবরটি জানিয়েছিলেন মিরকো। হবু বাবাকে প্রচুর উপহারসামগ্রীও দিয়েছিল তাঁর স্কুলজীবনের বন্ধুরা।
কিন্তু ধীরে ধীরে মিরকো ও তাঁর মায়ের মনে একটি সন্দেহ চেপে বসে। মিরকো সন্তানের আসল বাবা নন! কারণ, মেয়েটির অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার সময় মিরকো আর্জেন্টিনার বয়সভিত্তিক দলের হয়ে জাপানে ছিলেন। মা ইভানার পরামর্শে নিজের ও সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষা করান মিরকো।
ফল? নেতিবাচক, অর্থাৎ প্রেমিকার গর্ভের সন্তানোর বাবা মিরকো নন! এরপরও মেয়েটির সঙ্গে মিরকো দেখা করেছেন। মায়ের সন্দেহ ছিল, তাঁর ছেলে সম্ভবত সেই মেয়ের সঙ্গে বসবাস করতে অন্য কোথাও বাড়ি কেনার কথা ভাবছেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেও মেয়েটির সঙ্গে দেখা করেছিলেন মিরকো। কিন্তু কিছুই তাঁকে ওই সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাতে পারেনি।
মায়ের বিশ্বাস, সন্তানটি তাঁর হলে মিরকো আত্মহত্যা করতেন না। ডিএনএ পরীক্ষার ফল মিরকো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। মার্টিনের ভাষায়, পরীক্ষার ফল জানার পর কেঁদে ফেলেছিলেন তাঁর ভাই। এরপর কাউকে কিছু টের পেতে না দিয়ে আত্মহত্যা করে বসেন।
অবশ্য ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। আত্মহত্যা করার আগের রাতে পরিবারের সবাইকে অনেক ভালো কথা বলেন মিরকো। মা জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর পরার কাপড়গুলো ইস্ত্রি করে রাখবেন কি না। মিরকোর জবাব ছিল, ‘যা খুশি করো।’
সকালবেলা ‘মিরকো, নাশতা প্রস্তুত’ বলে ডাকছিলেন মা। আসতে দেরি হওয়ায় ঘণ্টাখানেক পর তাঁর কামরায় গিয়ে মা দেখেন, ছেলে জিমন্যাস্টিকসের বারের সঙ্গে বিছানার চাদর পেঁচিয়ে ঝুলে আছেন! তাঁর বোন মিরনা জিমন্যাস্টিকসের সেই বারে অনুশীলন করতেন, মিরকো নিজেও অনুশীলন করতেন। সেটাকেই শেষ সম্বল বানিয়ে ফাঁস নেন মিরকো।
এখনকার ৪৫ বছর বয়সী মার্টিন সেদিন ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলেন প্যারাগুয়ের লুকু থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে ট্যাক্সিতে বসে। বুয়েনস এইরেস যাবেন। এমন সময় ট্যাক্সিচালক জানতে চান, ‘তোমার ভাই আত্মহত্যা করল কীভাবে?’ মিরকোর মৃত্যুর পর তাঁর ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া শুনুন তাঁর মুখেই, ‘অফিসে প্রায় সবকিছু ভেঙে ফেলেছিলাম। তাদের পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। আমার বিশ্বাস হয়নি।’
ক্রোয়াট ঐতিহ্য হলো সন্তানের একটি নাম রাখা, সঙ্গে যুক্ত হয় বাবার নাম বা পারিবারিক পদবি। কিন্তু মার্টিন তাঁর সর্বকনিষ্ঠ আট বছর বয়সী সন্তানের ক্ষেত্রে এই ঐতিহ্য মানেননি। নাম রেখেছেন লুকা মিরকো!
সন্তানের ভেতর ভাইকে এভাবে বাঁচিয়ে রাখলেও আজ সম্ভবত মিরকোকে মার্টিনের একটু বেশি করেই মনে পড়বে। আজ যে সেই দিন—মিরকো আত্মহত্যা করেছিলেন ২০০০ সালের ৪ এপ্রিল।