চন্দ্রিমা আর জিয়া নামের চক্কর, ১৫ বছরের অবহেলার পর এখন সংস্কার উদ্যানে
চন্দ্রিমা আর জিয়া নামের চক্করে ঘুরপাক খেয়েছে এই উদ্যান। বারবার নাম বদলালেও বদলায়নি উদ্যানের পরিবেশ। হয়নি সংস্কার ও উন্নয়ন। তবে সবশেষ নামবদলের পর গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে দেখা গেল, উদ্যানে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধি কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে দেবে যাওয়া মাটি পুনর্ভরাটের কাজ চলছে। শেওলা জমে থাকা কমপ্লেক্সকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে। উদ্যানটির আরও কিছু জায়গায় সংস্কার করছেন শ্রমিকেরা।
জিয়া উদ্যান জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাড়ে ১৫ বছর অবহেলা-অযত্নে ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উদ্যানটির নাম চন্দ্রিমা থেকে বদলে যেমন জিয়া উদ্যান হয়েছে, তেমনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের সুনজরও পড়েছে।
জিয়া উদ্যানে নিয়মিত যাঁরা হাঁটাহাঁটি করতে যান, তাঁরা বলছেন, তাঁদের আশা, উদ্যানটি রমনা পার্কের মতো সাজানো-গোছানো, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ হবে। সেখানে নগরবাসী সময় কাটাতে যেতে পারবেন। কোনো উৎপাতের মুখে পড়তে হবে না।
জিয়া উদ্যানের কাছেই মণিপুরিপাড়ায় বাস করেন মেসবাহ উদ্দিন। নিয়মিত তিনি জিয়া উদ্যানে হাঁটতে যান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি কর্তৃপক্ষের উচিত উদ্যানটিকে সুষ্ঠু তদারকিতে নিয়ে আসা। রাজধানীতে এমন জায়গার খুব অভাব। দর্শনার্থীরা যাতে এখানে স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।’
জিয়া উদ্যানটি জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর পাশে। সংসদ ভবন এলাকায় খোলা জায়গা ও মাঠ থাকলেও তা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়, তবে সবাই যেতে পারেন জিয়া উদ্যানে।
চন্দ্রিমা আর জিয়া ঘুরেফিরে নামবদল
গণপূর্ত অধিদপ্তর সার্কেল ৩–এর ২০০১ সালের এক নথি থেকে জানা যায়, জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর পাশের উদ্যানটি একসময় ক্রিসেন্ট লেক পার্ক হিসেবে পরিচিত ছিল। যদিও কবে এবং কীভাবে স্থানটির নাম ক্রিসেন্ট লেক হয়, তা এই নথিতে নেই।
নথিতে বলা হয়েছে, ১৯৮৮ সালের ২০ ডিসেম্বর স্থাপত্য অধিদপ্তর নির্দেশে পার্কটির নামফলকে চন্দ্রিমা শব্দটি যুক্ত করা হয়।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি চন্দ্রিমা উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে জিয়া উদ্যান রাখা হয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে ওই বছর ২৪ অক্টোবর নাম আবার চন্দ্রিমা উদ্যান রাখে। নথিতে বলা হয়েছে, কাজটি করা হয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশে। এ–সংক্রান্ত কোনো লিখিত আদেশ পাওয়া যায়নি।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে পার্কটির নাম আবার জিয়া উদ্যান রাখে। ২০১০ সালের ৩ মার্চ তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার আবার জিয়া উদ্যানের নাম বদলে চন্দ্রিমা উদ্যান করে। সর্বশেষ ১৯ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জিয়া উদ্যান নামটি ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। ২০ মার্চ গিয়ে দেখা যায়, পার্কটিতে নতুন নামফলক বসানো হয়েছে।
জিয়া উদ্যানের নাম বারবার বদল, বিএনপির আমলে পার্কটিতে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া এবং আওয়ামী লীগ আমলে অবহেলার কারণ সেখানে থাকা জিয়াউর রহমানের কবরস্থান।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর প্রথমে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়েছিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। পরে সেখান থেকে তাঁর দেহাবশেষ তুলে এনে ২ জুন চন্দ্রিমা উদ্যানে সমাহিত করা হয়। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরকে কেন্দ্র করে পাঁচ বিঘা জমিতে সমাধি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৩ সালে কাজ শুরু হয়, চলে ২০০৭ পর্যন্ত।
বিএনপি সরকারের আমলে লেকের পাড় বাঁধানো হয় এবং একটি দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করা হয়। সেতুটি দিয়ে জিয়াউর রহমানের কবরস্থানে সরাসরি যাওয়া যায়। সেতুটি চালু হয় ২০০৪ সালে।
আওয়ামী লীগ আমলে একাধিকবার জিয়াউর রহমানের কবর উদ্যান থেকে সরিয়ে নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল, স্থপতি লুই কানের নকশায় শেরেবাংলা নগর এলাকায় কবরস্থানের জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি। যদিও সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করেনি তখনকার সরকার।
সরেজমিন জিয়া উদ্যান
জিয়া উদ্যানের দক্ষিণ দিকে লেক, উত্তরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলনকেন্দ্র ও বাণিজ্য মেলার পুরোনো মাঠ, পশ্চিমে গণভবন ও পূর্বে বেগম রোকেয়া সরণি। উদ্যানটিতে নানা প্রজাতির গাছপালা রয়েছে।
২৩ মার্চ জিয়া উদ্যানে গিয়ে দেখা গেল, লেকে পানি খুবই অল্প। লেকের এক পাশে জমেছে প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেটসহ নানা আবর্জনা।
ঝুলন্ত সেতুর কাচগুলো ভাঙা ছিল, যা সম্প্রতি মেরামত করা হয়েছে। লেকের ভেতরে থাকা ঝরনার বেশির ভাগ অচল বলে জানান উদ্যানের উন্নয়নকাজে নিযুক্ত কর্মীরা।
উদ্যানের পশ্চিম পাশে ‘ফিটনেস’ ক্লাব চত্বর ও শৌচাগার রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শৌচাগারের পুরোনো টাইলস খুলে নতুন করে লাগানো হচ্ছে। পাশাপাশি শৌচাগার ব্যবহারের উপযোগী করা হচ্ছে। শরীর চর্চার এই চত্বরের দেয়ালে লেখা নাম ‘জিয়া ফিটনেস ক্লাব চত্বর’।
উদ্যানের পূর্ব পাশে গিয়ে দেখা যায়, বাগানের ভেতর খাবারের ঘর বা ক্যানটিনের জন্য নির্মিত একটি স্থাপনা এত দিন অযত্নে পড়েছিল। সেখানেও সংস্কারকাজ চলছে। উদ্যানে একটি গভীর নলকূপও বসানো হচ্ছে, যার মাধ্যমে উদ্যানে যাওয়া মানুষকে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হবে।
শেরেবাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি বেশ কিছু উন্নয়নকাজ হাতে নিয়েছেন তাঁরা। বিগত সরকারের সময়ে অনেক কিছু হয়নি। কিন্তু ৫ আগস্ট–পরবর্তী বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। দ্রুত এগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
হকারের উৎপাত ও ছিনতাই
জিয়া উদ্যান ঘিরে নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল। সেখানে হকারের উৎপাত ব্যাপক। ঘুরে দেখা যায়, উদ্যানের সীমানাবেষ্টনীর বিভিন্ন জায়গা ভাঙা। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা তা ভেঙে ফেলেছিল। তাঁরা আনসার ব্যারাকেও ভাঙচুর করেছিলেন।
উদ্যানের নিরাপত্তাকর্মী ও হাঁটাহাঁটি করতে যাওয়া লোকজন বলছেন, সন্ধ্যার পর পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠ ও তার আশপাশে ছিনতাইকারী ও বখাটেরা ওত পেতে থাকেন। ছিনতাইকারীরা অনায়াসে উদ্যানেও প্রবেশ করেন।
১ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত উদ্যান এলাকা থেকে অন্তত ১০ জন ছিনতাইকারীকে হাতে নাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে বলে জানান উদ্যানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘খুব যন্ত্রণায় আছি বাবা। এদিকে আসলে ওদিকে ক্ষতি হয়। প্রতিদিনই ঘটছে এসব।’