মিয়ানমারকে নিয়ে ট্রাম্প এখন কী করবেন

মিয়ানমারের সেনা প্রধান প্রেসিডেন্ট পুতিনকে উপহার দিচ্ছেন। মস্কো, মার্চ ৪, ২০২৫ছবি: রয়টার্স

সম্প্রতি মস্কো-ওয়াশিংটনের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক অক্ষ। আবার রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তার রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং গণতন্ত্রকামীরা আশঙ্কা করছেন যে যুক্তরাষ্ট্র তার মিয়ানমার নীতি নিয়ে মৌলিক পরিবর্তন আসতে পারে।

জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের আগে, যুক্তরাষ্ট্র ছিল জান্তা এবং স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের তীব্র সমালোচক এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলনের এক প্রধান সমর্থক। এখন, ট্রাম্প প্রশাসন সেসব সমর্থন বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সংবাদমাধ্যমের জন্য একটি বড় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। থাই সীমান্তে থাকা মিয়ানমারের যে শরণার্থী একসময় আমেরিকার সহায়তা পেত, তারা এখন যেন এক মৃত্যুকূপে পড়ে আছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প কি আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলকে কাজে লাগানো শুরু করবে নিজের প্রয়োজনে? কাউন্সিলকে যদি আমেরিকা একঘরে করতে চায় তাহলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চীনের দিকে চলে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী মানুষেরা, স্বাধীন সাংবাদিকেরা এবং সিভিল সোসাইটির কর্মীরা যতটা সম্ভব প্রতিকূলতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন বন্ধ করে দেবে। তা হয়তো হবে তাদের এক নতুন মিয়ানমার নীতি গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ। এর জন্য হয়তো আমেরিকা কাউন্সিলকে চীন থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য যা প্রয়োজন তাই করবে।

ট্রাম্প তো মনে করেন তিনি বিভিন্ন পক্ষকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে অত্যন্ত দক্ষ। নিজেকে তিনি বলেন ‘ডিলমেকার’। যদিও এখন পর্যন্ত তাঁর বিশেষ কোনো সফলতা দেখা যায়নি। উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং-উনকেও ট্রাম, তাঁর ভাষায় ‘এনগেজ’ করতে চেয়েছিলেন। এখন মিয়ানমারের কাউন্সিলের মিন অং হ্লাইংয়ের মতোই কিম জং-উন আন্তর্জাতিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। আর ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাঁর ট্রাম্পের ‘ডিলমেকিং’ করতে গিয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের জনগণের জন্য আরও লোকসানের হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন যা ঘটবে, তা স্পষ্ট করে অনুমান করার উপায় নেই। তবে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী মানুষেরা, স্বাধীন সাংবাদিকেরা এবং সিভিল সোসাইটির কর্মীরা যতটা সম্ভব প্রতিকূলতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন বন্ধ করে দেবে। তা হয়তো হবে তাদের এক নতুন মিয়ানমার নীতি গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ। এর জন্য হয়তো আমেরিকা কাউন্সিলকে চীন থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য যা প্রয়োজন তাই করবে। এর মধ্যে সম্ভবত তেল ও গ্যাসের মতো অর্থনৈতিক সুবিধাও থাকতে পারে।

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের রাজনৈতিক এজেন্ডায় কখনোই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ছিল না। এই কথা ট্রাম্পের মুখে পুতিনের প্রতি চরম প্রশংসা এবং ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি তাঁর শীর্ষ সহযোগীদের অশ্রদ্ধা দেখে পরিষ্কার বোঝা যায়।

২০০০-এর দশকের শুরুতে, তখনকার বার্মিজ জান্তা রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তারা হয়ে ওঠে রুশ সামরিক সরঞ্জাম কেনার এক বড় ক্রেতা। জান্তা এই পদক্ষেপ নিয়েছিল মূলত চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য। তারপর থেকে বিশেষ করে ২০২১ সালে নেপিডোয় সংঘটিত অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং রাশিয়ার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। মিয়ানমারের শাসকেরা একাধিকবার ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

গত মার্চ মাসের শুরুতে মিন অং হ্লাইং রাশিয়া সফরের সময় পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মিয়ানমারে একটি ছোট আণবিক প্ল্যান্ট নির্মাণের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন জানায়, এই প্ল্যান্টটির ক্ষমতা ১০০ মেগাওয়াট হবে। পরে এর ক্ষমতা তিন গুণ বৃদ্ধি করার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার ও রাশিয়া দাওইতে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ সহযোগিতা নিয়ে স্মারকলিপি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে একটি বন্দর এবং তেল শোধনাগার নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এটি পরিষ্কার, মিয়ানমারে রাশিয়ার সংযুক্তি শুধু অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে নয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার প্রভাব এশিয়ায় কমে যায়। সোভিয়েত যুগের পুরোনো মিত্র রাষ্ট্রগুলো—লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া—নতুন বিদেশি বন্ধু খোঁজে। পরে পুতিন সোভিয়েত যুগের পুরোনো গৌরব পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। সেই হিসেবেই এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মস্কোর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য এশীয় মিত্র। ট্রাম্প এমন কোন শক্তিকে সমর্থন করবেন, যারা মিয়ানমারে সেনাশাসনের অবসান দেখতে চায়, তার সম্ভাবনা কম।

ট্রাম্পের সম্পর্ক রাশিয়ার সঙ্গে মজবুত। ১৯৮৪ সাল থেকে তা শুরু হয়েছে ডেভিড বোগাটিন নামক একজন ব্যক্তি যখন ট্রাম্প টাওয়ারে গিয়ে ৬ মিলিয়ন ডলার নগদ রেখে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বোগাটিন ছিলেন রুশ মাফিয়ার সঙ্গে যুক্ত। যখন কোনো আমেরিকান ব্যাংক ট্রাম্পকে ঋণ দিচ্ছিল না, তখন রাশিয়া এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর ধনী ব্যক্তিদের বিনিয়োগ তাঁকে বাঁচিয়েছে।

আরও পড়ুন

২০১৮ সালের জুলাইয়ে হেলসিংকিতে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগে তিনি নিজের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কথা বিশ্বাস করেন নাকি পুতিনের। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি তো এ রকম কিছু ঘটার কোনো কারণ দেখি না।’ তিনি আমেরিকার নিজের ফেডারেল সংস্থাগুলোর চেয়ে পুতিনের ওপর বেশি আস্থা রেখেছিলেন।

২১ ফেব্রুয়ারি পলিটিকো নামের স্বনামধন্য একটি মার্কিন ডিজিটাল সংবাদপত্র এমন ২৯টি ঘটনার তালিকা করেছে, যেখানে ট্রাম্পের প্রশাসন এমন বক্তব্য এবং পদক্ষেপ নিয়েছে, যা সরাসরি পুতিনের সুবিধার জন্য নেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প পুতিনের ইচ্ছা মেনে ইউক্রেনে ন্যাটো মিশন না পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে অবমাননা করেন, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শান্তি আলোচনা থেকে বাদ দেন। এর পরিবর্তে, সৌদি আরবে রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে শর্তবিহীন বৈঠক করেন।

তারপর এল এক বিস্ফোরক ঘোষণা। ৭ মার্চ ট্রাম্প সবাইকে চমকে দিয়ে বলেছিলেন, যদি পুতিন ইউক্রেনের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি না করেন, তাহলে তিনি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং শুল্ক আরোপের বিষয়টি ভাবছেন। কিন্তু সমালোচকেরা ওই হুমকিগুলোকে নিছক ফাঁকা হুমকি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ট্রাম্প যখন ওই হুমকিগুলো দেন, তার কয়েক ঘণ্টা পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান যে তিনি পুতিনের ওপর বিশ্বাস রাখেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প এবং তাঁর প্রতিনিধি জে ডি ভ্যান্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে, জেলেনস্কি যখন হোয়াইট হাউসে লজ্জাজনক অভ্যর্থনা পান, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাজা কালাস প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, ‘আজ, এটি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে মুক্ত বিশ্বের নতুন একজন নেতা প্রয়োজন। আমাদের, ইউরোপীয়দের, এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।’

কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন সত্যিই কি যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁকা জায়গা পূর্ণ করতে পারবে? ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত সম্পদ নেই। এই বিশ্বব্যাপী অনিশ্চিত সময়ে, এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী মানুষের সামনে আরও কঠিন সময় আসছে।

  • বার্টিল লিন্টনার সুইডিশ সাংবাদিক, লেখক

মিয়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতী থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ।