আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি: নীনার এ কথা শুনে কী বলেছিলেন ভিভ রিচার্ডস
ভিভ রিচার্ডস-নীনা গুপ্তা; ক্রিকেট-বলিউডের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রেমকাহিনিটা সম্ভবত তাঁদের দুজনের। সর্বকালের সেরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সবচেয়ে বড় তারকা কীভাবে বলিউডের এক উঠতি অভিনেত্রীর প্রেমে মজলেন, কেমন ছিল তাঁদের যুগলজীবন, এ নিয়ে বহু গল্প লেখা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে, ভিভ-নীনাও বিভিন্ন সময় এ নিয়ে টুকটাক কথা বলেছেন সংবাদমাধ্যমে।
অবশেষে ২০২১ সালের জুনে প্রকাশিত হয় নীনা গুপ্তার আত্মজীবনী ‘সাচ কাহো তো’। যেখানে নিজের অভিনেত্রী হয়ে ওঠা, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার দিনগুলো, বলিউডে প্রযোজকদের সঙ্গে তিক্ত অভিজ্ঞতা, অল্প বয়সে প্রথম বিয়েসহ অনেক কিছু নিয়েই অকপট লিখেছেন নীনা। তবে ক্রিকেটপ্রেমীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে নীনার সেই বইয়ে ‘হাউ আই মেট ভিভিয়ান’ অধ্যায়টা। যেখানে ভারতীয় এই অভিনেত্রী লিখেছেন ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে তাঁর প্রেম ও ভিভের সন্তানের মা হওয়া নিয়ে।
কী লিখেছেন নীনা গুপ্তা
‘বাটওয়ারা’ সিনেমার শুটিংয়ের সময় জয়পুরের মহারানি আমাদের জন্য একটা পার্টি দিলেন। ওই পার্টিতে আমাদের সিনেমার অনেকে তো ছিলেনই, ছিলেন বলিউডের আরও অনেকে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ও। যাঁদের মধ্যে ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই সময়ের অধিনায়ক ভিভিয়ান রিচার্ডস।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল তখন ভারত সফর করছিল। আগের দিনই আমি ওদের একটা ম্যাচ দেখেছি।
আমি বরাবরই ক্রিকেটের পাগল ভক্ত। কলেজে পড়ার সময়ও যদি কোনো ম্যাচ থাকত, আমি ক্লাসে বসে কানে ট্রানজিস্টর রেডিও লাগিয়ে ধারাভাষ্য শুনতাম, স্কার্ফ দিয়ে মাথার চারপাশে মুড়িয়ে সেই রেডিও লুকিয়ে রাখতাম। ভাগ্য ভালো যে বেশির ভাগ ম্যাচই শীতকালে হতো, তাই কেউ আমাকে খুব একটা সন্দেহ করত না।
পার্টির আগের দিনই ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুর্দান্ত একটা ম্যাচ হয়ে গেছে। আমাদের দল সম্ভবত ১ বা ২ রানে হারিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। যখন সবাই আনন্দে চিৎকার করছিল, আমি শুধু ভিভিয়ান রিচার্ডসের প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম। হারের পরেও লোকটা কী শান্ত ও দৃঢ়! তবে তার চোখে অশ্রু ছিল। স্পষ্ট মনে আছে, জয়ের এত কাছাকাছি এসেও হেরে যাওয়ায় তার যে যন্ত্রণা, সেটা তখন আমিও অনুভব করছিলাম। আমার শুধু মনে হচ্ছিল, কী অসাধারণ মানুষ! লাইভ টেলিভিশনেও লোকটা আবেগ প্রকাশ করতে দ্বিধা করছে না।
সেই সন্ধ্যায় পার্টিতে আমি তাকে দেখলাম, তার সঙ্গে হাত মেলালাম এবং বললাম, ক্রিকেটের প্রতি তার আবেগ দেখে আমি কতটা মুগ্ধ। আমাদের দুজনের খুব দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ও ভারত ছাড়ার আগে আমরা আরও কয়েকবার দেখা করলাম।
কিন্তু সফর শেষ করে সে যখন অ্যান্টিগায় ফিরে গেল, ওই যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি তাকে মিস করতাম এবং অনেক সময় ধরে তার কথা ভাবতাম। আমরা ফোন নম্বরও বিনিময় করিনি, ফলে যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না। তা ছাড়া আমার শুটিং এবং তার খেলার ব্যস্ততার কারণে আমাদের দেখা করার সুযোগও কম ছিল।
তবে এ মহাবিশ্বের বোধ হয় নিজস্ব একটা পরিকল্পনা সব সময় থাকে। জীবন অনেক সময় এমনভাবে মোড় নেয়, যা কল্পনাও করা যায় না। আপনি ভাববেন, সবকিছু একভাবে ঘটবে, কিন্তু হঠাৎ একেবারে অন্য রকম কিছু ঘটে যায়।
একদিন দিল্লি এয়ারপোর্টে ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন হঠাৎ একটা মেরুন রঙের ঝলকানি চোখে পড়ল। তাকিয়ে দেখি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের খেলোয়াড়েরা লাউঞ্জে ঢুকছে। আমার বুকের ভেতর প্রচণ্ড জোরে ধকধক শুরু হলো। এবং ঠিক তখনই ভিভিয়ান রিচার্ডস আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
আমাদের আবার দেখা হয়ে গেল, তারপর শুরু হলো আমাদের সম্পর্ক—এবং বাকিটা, সবাই যেমন বলে, ইতিহাস।
এর পরের ব্যাপারগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। আমি অনুরোধ করব, আমার পাঠকেরা বুঝবেন, কেন এ নিয়ে বিস্তারিত বলতে চাইছি না। আমি এই অধ্যায়ের গভীরে যেতে চাই না, কারণ আমার মেয়েকে রক্ষা করতে চাই। আমাদের এই সম্পর্ক এবং আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সে বিষয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। তাই আমার নীরবতাকে যদি পাঠকেরা সম্মান করেন, কৃতজ্ঞ থাকব।
আমি ভিভিয়ানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি এবং আমি গর্ভ ধারণ করি।
তত দিনে সে আবার অ্যান্টিগায় ফিরে গেছে। আমি ভাবতে শুরু করলাম—এটা আমার জীবনে কী প্রভাব ফেলবে, আমার ক্যারিয়ারে? আমি কি এই সন্তানকে পৃথিবীতে আনব, নাকি গর্ভপাত করব?
তখন খুব বেশি মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারিনি, কারণ সংবাদমাধ্যমে খবরটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। আমি নিজেও পরিচিত একজন অভিনেত্রী, আর ভিভিয়ান তো আন্তর্জাতিক তারকা।
কাছের অনেকে আমাকে গর্ভপাতের পরামর্শ দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছিলেন, সিঙ্গেল মাদার হয়ে জীবনযাপন কঠিন হবে।
আমি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। কিন্তু একা থাকলে আমি নিজেকে শুধু একটি প্রশ্ন করতাম—তুমি কী চাও? তোমার কেমন লাগছে? উত্তর একটাই ছিল—আমি আনন্দে আত্মহারা!
আমি ছিলাম অসীম আনন্দে ভরা। মা হতে চলেছি, এটা ভেবেই আমি উচ্ছ্বসিত ছিলাম। তবে বুঝতে পেরেছিলাম, এটা শুধু আমার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে না, সন্তানের পিতারও সমান অধিকার রয়েছে এই সিদ্ধান্তে। তাই আমি একদিন ভিভিয়ানকে ফোন করলাম এবং দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম।
তাকে বললাম, ‘আমি গর্ভবতী। যদি আমি আমাদের সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে চাই, তাহলে তোমার কোনো আপত্তি আছে?’ ভিভিয়ান খুব খুশি হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই, তুমি যা চাও, সেটাই করো।’
নিশ্চিত হলাম যে আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
ভিভিয়ান সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল পাশে থাকার, যদিও সে সব সময় খেলার জন্য বিভিন্ন দেশে ছুটে বেড়াত আর তার সংসার ছিল হাজার মাইল দূরে। তারপরও আমাদের দারুণ কিছু সুন্দর মুহূর্ত কেটেছে। কেটেছে কিছু কঠিন সময়ও।
অনেক বছর ধরে মানুষ বলেছে, আমি নাকি তখন আবেগপ্রবণ ছিলাম, ভুল করেছি। কিন্তু যা-ই হোক না কেন, যত কষ্টই করেছি, যত সমালোচনাই শুনেছি, আমি সব সময় আনন্দিত ছিলাম। কারণ, আমি তখন অমূল্য রত্ন পেয়ে গেছি—আমার মেয়ে মাসাবা।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার, সবকিছুর চেয়ে বহুগুণ বেশি মূল্যবান।
পাঠকদের জন্য তথ্য
জেপি দত্ত পরিচালিত ‘বাটওয়ারা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৯ সালে, যেখানে নীনা গুপ্তার সঙ্গে অভিনয় করেছেন ধর্মেন্দ্র, বিনোদ খান্না, শাম্মী কাপুর ও ডিম্পল কাপাডিয়া। এর বছরখানেক আগে ভিভ রিচার্ডসের নেতৃত্বে চার টেস্ট ও সাত ওয়ানডের সিরিজ খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টেস্ট সিরিজটা ১-১ ড্র হলেও ওয়ানডে সিরিজে ভারতকে ৬-১ ব্যবধানে হারিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভারতের একমাত্র জয়টা ইডেন গার্ডেনে, নীনা গুপ্তা সম্ভবত সেটার কথাই বলতে চেয়েছেন। ভিভ-নীনার কন্যা মাসাবা গুপ্তার জন্ম হয় ১৯৮৯ সালের ২ নভেম্বর।