ইতালি পাঠানোর কথা বলে ৪৬ লাখ টাকা নেওয়ার পর চলে নির্যাতন, অবশেষে মৃত্যু
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার যুবক সজীব সরদারের (২৯) স্বপ্ন ছিল ইউরোপের দেশ ইতালি যাওয়ার। পরিবারও তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য যা কিছু ছিল প্রায় সবই বিক্রি করে দিয়েছেন। পরিবারটি আশা ছিল, ছেলে ইতালি পৌঁছে রোজগার করে একদিন সব ঠিক করে ফেলবেন। কিন্তু লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর দালালের নির্মম নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে সজীবের।
নিহত সজীব শিবচর উপজেলার নিলখী ইউনিয়নের বাগমারা এলাকার কৃষক চানমিয়া সরদারের ছেলে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে সজীবের মৃত্যুর খবর পান পরিবারের সদস্যরা।
নিহত ব্যক্তির স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে কারিগর হিসেবে কাজ করতেন সজীব। ছয় মাস আগে স্থানীয় এক দালাল সজীবকে ইতালি পাঠানোর স্বপ্ন দেখান। পরিবারও তাতে সম্মতি দেয়। অবশেষে দালালের সঙ্গে ১৬ লাখ টাকায় সজীবকে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার চুক্তি করে তাঁর পরিবার। পরে গত নভেম্বর মাসে স্থানীয় দালালের হাত ধরে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন সজীব। দালাল প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে তাঁকে লিবিয়া নেয়। লিবিয়া যাওয়ার পরই দালাল চক্রের হাতবদল হয়ে যান সজীব। লিবিয়ার দালালেরা সজীবকে আটক করে একটি বন্দিশালায় আটকে রাখে।
এরপর মাফিয়াদের হাতে সজীব জিম্মি হয়েছে, এমন কথা বলে স্থানীয় দালাল সজীবের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ বাবদ ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন। লিবিয়ার মাফিয়ারা তাদের চাহিদামতো টাকা না পাওয়ায় সজীবের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। সেই নির্যাতনের ভিডিও মুঠোফোনের মাধ্যমে সজীবের দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে টাকা না দেওয়া হলে মেরে ফেলার হুমকি দেয় দালাল চক্র। পরে সজীবের পরিবার বাধ্য হয়ে জমিজমা বিক্রি করে দুই দফায় মাফিয়াদের কথামতো ছেলের মুক্তির জন্য ৩০ লাখ টাকা প্রদান করেন। দালালের নির্যাতনের একপর্যায়ে সজীব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে লিবিয়াতে থাকা আরেক দালালের তত্ত্বাবধানে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে ওই দালাল সজীবকে অসুস্থ অবস্থায় লিবিয়ার একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে গতকাল বুধবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
আজ দুপুরে সজীবের গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, মৃত্যুর খবর শুনে প্রতিবেশীরা সজীবের বাড়িতে ভিড় করছেন। সজীবের স্বজনেরা আহজারি করছেন। ছেলের সঙ্গে হওয়া শেষ কথাগুলো বলছেন, আর বিলাপ করছেন মা জুলেখা বেগম। প্রতিবেশীরা অনেকেই তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
একদিন আগে মঙ্গলবার রাতে পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে সজীবের শেষ কথা হয়। অসুস্থ অবস্থায় সজীব শুধু তার মা-বাবার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। ছেলের সঙ্গে হওয়া শেষ কথা প্রসঙ্গে তাঁর মা জুলেখা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বাজান আমারে কইছে, লিবিয়ার মাফিয়ারা লোহার শিকল দিয়া বাঁইধা মারছে। ঠিকমতো খাওন দেয় নাই। বাজানের উঠে দাঁড়ানোর শক্তিডা পর্যন্ত নাই। বাজানে খালি আমার কাছে দোয়া চাইলো। আমি মনপ্রাণ ভইরা দোয়া করলাম। সকালে শুনি, আমার বাজান নাকি বাঁইচা নাই। আমার বাজানে মরতে পারে না। তোমরা ওরে আমার বুকে ফিরাইয়া দাও।’
সজীবের বাবা চানমিয়া সরদার বলেন, ‘আমার ছেলেকে দালাল বোরহান ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়া নিয়া মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দিছে। চার মাস আটকে রেখে মারধর করে। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। জমিজমা বিক্রি করে, মানুষের থেকে ধারদেনা করে মুক্তিপণের ৩০ লাখ টাকা দালালের হাতে দিছি। তবু ওরা আমার ছেলেডারে মারতে মারতে মাইরা ফালাইছে। অসুস্থ অবস্থায় গতকাল আমার ছেলে মরে গেছে। যারা আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাদের বিচার চাই।’
সজীবেরা তিন ভাই ও তিন বোন। ভাইয়ের মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তাঁর বড় বোন শামীমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘দালালকে দফায় দফায় ৪৬ লাখ টাকা দিয়েও ভাইকে বাঁচাতে পারলাম না। জমিজমা বিক্রি করে দিছে ওর জন্য। দালাল বোরহান আমাদের পথে বসিয়ে দিছে। আমরা দালালের বিচার চাই।’
এলাকাবাসী জানান, দালাল বোরহান ব্যাপারীর বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া এলাকায়। তিনিই প্রথমে ১৬ লাখ টাকা চুক্তিতে ইতালির নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লিবিয়া নেন। সেখান থেকে সরাসরি ইতালি নেওয়ার জন্য ‘গেম’ (ভূমধ্যসাগর পারি দেওয়ার নৌযাত্রা)-এর কথা বলে মাফিয়াদের কাছে সজীবকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। দুই দফা বিক্রি হন সজীব। মারধর করে দুই দফায় নেওয়া হয় ৩০ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে দালাল বোরহান ব্যাপারীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার চুক্তি ছিল লিবিয়া পর্যন্ত নেওয়ার। এরপর কী হয়েছে, আমি জানি না। আমাকে দায়ী করে কোনো লাভ নাই।’
এ ব্যাপারে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভীন খানম বলেন, ‘লিবিয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক যুবকের মারা যাওয়ার কথা শুনেছি। নিহত যুবকের পরিবার আমাদের কাছে যেকোনো সহযোগিতা চাইলে আমরা সেটা করব। এ ছাড়া মরদেহ আনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রতন শেখ বলেন, ‘নিহত যুবকের পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কোনো দালালকে অভিযুক্ত করে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি। তাঁরা অভিযোগ জানালে দালালের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’