সীমান্তে রাখাইন আর্মির সঙ্গে আরসার সংঘাত বাড়ছে, দাবি মিয়ানমারের গণমাধ্যমের

আরাকান আর্মিফাইল ছবি

দীর্ঘ ১১ মাসের লড়াই-সংঘাতের পর ২০২৪ সালের ৭ ডিসেম্বর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের ২৭০ কিলোমিটার এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। এরপরও স্বস্তিতে নেই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। প্রায় প্রতিদিন মংডুসহ রাজ্যের আশপাশের এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিদ্রোহী গোষ্ঠী ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য আরাকান আর্মি। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে হামলা চালিয়ে আরাকান আর্মি রাখাইনের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৩টির নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে সে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে।

সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যের অধিকৃত মংডু টাউনশিপে আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে মিয়ানমারের আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এর প্রতিক্রিয়ায় আরাকান আর্মি মংডুর অভ্যন্তরে আরসার ঘাঁটিতে হামলা চালাচ্ছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি টেকনাফ সীমান্তে নাফ নদীতে টহল বাড়িয়েছে। নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া বাংলাদেশি জেলেদের নৌকাসহ অপহরণের ঘটনাও ঘটিয়েছে।

গত কয়েক দিনে মিয়ানমারের কয়েকটি গণমাধ্যম ঘেঁটে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সংঘাত শুরুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমার থেকে পণ্য নিয়ে আসা সেখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, আরাকান বন্দর দখলের জন্য আরাকান আর্মি কয়েক দিন ধরে তৎপরতা চালাচ্ছে। সরকারি বাহিনীর বেশ কয়েকটি ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে তারা। আবার টেকনাফের বিপরীতে মংডুতেও আরাকান আর্মির সঙ্গে নতুন করে সংঘাতে জড়িয়েছে আরসা।

রাখাইন রাজ্যের গণমাধ্যম নারিনজারা নিউজে আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল বুধবার বিকেলে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিথুয়ের কাছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি এবং একটি নৌ ফাঁড়িতে আক্রমণ চালিয়েছে। নৌবাহিনীর সদর দপ্তরের কাছে সামরিক কাউন্সিলেও আক্রমণ করা হয়েছে। লড়াই তীব্র ছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ভারী কামান এবং ড্রোন থেকে গুলি চালানো হয়েছিল। প্রায় ২০ জন সামরিক কাউন্সিল সদস্যকে বন্দী করা হয়েছে।

মিয়ানমারের নারিনজারা নিউজে প্রকাশিত আরসা ও আরকান আর্মির সংঘাতের খবর
ছবি: সংগৃহীত

নারিনজারা নিউজের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজ্যের উত্তর মংডুতে আরাকান আর্মির সামরিক প্রশিক্ষণ প্যারেডে ম্রো সম্প্রদায়ের শত শত যুবক স্বেচ্ছায় অংশ নিচ্ছেন। উদ্দেশ্য, আরসার হামলা থেকে নিজেদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করা।’

এ ছাড়া ইরাওয়ার্দিসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘আরসা সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকা মুসলিম, আরাকানি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালাচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরসাকে সীমান্ত বরাবর অস্থিরতা সৃষ্টির নির্দেশ দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১৯ অক্টোবর বুচিডং টাউনশিপের খইউচৌধুরী গ্রামের উত্তর-পশ্চিমে আরসা বিদ্রোহীদের সঙ্গে আরাকান আর্মির বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছিল। তখন আরসার চারটি ঘাঁটি থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সরবরাহকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছিল।’

মিয়ানমারে চলমান অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গাশরণার্থী শিবিরেও। সেখানকার রোহিঙ্গা নেতারা মনে করছেন, রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। দীর্ঘ ৭ বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি রাখাইন রাজ্য থেকে ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে টেকনাফ-উখিয়ার আশ্রয়শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। এ নিয়ে আশ্রয়শিবিরগুলোতে নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খুবই জটিল আকার ধারণ করেছে। তা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জোর দিতে হবে। আজ সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের পরিস্থিতি খুবই জটিল। সেখানে সংঘাত চলছে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই একটি সমাধানের জন্য জোর দিতে হবে।’

এদিকে দুই দিনের সরকারি সফরে আগামীকাল শুক্রবার কক্সবাজারে আসছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সীমান্তে বিজিবির দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে যোগদানের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন, বিজিবিসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করবেন বলে কথা রয়েছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব আগামী ১৫ মার্চ উখিয়ার আশ্রয়শিবির পরিদর্শনে আসছেন। সেখানে রোহিঙ্গা নেতাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন। এ বিষয়ে নানা প্রস্তুতি চলছে। মিয়ানমার পরিস্থিতিও নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। নতুন করে সেখান থেকে কাউকে অনুপ্রবেশের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।