নারীর নিরাপত্তা সংকট ও প্রতিকার
সানজিদা জান্নাত পিংকি, গবি || রাইজিংবিডি.কম

একবিংশ শতাব্দীতে নারীরা সব ক্ষেত্রেই নিজেদের অবদান রাখছেন। কিন্তু রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত অনিরাপদ অভিজ্ঞতাগুলো যেন নিত্য সঙ্গী। শারীরিক, মানসিক, ও যৌন হয়রানির ক্রমবর্ধমান চিত্র উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। এ সমস্যার গভীরতা, কারণ ও প্রতিকারের উপায় নিয়ে কথা বলেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা।
নারী সামাজিকভাবে অনিরাপদ
২১ শতকে এসে নারীরা কতটা নিরাপদ, তা পত্রিকার পাতা উল্টালেই বোঝা যায়। এর বাইরেও শত শত দৃষ্টান্ত আমাদের অগোচরেই রয়ে যায়। যার প্রধান কারণ নারীর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। পুরুষের সঙ্গে তালমিলিয়ে নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রাখলেও চলার পথে রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত কিংবা বাস, ট্রেন, অটোরিকশা, দোকানপাটসহ প্রতিটা সেক্টরে নারী কি নিরাপদ?
নারীকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। কখনো ইভটিজিংয়ের শিকার, কখনো বা সংবেদনশীল স্থানে স্পর্শ, আবার কখনো ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের বলি হতে হয়। ফলে নারী মানষিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করে বেড়ায়; তৈরি হয় পুরুষ সমাজের প্রতি তার বিরূপ মনোভাব। যা তার মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত করে।
নারীর নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলায় প্রথমত, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে ইভটিজিংয়ের নেতিবাচক দিক তুলে ধরতে হবে। তৃতীয়ত, ধর্ষণ ও ইভটিজিংয়ের মতো কর্মকাণ্ডের জন্য আইনের শাসন ও যোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, নারী ও পুরুষের বৈষম্য দূর করে নারীর নিরাপত্তা বিধানে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি, নারীকেও তার আত্মরক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রতিবাদী হতে হবে।
(লেখক: শারমিন আক্তার, শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
নারীর নিরবতা অপরাধ বৃদ্ধি করে
যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে প্রতিনিয়তই নারীকে তার কর্মক্ষেত্র কিংবা বিভিন্ন কাজে বের হতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পথে-ঘাটে নারীদের নিরাপত্তাহীনতা, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা। আমাদের সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বললেও নিশ্চিত করতে পারেনি স্বাধীনতা, নিশ্চিত করতে পারেনি নিরাপত্তা। প্রতিনিয়তই যানবাহনে পথে-ঘাটে নারীরা অপ্রত্যাশিত ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ নারী পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যৌন হয়রানি শিকার। কেউ কেউ আবার ধর্ষণ ও খুনের শিকার।
গণপরিবহনের সামনে সারিতে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের জন্য আসন বরাদ্দ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেসব আসন পুরুষের দখলে থাকে। গণপরিবহনের অতিরিক্ত ভিড় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতা এর মূল কারণ। এর আরো একটি কারণ হলো নারীদের নিশ্চুপ থাকা।
গবেষণা দেখা গেছে, যৌন হয়রানির শিকার ৮১ শতাংশ নারীই নিশ্চুপ থাকেন। নারীর যৌন হয়রানি বন্ধে সবার আগে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। এছাড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিবহন শ্রমিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামর্থ্য বৃদ্ধিও প্রয়োজন। সেই সঙ্গে গণপরিবহন ও পথে-ঘাটে নারীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণই হতে পারে নারীদের যৌন হয়রানি ও অনিরাপত্তা মোকাবিলায় মূল হাতিয়ার।
(লেখক: সুরাইয়া ইসলাম স্বর্ণা, শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়)
সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা জরুরি
নারীদের জন্য চলার পথে নিরাপত্তা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। নারীরা প্রায়ই ইভটিজিং, যৌন হয়রানি ও বুলিংয়ের শিকার হন। ভিড়ের সুযোগে ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরের সংবেদনশীল স্থানে স্পর্শ করার মতো নিকৃষ্ট আচরণও ঘটে, যা একজন নারীর মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তাকে চরমভাবে ব্যাহত করে। এর ফলে নারীরা প্রতিনিয়ত এক ধরনের ভয় ও উদ্বেগের মধ্যে চলাচল করতে বাধ্য হন।
নারীদের ক্ষেত্রে এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে। এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা থেকে মেয়ে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মহিলা- কেউই রেহাই পান না। এই অনিরাপদ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং নিরাপত্তা জোরদার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে অপরাধীরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে সতর্ক থাকবে এবং প্রয়োজনে প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ হবে। দ্রুত হেল্পলাইন বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সাহায্য পাওয়ার সুবিধা থাকা উচিত, যা নারীরা সহজে ব্যবহার করতে পারবেন।
আত্মরক্ষার কৌশল শেখা নারীদের জন্য অপরিহার্য। সমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ বন্ধ নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য, স্কুল, কলেজ এবং কর্মস্থলে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো দরকার। প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নারীরা হয়রানির শিকার হলে সহজে অভিযোগ করতে পারেন এবং সুষ্ঠু বিচার পান। অপরাধীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহসিকতা ও সচেতনতা নারীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি, সমাজের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে নারীরা স্বাধীনভাবে ও নিশ্চিন্তে চলাচল করতে পারেন।
(লেখক: যুথী রানী, শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়)
নারীর নিরাপত্তাহীনতা সবখানে
বর্তমানে বেশিরভাগ নারীই বহির্মুখী। প্রতিদিনই তাদের যাতায়াত করতে হয় স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। এছাড়াও দেশের নারীদের একটা বড় অংশ যুক্ত আছেন গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি, ক্রমেই এ সংখ্যায় ভারী হচ্ছে। নারী চাকরিজীবী হোক, গৃহিণী কিংবা শিক্ষার্থী, প্রতিদিনই তাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে গণপরিবহন এবং শিকার হতে হচ্ছে শারীরিক-মানসিক-মৌখিক লাঞ্ছনার। অন্যদিকে, কে কি বলবে ভেবে প্রতিবাদের ভাষাটাই ভুলেছে সবাই।
একশন এইড বাংলাদেশ সাম্প্রতিক এক জরীপে বলছে, ৮৭ শতাংশ নারী বাস টার্মিনাল বা ট্রেন স্টেশনের মতো যায়গায় হয়রানির শিকার হয়েছেন। রাস্তায় ৮০ শতাংশ আর স্কুল কলেজের বাইরে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী। পরিবহনে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কর্মজীবী নারী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিপীড়িত নারীরা বাড়তি সম্মানহানির ভয়ে মূক থাকেন অথবা ঘটনাস্থান থেকে সরে যান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দুই-একটি ঘটনা সামনে এলেও তা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতোই। প্রতিদিন কর্মস্থলে যথাসময়ে পৌঁছানোর জন্য রীতিমতো পুরুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাস বা ট্রেনে উঠতে হয় নারীদের। পরিবহনে তোলার ছলে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের অভিযোগ রয়েছে গাড়ির সহকারীদের বিরুদ্ধে। গণপরিবহনে একাকী যাতায়াত নারীদের কাছে আজ অস্বস্তিকর ও অনিরাপদ এক ব্যবস্থা।
এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি আমজনতার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। গণপরিবহন নারীর একাকী পথচলায় অন্তরায় নয়, বরং হোক এগিয়ে চলার সহায়ক- এটাই আমাদের কাম্য।
(লেখক: ইমপিয়াত জাহান হাজারী ইফতি, শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়)
ঢাকা/মেহেদী