মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় তাঁর মার-এ-লাগো রিসোর্টে বসে দাবি করেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য কিয়েভই দায়ী।
এ ছাড়া ট্রাম্প ইউক্রেন ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নিয়ে আরও কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে। জেলেনস্কি একজন স্বৈরশাসক। তিনি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আছেন।
গতকাল বুধবার একই বিষয়ে ট্রাম্প তাঁর ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ নামের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছেন। এ পোস্টেও তিনি নানা দাবি করেছেন।
ট্রাম্পের দাবিগুলোর সত্যতা যাচাই করেছে ‘বিবিসি ভেরিফাই’। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প এমন সব কথা বলেছেন, যার সঙ্গে রাশিয়ার বয়ানের মিল আছে।
তিন বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে ট্রাম্প উদ্যোগী হয়েছেন। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার সৌদি আরবের রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। এ বৈঠকে কিয়েভকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
বৈঠকটির কয়েক ঘণ্টার মাথায় ইউক্রেন নিয়ে নানা কথা বলেন ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে জেলেনস্কি বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার তৈরি করা একটি অপতথ্যের পরিসরে বসবাস করছেন।
দাবি-১: জেলেনস্কি স্বৈরশাসক
ট্রাম্প প্রাথমিকভাবে এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে ইউক্রেনে ২০১৯ সালের পর আর কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
জেলেনস্কি কৌতুকাভিনেতা ছিলেন। কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইউক্রেনের ক্ষমতায় এসেছিলেন।
ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল পোস্টে ইউক্রেনের নির্বাচন প্রসঙ্গ টানেন। তিনি বলেন, জেলেনস্কি কোনো ধরনের নির্বাচন ছাড়াই এখন ক্ষমতায় আছেন। তিনি জেলেনস্কিকে ‘নির্বাচন ছাড়া স্বৈরশাসক’ হিসেবে অভিহিত করেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর। এই নিয়ম অনুসারে জেলেনস্কির মেয়াদ ২০২৪ সালের মে মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। একে রাশিয়া বলছে—‘বিশেষ সামরিক অভিযান’।
রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ইউক্রেন সামরিক আইন জারি রয়েছে। সামরিক আইন জারির অর্থ নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।
ইউক্রেনের সামরিক আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। অর্থাৎ ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে দখলে নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার কিছু পর এই খসড়া তৈরি হয়। তখনো জেলেনস্কি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হননি। এই খসড়া তৈরির কয়েক বছরের মাথায় তাঁর সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল পার্টি ইউক্রেনের ক্ষমতায় আসে।
অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপের (ওএসসিই) স্বাধীন পর্যবেক্ষকেরা মত দেন, ২০১৯ সালে ইউক্রেনের অনুষ্ঠিত নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক ছিল। এ নির্বাচনে ইউক্রেনীয় ভোটারদের মতামত প্রদানের মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হয়েছিল। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন জেলেনস্কি।
চলমান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেনে নতুন নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আগেই দিয়েছেন জেলেনস্কি। তবে সেই নির্বাচনে লড়বেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত করেননি তিনি।
জেলেনস্কি আগে বলেছিলেন, যুদ্ধের মাঝখানে নির্বাচন দেওয়াটা হবে সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা ব্যাপার।
কিছু বিশেষজ্ঞের পর্যবেক্ষণ হলো, যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে ইউক্রেনে নির্বাচন করা কার্যত অসম্ভব। কারণ, দেশটির অনেক শহরে রাশিয়ার আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের লাখ লাখ নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়ে বিদেশে চলে গেছেন কিংবা তাঁরা এখন রাশিয়ার দখলে থাকা ভূখণ্ডে বসবাস করছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিষয়ে ট্রাম্পের কথা বলার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই জেলেনস্কির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ক্রেমলিন। ক্রেমলিনের যুক্তি, জেলেনস্কির বৈধ মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
অবশ্য মস্কো বিগত মাসগুলোতে বারবার একই দাবি করেছে। যেমন গত ২৮ জানুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রুশ গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কিকে ‘অবৈধ’ প্রেসিডেন্ট বলে আখ্যায়িত করেন।
জেলেনস্কিকে ‘স্বৈরশাসক’ তকমা দেওয়ার সমালোচনা করেছেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির গণতান্ত্রিক বৈধতা অস্বীকার করাটা ভুল ও বিপজ্জনক।
ফোন দিয়ে জেলেনস্কির প্রতি স্পষ্ট সমর্থন জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। ডাউনিং স্ট্রিটের এক মুখপাত্র বলেছেন, ইউক্রেনের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার।
ডাউনিং স্ট্রিটের মুখপাত্র আরও বলেছেন, যুদ্ধের সময় নির্বাচন স্থগিত করাটা পুরোপুরি যুক্তিসংগত। একই কাজ যুক্তরাজ্যও করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।
দাবি: জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা ৪ শতাংশ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইউক্রেনে জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
ঠিক কোন উৎসের বরাত দিয়ে ট্রাম্প এ কথা বলেছেন, তা স্পষ্ট নয়। কারণ, তিনি এ কথা বলার সময় কোনো অকাট্য তথ্যপ্রমাণ হাজির করেননি।
ট্রাম্পের দাবির বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য বিবিসির পক্ষ থেকে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তবে তাৎক্ষণিকভাবে জবাব পাওয়া যায়নি।
যুদ্ধকবলিত ইউক্রেনে আনুষ্ঠানিক জরিপ খুব কমই আছে। এ ছাড়া যুদ্ধের সময় সঠিক জরিপ করাটাও অত্যন্ত কঠিন।
কারণ, যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ ইউক্রেনীয় বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ দখল করে নিয়েছে রাশিয়া।
তবে টেলিফোনের মাধ্যমে কিছু জরিপ করা সম্ভব হয়েছে। ইউক্রেনভিত্তিক কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজি চলতি মাসে একটি জরিপ করেছে। জরিপে দেখা গেছে, ইউক্রেনীয়দের ৫৭ শতাংশ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ওপর তাঁদের আস্থা-বিশ্বাস আছে।
তবে ২০২৩ সালের শেষ দিকে ইউক্রেনে জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা ছিল ৭৭ শতাংশ। ২০২২ সালের মে মাসে তা ছিল ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ অল্পসংখ্যক যে জরিপ হয়েছে, তা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা আগের মতো নেই। তাঁর জনপ্রিয়তা কমতির দিকে। তবে ট্রাম্পের দাবিমতো জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা ৪ শতাংশে নেমে আসার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অন্য কিছু জরিপ বলছে, জনপ্রিয়তায় জেলেনস্কি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত সাবেক সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনির চেয়ে পিছিয়ে আছেন।
জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যের পর এ ইস্যুকে লুফে নেয় রাশিয়ার প্রধান গণমাধ্যমগুলো। তারা ইউক্রেনের পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) ও জেলেনস্কির সমালোচক ওলেক্সান্ডার দুবিনস্কি পরিচালিত একটি জরিপের বরাত দিয়ে খবরাখবর প্রচার করছে। রুশ গণমাধ্যমগুলো বলছে, জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা নিয়ে ট্রাম্পের কথা সমর্থন করে এ জরিপ।
ইউক্রেনের এই এমপির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে দেশটিতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। রুশ গোয়েন্দাদের নির্দেশে কাজ করার অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অবশ্য এ অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন।