সড়কে থেমে গেল সাংবাদিক মাসুমার লড়াই, একা হয়ে গেল ছেলে মেঘ
মেঘের বয়স যখন দুই বছর, তখন তার বাবা রাজনৈতিক সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ছেলেকে মানুষ করতে লেখাপাড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন মা মাসুমা আক্তার। জীবন গুছিয়ে নিয়ে সবে সুদিনের স্বপ্ন দেখছিলেন মাসুমা। হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় থেমে গেল এই সাংবাদিকের জীবনের লড়াই। একা হয়ে গেল ১২ বছরের ছেলে মেঘ।
মাসুমা আক্তার বেসরকারি এখন টেলিভিশনের রাজশাহী ব্যুরো অফিসের সাংবাদিক ছিলেন। এই বিভাগীয় শহরে টেলিভিশনে কাজ করা একমাত্র নারী সাংবাদিক ছিলেন তিনিই। গতকাল মঙ্গলবার নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের বাড়িতে যখন তাঁর দাফন করা হয়, তখন কবরস্থানের প্রাচীর ধরে পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল ছেলে মেঘ। তার চোখে কোনো অশ্রু ছিল না। দেখে মনে হলো, চাপা কান্না বুকে নিয়ে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাসুমারা দুই ভাই–বোন। বাবা আবদুর জব্বার সাবেক সেনাসদস্য। মাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষে ২০১২ সালে বিল চলন শহীদ শামসুজ্জোহা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন মাসুমা। একাদশ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মাসুমার বিয়ে হয়ে যায়। বর ছিলেন নাটোরের কানাইখালী এলাকার সাইফুজ্জামান সুজন। এই দম্পতির ঘরে আসে এক ছেলে। নাম রাখা হয় মেঘ। ২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর এক সকালে মাসুমার সুখের সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। নাটোরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন মাসুমার স্বামী ছাত্রদল নেতা সাইফুজ্জামান।
স্বামীর মৃত্যুর পর বাবার সংসারে ফিরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন মাসুমা। আবার পড়ার টেবিলে বসেন। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন। ভর্তি হন রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। শিক্ষাজীবন থেকেই তাঁর সাংবাদিকতার শুরু। অনার্স ও মাস্টার্স শেষে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন। রাজশাহীর একাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টালে তিনি প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ২০২৪ সালে এখন টেলিভিশনের রাজশাহী ব্যুরো অফিসের রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন মাসুমা। ছেলে মেঘকে রাজশাহী শহরের একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সে এবার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
সব মিলিয়ে কেবল সুখের দেখা পেয়েছিলেন মাসুমা। সেই স্মৃতি মনে করে বাড়িতে মাসুমার মরদেহ আসার পর বিলাপ করতে করতে মা রেহেনা বেগম বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ে চাকরি পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিল। মাসুমা বলত, “অনেক বড় চ্যানেলে চাকরি পাইছি আম্মু, তুমি চিন্তা কইরো না।” মেয়ে আমারে ছেড়ে গেল, এখন কী নিয়ে থাকব?’
২০২৩ সালের শেষের দিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন মাসুমা। স্বামীর নাম সৈকত। বাড়ি মাসুমার গ্রামের বাড়ির কাছেই। তিনি রাজশাহীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীরা জানান, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় সৈকতের অসুস্থ বোনকে দেখতে যাচ্ছিলেন মাসুমা। স্বামী–স্ত্রী কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নূরজাহান হোটেলের উল্টো দিকে বাস থেকে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঠিক করছিলেন। এ সময় দ্রুতগামী একটি বাস অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয়। এতে ছিটকে পড়েন মাসুমা ও সৈকত। আহত হন অটোরিকশাচালকও।
প্রথমে তাঁদের একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে আইসিইউ শয্যা না পাওয়ায় তাঁকে নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে মাসুমা ইসলাম না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
এখন টিভির রাজশাহী অফিসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাকিবুল হাসান বলেন, মাসুমা ইসলাম সাংবাদিক মহলে এক পরিশ্রমী ও বিনয়ী সাংবাদিক ছিলেন। তিনি কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চটা দিয়ে সবার মনে জায়গা করেছিলেন।