বর্তমান বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ তথ্যপ্রযুক্তি জগতে বিপ্লব এনেছে। চ্যাটবট, ছবি ও কনটেন্ট জেনারেশন টুল, কণ্ঠস্বর নকল প্রযুক্তি এবং স্বয়ংক্রিয় অনুবাদ ব্যবস্থা এখন আর বিলাসিতা নয়; বরং প্রতিদিনের জীবনে ও কর্মক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পরিবর্তন যেমন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে নৈতিকতা, গোপনীয়তা এবং সর্বোপরি কপিরাইট আইনসংশ্লিষ্ট নানা জটিলতা। বাংলাদেশও এই নতুন প্রযুক্তির মুখোমুখি এবং এখনই সময় বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করে উপযুক্ত নীতিমালার পথ নির্ধারণ করা। এআই বর্তমানে অটোমেশন, কনটেন্ট নির্মাণ, অনুবাদ, ছবি ও সংগীত তৈরিসহ বহু কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। জনপ্রিয় এআই টুল, যেমন– চ্যাটজিপিটি, গুগল বার্ড, মিডজার্নি, ড্যাল-ই এবং অ্যাডোবি ফায়ারফ্লাই দিয়ে সহজেই লেখা, কোড, গান, চিত্র বা ভিডিও তৈরি করা সম্ভব।


বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির প্রাথমিক ব্যবহার দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন খাতে। যেমন– শিক্ষা খাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা চ্যাটজিপিটি বা গুগল জেমিনি ব্যবহার করে রচনার ধারণা, গবেষণার সহায়তা এবং অনুবাদ কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন। সংবাদপত্র ও ডিজিটাল মিডিয়ায় কনটেন্ট লেখায় এআইর সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, বিজ্ঞাপন ও গ্রাফিক ডিজাইনে এআই ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। তবে এসব ব্যবহার ঘিরে একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে এসেছে– এই কনটেন্টের কপিরাইট কার? এআই, নাকি মানুষের?


কপিরাইট হলো এমন একটি আইনি অধিকার, যা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তাদের সৃষ্ট মৌলিক কাজের ওপর একচ্ছত্র মালিকানা দেয়। বাংলাদেশের কপিরাইট আইন হলো কপিরাইট অ্যাক্ট ২০০০, যা ভারতীয় কপিরাইট আইন ১৯৫৭ অনুসরণ করে তৈরি। আন্তর্জাতিকভাবে এই অধিকার সুরক্ষিত হয় বার্ন কনভেনশন (১৮৮৬) ও বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার (ডব্লিউআইপিও) বিভিন্ন সনদ অনুযায়ী। তবে এসব আইন মূলত মানুষের সৃজনশীলতা সুরক্ষায় প্রণীত। কিন্তু এআই যখন কবিতা লেখে, ছবি আঁকে বা সংগীত তৈরি করে, তখন সেসব সৃষ্টির মালিকানা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়।


এআইনির্ভর কোনো লেখা বা চিত্রের মালিক কে হবেন? যিনি টুলে নির্দেশ দিয়েছেন, নাকি এআই নিজেই? যেমন চ্যাটজিপিটিতে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কবিতা লেখো’ কমান্ড দিলে উৎপাদিত কবিতার কপিরাইট কি ব্যবহারকারীর, নাকি ওপেনএআইর? বেশির ভাগ এআই টুল তার তথ্য সংগ্রহ করে কোটি কোটি বই, ওয়েবসাইট, চিত্র, সংবাদপত্র ও ভিডিও থেকে– যা অনেক ক্ষেত্রেই আগে কপিরাইটযুক্ত। এটি অনেক সময় ‘ফেয়ার ইউজ’ লঙ্ঘন করতে পারে।

এআই কনটেন্ট অনেক সময় এতটাই মূল সৃষ্টির কাছাকাছি হয় যে তা কার্যত নকল হয়ে দাঁড়ায়। এতে সৃষ্টিশীল ব্যক্তির শ্রমের অবমূল্যায়ন ঘটে। এআই দিয়ে এখন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের চেহারা বা কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করা সম্ভব। এতে শিল্পীদের পার্সোনালিটি রাইট লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কপিরাইট দপ্তর জানিয়েছে, শুধু মানুষের সৃষ্ট কনটেন্ট কপিরাইটযোগ্য। এআইর কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কপিরাইট সুরক্ষার আওতায় আসবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এআই অ্যাক্টের খসড়ায় বলা হয়েছে, এআইর প্রশিক্ষণ ডেটা সঠিকভাবে প্রাপ্ত হয়েছে কিনা, তা প্রকাশ করতে হবে। কনটেন্টে ‘এআই-জেনারেটেড’ ট্যাগ থাকতে হবে। ভারতীয় কপিরাইট আইন এখনও এআইসংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্পষ্ট নয়। তবে ২০২৩ সালে ‘এআই-জেনারেটেড কনটেন্ট’-এর মালিকানা নিয়ে বিতর্ক উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ হলো, প্রচলিত আইন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।

আমাদের কপিরাইট আইন অনুযায়ী শুধু ‘অথর’ বা ‘ক্রিয়েটর’ হিসেবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এআই যেখানে স্বাধীনভাবে কনটেন্ট তৈরি করতে পারে, সেখানে আইনগত ভাষা অস্পষ্ট। এ ছাড়াও এআই কনটেন্ট যাচাইয়ের জন্য পরিকাঠামো নেই। কোন কনটেন্ট এআই তৈরি করেছে, তা শনাক্ত করতে বাংলাদেশে কোনো কেন্দ্রীয় টুল বা রেগুলেটরি সংস্থা নেই। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এআই সম্পর্কিত কোনো পূর্ণাঙ্গ আইন বা নীতিমালা নেই। আইসিটি বিভাগ ২০২০ সালে একটি এআই রোডম্যাপ তৈরি করলেও কপিরাইটবিষয়ক নির্দেশনা অনুপস্থিত। এআই সম্পর্কিত জটিলতা সমাধানে আইনজীবী, পুলিশ ও বিচার বিভাগের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এখনও সে প্রচেষ্টা সীমিত।


অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশে এআই ব্যবহারের জন্য একটি সমন্বিত জাতীয় নীতি তৈরি করা জরুরি– যা প্রযুক্তির গবেষণা, উন্নয়ন, ব্যবহার, নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা, নৈতিকতা এবং মানবিক অধিকার রক্ষার দিক অন্তর্ভুক্ত করবে। ভারতের মতো অনেক দেশ ইতোমধ্যে এআই নীতিমালা তৈরি করেছে। বাংলাদেশেও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এ ধরনের নীতিমালা প্রয়োজন। এআই বিষয়ে আইন সংস্কার ও হালনাগাদ করতে হবে। কপিরাইট আইন ২০০০-এর পুনর্মূল্যায়ন করে এআইসংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সংযোজন করতে হবে। এআই দ্বারা সৃষ্ট কনটেন্টের ক্ষেত্রে শেয়ারড ওনারশিপ বা ইউজার অ্যাট্রিবিউশন বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। সংবাদপত্র, মিডিয়া, পত্রিকা, ইউটিউব চ্যানেল বা ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতারা এআই ব্যবহার করলে তা প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে স্বচ্ছতা আসবে।


যেহেতু এআই প্রযুক্তি বিশাল পরিমাণ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে, এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় একটি ডেটা প্রটেকশন আইন প্রয়োজন। যেখানে ডেটা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও শেয়ার করার নিয়মাবলি স্পষ্ট থাকবে। সরকার চাইলে স্বতন্ত্র এআই জেনারেটেড রেজিস্ট্রেশন প্ল্যাটফর্ম চালু করতে পারে। এই ডিজিটাল ডেটাবেজ চালু করে সেখানে এআইকৃত কনটেন্ট জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে কপিরাইট বিতর্ক এড়ানো যাবে। জাতীয় পর্যায়ে এআই নীতিমালা তৈরি করে সেখানে নৈতিকতা, কপিরাইট, ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসকে ডিজিটাল যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। মান্ধাতার আমলের সিস্টেম থেকে বের হয়ে এসে আধুনিক সিস্টেম চালু করতে হবে। কপিরাইট নিবন্ধন, বিরোধ নিষ্পত্তি এবং পর্যালোচনা প্রক্রিয়া আরও আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় করা জরুরি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে অগ্রগতির প্রতীক। তবে এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে এটি সৃষ্টিশীলতা ও আইনগত কাঠামো বিঘ্নিত করতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান প্রযুক্তিনির্ভর দেশের জন্য এখনই সময় কপিরাইট আইনকে আধুনিকীকরণ এবং এআই ব্যবহারকে নিয়মের আওতায় আনার। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দেওয়ার পথে এগিয়ে যেতে পারবে। 

মো.

আসাদুজ্জামান: সহকারী অধ্যাপক, আইন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা
asad@law.ku.ac.bd
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এআই ক ত র ম ব দ ধ মত ত ক ত র ম ব দ ধ মত ত এআই ব যবহ র কনট ন ট

এছাড়াও পড়ুন:

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

শ্রম আইন সংস্কার করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দিয়ে মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্কের বন্ধনে নতুন করে দেশ গড়ার প্রত্যয়ের মধ্যে এলো মহান মে দিবস; আজ ১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস।  

পুরো বিশ্বের সঙ্গে আজ বাংলাদেশে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় জাতীয়, রাজনৈতিক ও সংগঠনিক বিভিন্ন পক্ষ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে।

মহান মে দিবসে এবার বাংলাদেশের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’।

আরো পড়ুন:

অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে হবে

পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা স্থায়ী চাকরির নিশ্চয়তা ও সম্মান পাক

সভ্যতা নির্মাণের কারিগর শ্রমিকদের সম্মানে এবং ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলনে আত্মহুতি দেওয়া শ্রমিকদের শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণে দিবসটিতে বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে জাতীয় ছুটি থাকে। বাংলাদেশেও আজ জাতীয় ছুটি। অনেক দেশে বেসরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হয়।

১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নেমে শ্রমিকেরা আত্মাহুতি দেন। দিনটির ঘটনা ইতিহাসে আজো অম্লান। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় দিবসটি। 

মহান মে দিবসের সবচেয়ে বড় অর্জন শ্রমশোষণ কমিয়ে আনার পথ সুগম করা। তবে শ্রমদাসত্ব বিলোপ হয়নি। আধুনিক শ্রমদাসত্বের শেকলে নতুন কায়দায় বন্দি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ উপযুক্ত শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য অধিকার চায়; যেখানে নিয়োগকারী ও শ্রমিক চোখে চোখ রেখে কথা বলবে, যে যার পাওনা ও অধিকার বুঝে নেবে।

বাংলাদেশে শ্রম ব্যবস্থা এখনো সেকেলে শোষণের ধারণায় পুষ্ট, যা থেকে শ্রমিকদের বের করে আনার দীর্ঘদিনের দাবি রয়েছে। 

অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমিকের অধিকার রক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের লক্ষ্যে গঠন করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। এরই মধ্যে কমিশন তাদের সুপারিশমালা সরকারকে দিয়েছে; এখন চলছে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ। সরকার, রাজনৈতিক দল, নিয়োগকারী, শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞ- সব অংশীজন মিলেই কমিশনের সুপারিশ চূড়ান্ত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশে কী কী পরিবর্তন আসছে, জানতে চাইলে বুধবার (৩০ এপ্রিল) শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন ব‌লে‌ন, “শ্রম আইনে অনেক পরিবর্তন আসছে।”

“এখনো পাকাপোক্ত হয়নি, তবে অনেক পরিবর্তন আসছে। আমাদের আলোচনা হয়েছে। যেসব প্রস্তাব আমরা দিয়েছি, যেগুলো আমরা একসেপ্ট করেছি, সেগুলো আইএলও-কে (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) বলা হয়েছে। সেগুলো ফাইনালাইজ করতে হবে। আরো অনেক কিছু আছে,” বলেন তিনি।

কবে নাগাদ শ্রমিকরা নতুন আইনের বিষয়ে ‘সুখবর’ পাবেন, তার কোনো দিনক্ষণ না জানালেও সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, “যত দ্রুত সম্ভব চূড়ান্ত করা হবে।”

অবশ্য কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রচলিত শ্রমিকদের পাশাপাশি অপ্রচলিত খাতের শ্রমিকদেরও স্বার্থ রক্ষার উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে।

তৈরি পোশাকখাতসহ সব শিল্পখাতের শ্রমিকদের বিষয়ে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, শ্রম আইনে শিল্পের উদ্যোক্তাদের ‘মালিক’ এর বদলে ‘নিয়োগ কর্তা’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কোনো শ্রমিককে এক দিনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হলেও চুক্তিপত্র বা পরিচয়পত্র থাকতে হবে।

সব খাতের শ্রমিকদের পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে শ্রম আইন ‘সর্বজনীন’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সারা দেশের শ্রমিকদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার গঠনের কথা বলেছে কমিশন।

সুপারিশমালা বলা হয়েছে, সেবা খাতে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে স্ব-উদ্যোগে নিয়োজিতরা তথ্য ভাণ্ডারের ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করার সুযোগ পাবেন এবং এই নিবন্ধনই শ্রমিক হিসেবে তার পরিচয়পত্র হবে। 

মৎস্যজীবী, রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, কৃষি শ্রমিক ও হকারের মতো স্বাধীন শ্রমজীবীদেরও  একইভাবে নিবন্ধন করে পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব বলে কমিশন মত দিয়েছে। 

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রম শাখার এক স্মারকে শ্রমিককে চাকরিচ্যুতি, ছাঁটাই এবং মহান মে দিবসে কারখানা বন্ধ রাখা প্রসঙ্গে যা বলা হয়েছে, গত ৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আরএমজি-বিষয়ক ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (আরএমজি বিষয়ক টিসিসি) ২০তম সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে, যৌক্তিক কারণ এবং শ্রম আইনের প্রতিপালন ব্যতীত শ্রমিক চাকরিচ্যুত বা ছাঁটাই করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে শ্রমিককে চাকরিচ্যুত বা ছাঁটাই করার পূর্বে স্থানীয় প্রশাসন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শিল্পাঞ্চল পুলিশ এবং বিজিএমইএর ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে। শ্রম আইন মেনে শ্রমিককে চাকরিচ্যুত বা ছাঁটাই করা না হলে, মালিকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

সিদ্ধান্তের মধ্যে আরো রয়েছে, মহান মে দিবসে সকল কারখানা বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ মে দিবসে কারখানা খোলা রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে মহান মে দিবসে ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য সেফটি দিবস’ পালন করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার (১ মে) শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বর্ণাঢ্য র‌্যালি করবে, যেটি উদ্বোধন করবেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে হবে এই র‌্যালি।

মে দিবসে ঢাকার নয়া পল্টনে দুপুর ২টায় শ্রমিক সমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি। সেখানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে কথা বললেন। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। 

ঢাকা মহানগরের বাইরে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ আশপাশের জেলা থেকে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মে দিসবের শ্রমিক সমাবেশে যোগ দেবেন বলে বিএনপি থেকে জানানো হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সকালে পুরানা পল্টন মোড়ে শ্রমিক সমাবেশের করবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সেখানে কথা বললেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তার সঙ্গে থাকবেন নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। বড় পরিসরে এই সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিয়েছে জামায়াত।
 
মেহনতি মানুষের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা: প্রধান উপদেষ্টা
মহান মে দিবস এবং জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস উপলক্ষে বিশেষ বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। 

বাণীতে তিনি বলেছেন, বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘মহান মে দিবস-২০২৫’ পালন করা হচ্ছে জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রম, ন্যায্য মজুরি ও শ্রমের মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে শ্রমিকদের রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক ও শ্রমের মর্যাদা সম্মানের সঙ্গে বিশ্বময় স্বীকৃতি লাভ করে। এ দিবসে আদায় হয়েছে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। 

“সে প্রেক্ষাপটে এটি শুধু একটি সাধারণ দিবস নয়, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার ঐতিহাসিক এ দিনে যাদের আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে শ্রমিক অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে, তাদেরসহ দেশের সকল মেহনতি মানুষের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।”

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে মে দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বছর মে দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’, আমাদের দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।”

“শ্রমিক ও মালিক পরস্পরের পরিপূরক, আর তাদের যৌথ প্রচেষ্টাই একটি শক্তিশালী, আত্মনির্ভর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের পোশাক খাত, কৃষি, শিল্প, নির্মাণ, পরিবহণ, প্রযুক্তি - প্রতিটি খাতের উন্নতির পেছনে রয়েছে শ্রমিক এবং মালিকের মেধা ও প্রাণান্তকর পরিশ্রম,” বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

 এ দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আস্থার পরিবেশ সুদৃঢ় করার আহ্বান রেখে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা যদি ঐক্য ও সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রাখি, তাহলে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তব হয়ে উঠবে।”

তিনি বলেন, “এ বছর মহান মে দিবসের পাশাপাশি একইসঙ্গে আমরা ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস-২০২৫’ পালন করছি। শ্রমিকের ন্যায্য স্বীকৃতি ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা শুধু শ্রমিকদের অধিকারই নয়, এটি শিল্প ও অর্থনীতির উন্নয়নের অন্যতম শর্ত।”

বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, “একইসঙ্গে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়ন ও কল্যাণ পুরো শিল্পখাত এবং দেশের অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন-যাত্রায় শ্রমিক ও মালিকের অংশীদারিত্বে দেশের অগ্রগতি আরো ত্বরান্বিত হবে মর্মে আমার বিশ্বাস। আমি ‘মহান মে দিবস-২০২৫’ এবং ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস-২০২৫’ উপলক্ষে গৃহীত সকল কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।”

ঢাকা/এএএম/রাসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ