ছয় বছর বয়স থেকে মায়ের হাত ধরে নগরের চান্দগাঁও বাসা থেকে আউটার স্টেডিয়ামে ক্রিকেট অনুশীলন করতে যেত রাহাত খান। শেষ করে আবার বাসায় ফিরত মায়ের সঙ্গে। মায়ের স্বপ্ন ছিল, ছেলে বড় ক্রিকেটার হবে। সেই পথে এগোতে থাকে ছেলেও। ঝুলিতে যুক্ত হয় অনেক পুরস্কার। বাসার শোকেসে সাজানো রয়েছে ক্রেস্ট, মেডেল ও সনদ। ক্লাবের বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব–১১-১২ দলের অধিনায়কও হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল বড় ক্রিকেটার হয়ে দেশের জন্য জয় ছিনিয়ে আনবে। বিদেশে খেলতে গেলে বিমানে মাকেও নেবে সঙ্গে। রাহাতের এসব স্বপ্নের কথাই আজ বারবার মনে পড়ছে মা রোজি আক্তারের। বিলাপ করেতে করতে সেসব কথাই বলছিলেন বারবার। তাঁর বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অবলম্বনটা যে আর নেই।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে নগরের চান্দগাঁও হামিদচর এলাকায় নদী থেকে রাহাতের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। চান্দগাঁও সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল সে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ব্রাদার্স ইউনিয়ন জুনিয়র ক্রিকেট দলের হয়ে খেলত এই খুদে ক্রিকেটার। পুলিশ ও নিহত কিশোরের পরিবার সূত্র জানায়, সহপাঠীরা বেড়ানোর কথা বলে নদীতে নিয়ে গিয়ে তাকে ফেলে দেয়।

ছেলে রাহাতকে হারিয়ে বারবার বিমানে চড়ার কথা বলছেন মা রোজি আক্তার। আজ বিকেলে নগরের চান্দগাঁও পূর্ব ফরিদার পাড়া এলাকার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ঘরভর্তি মানুষ। সবার চোখে পানি। সোফায় বসে বিলাপ করছিলেন রোজি আক্তার। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কাঁদছিলেন স্বজনেরাও। বিলাপ করতে করতে রোজি আক্তার বলেন, ‘ছেলে শুধু বলত, বড় ক্রিকেটার হয়ে আম্মু তোমাকে নিয়ে বিমানে চড়ব। এখন আমাকে কে বিমানে চড়াবে।’

কিছুটা শান্ত হওয়ার পর রোজি আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ছেলের ছয় বছর বয়স থেকে ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য আউটার স্টেডিয়ামে নিয়ে যেতাম। অনুশীলন শেষ হওয়ার পর আবার তাকে নিয়ে বাসায় ফিরতাম। আমার কষ্ট হতো, ছেলে তা বুঝতে পারত। এ জন্য প্রায়ই বলত, মা আমি যখন বড় ক্রিকেটার হব, তখন বিদেশে খেলতে গেলে তোমাকেও নিয়ে যাব সঙ্গে।’

এসব কথা বলতে না বলতেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন রোজি আক্তার। তখন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন কোচ মাসুমউদ্দৌলা। পরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাহাত অলরাউন্ডার ছিল। বোলিং, ব্যাটিং সবই করতে। এমনকী ভালো কিপারও ছিল। গত বছর ক্লাবের অনূর্ধ্ব–১১-১২ গ্রুপের অধিনায়ক করা হয় তাকে। সীমিত ওভারের বেশ কয়েকটি খেলায় পাশাপাশি দুটি ৫০ রান ছিল তার। একবার ৪৯ রানে অপরাজিত ছিল সে। একজন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারকে হারিয়ে ফেললাম আমরা।’

সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন মাসুমউদ্দৌলা। তিনি বলেন, স্কুলপড়ুয়াদের কাছে সহপাঠীরাও কেন নিরাপদ নয়? কেন স্কুলছাত্ররা সহিংস হয়ে উঠছে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের। নয়তো রাহাতের মতো আরও কিশোরকে মূল্য দিতে হবে।

রাহাতকে নিয়মিত অনুশীলন করাতেন আরেক কোচ আবদুস সামাদ। প্রিয় ছাত্রের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাসায় ছুটে আসেন তিনিও। আবদুস সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, ছয় বছর বয়স থেকে মায়ের সঙ্গে ক্রিকেট অনুশীলন করতে আসে রাহাত। ও খুবই মেধাবী ছিল।

রাহাতের সঙ্গে অনুশীলন করত উমায়ের তোফায়েল। প্রিয় বন্ধুর বাসায় ছুটে আসে সে–ও। কিন্তু কান্নার জন্য কিছুই বলতে পারেনি। সঙ্গে ছিল তার মা তানিয়া আহমেদ। তিনি বলেন, রাহাত খুব অমায়িক ছেলে ছিল। স্কুলবন্ধুদের কাছে ছেলেরা নিরাপদ না হলে কোথায় নিরাপত্তা পাবে।

মা-বাবার তৃতীয় সন্তান রাহাত। তার বড় দুই ভাই রয়েছে। তবে তারা অসুস্থ। রাহাতের চাচা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার ভাইয়ের যে ছেলেটা মেধাবী ছিল, খেলাধুলায় সেরা ছিল, সেই ছেলেটাই নেই।’

সহপাঠীদের সঙ্গে রাহাতের কোনো ঝগড়া হয়েছে কি না, এ তথ্য নিশ্চিত করতে পারেননি সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল মনসুর চৌধুরী বলেন, ‘স্কুলে রাহাতের সঙ্গে বন্ধুদের ঝগড়ার বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। আমাদের কাছে কোনো অভিযোগও করা হয়নি। আমি শ্রেণিশিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছি, তিনিও কিছুই জানেন না। রাহাতের মা আমাদের বলেছেন, ১০-১২ দিন আগে রাহাত একদিন বাসায় ফিরে তাঁকে বলেছে, কয়েকটা ছেলের সঙ্গে তার গন্ডগোল হয়েছে। তার মা এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে ঝগড়া না করার জন্য বলেছিলেন।’ ঘটনার পর সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চবিদ্যালয়ের তিন শিক্ষককে নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলে প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় নিহত স্কুলছাত্রের চার সহপাঠীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।

রাহাতের বাবার একটি গ্রিলের ওয়ার্কশপ রয়েছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই মাস আগে স্কুলে বসা নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে তার ছেলের কথা-কাটাকাটি হয়। সেটি মীমাংসাও হয়ে যায়। কিন্তু এই ঘটনার জেরে তার ছেলেকে বুধবার টিফিন ছুটির পর নদীর তীরে নিয়ে যায় সহপাঠীরা। তারাই মেরে নদীতে ফেলে দেয় বলে তিনি দাবি করেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বড় ক র ক ট র আম দ র র জন য সহপ ঠ

এছাড়াও পড়ুন:

বাচ্চাসহ ভালুকের বিচরণ, সতর্কতা

হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলমাছড়া অভয়ারণ্যে দুর্লভ প্রজাতির এশিয়াটিক কালো প্রজাতির ভালুকের বিচরণের খবর পাওয়া গেছে। বাচ্চাসহ একটি ভালুকের বিচরণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় বনে প্রবেশে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে বন বিভাগ।

তেলমাছড়া বনের বনরক্ষী সাদেকুর রহমান জানান, এশিয়াটিক কালো প্রজাতির একটি ভালুককে তিনটি বাচ্চাসহ সাতছড়ি, তেলমাছড়া ও সালটিলায় বনে বিচরণ করতে দেখা গেছে। বাচ্চা থাকা অবস্থায় ভালুক হিংস্র থাকে। এ কারণে বনরক্ষীরা খুব সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, জাতীয় উদ্যান ঘোষণায় তেলমাছড়া বনে বিপন্ন প্রজাতির ভালুকের সংখ্যা বাড়ছে।

কালো ভালুকের একটি দলের অভয়ারণ্যে বিচরণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয়রাও। বনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন হৃদয় বলেন, এখন সাতছড়ি ও তেলমাছড়া বনে ভালুকসহ বিলুপ্তপ্রায় অনেক বন্যপ্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ভালুকের দেখা মেলায় মানুষ এখন ভয়ে আগের মতো বনে যায় না।

তেলমাছড়া বিট কর্মকর্তা মেহেদী হাসান জানান, সম্প্রতি কিছু শ্রমিক পাহাড়ের বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করতে গিয়ে বাচ্চাসহ ভালুকটিকে দেখেছে। এ কারণে পর্যটকদের বনে প্রবেশ করতে সাবধানতা অবলম্বন করতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রমকেও জোরদার করা হয়েছে।

মাধবপুরের তেলমাছড়ার বনে এশীয় ভালুকের উপস্থিতিকে সুখবর বলে অভিহিত করে বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা জোহরা মিলা বলেন, এক সময় দেশের পার্বত্য অঞ্চল বিশেষ করে সিলেট-চট্টগ্রামের মিশ্র চিরসবুজ পাহাড়ি বনের গহিন অরণ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভালুকের বাস ছিল। কিন্তু বাসস্থান ধ্বংস, খাদ্যের অভাব, বনে অনুপ্রবেশ ও শিকার এবং পাচারের কারণে প্রাণীটি বিলুপ্ত হতে বসেছে। যদিও গহিন বনে কিছু ভালুক এখনও টিকে আছে। তেলমাছড়া ও সাতছড়ি, রঘুনন্দন বনে বাচ্চাসহ ভালুকের দেখা মেলা জীববৈচিত্র্যের জন্য ভালো সংবাদ।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ