বাংলাদেশের কফি সংস্কৃতি : সম্ভাবনার সুবাস
Published: 30th, April 2025 GMT
একসময় আমাদের দেশে ‘কফি’ শব্দটি ছিল শুধু একটি বিদেশি অভ্যস্ততা, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই ধারণা বদলেছে। এখন কফি শুধুই একটি পানীয় নয়, এটি হয়ে উঠেছে জীবনযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বন্ধুত্ব, কাজের ফোকাস, আড্ডা, মানসিক প্রশান্তি এবং স্টাইল।
বর্তমানে বাংলাদেশের শহুরে সমাজে কফির জনপ্রিয়তা অভাবনীয়। ঢাকার অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কর্পোরেট অফিস, এমনকি মোবাইল কফি ভ্যানেও কফির চাহিদা ব্যাপক। এক জরিপ অনুসারে, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩ লাখ কাপেরও বেশি কফি বিক্রি হয়। বাংলাদেশে বাৎসরিক কফির চাহিদা ৭ থেকে ৮ হাজার টন, যার অধিকাংশই আমদানি করা হয় ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ পেলে আগামী ১০ বছরে এই চাহিদা ১৫ হাজার টন ছাড়িয়ে যেতে পারে।
করোনা-পরবর্তী সময়ে ঘরে বসে কফি খাওয়ার প্রবণতা বাড়ায় হোম ব্রিউ কফি মেশিন এবং ইন্সট্যান্ট প্রিমিয়াম কফির বাজারও দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে কফির বাজার দ্রুত বিকাশমান। আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান Statista অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে কফির বাৎসরিক চাহিদা হবে প্রায় ৪৮ হাজার ৬০ টন। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, কফি এখন শুধু বিলাসিতা নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি প্রয়োজন।
বাংলাদেশে কফি চাষ মূলত সীমিত পরিসরে চালু আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং সিলেট অঞ্চলে। এরাবিকা ও রোবাস্টা—দুই ধরনের কফিরই পরীক্ষামূলক চাষ হচ্ছে, যেখানে সিলেট অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া বিশেষ উপযোগী প্রমাণিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কফি নিয়ে গবেষণাও চালাচ্ছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বান্দরবানে এক হেক্টর জমিতে বছরে গড়ে আটশ থেকে ১ হাজার কেজি কফি উৎপন্ন সম্ভব। এতে বাংলাদেশের চাহিদা অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হবে। এছাড়া, এই উৎপাদন যদি বাণিজ্যিকভাবে বাড়ানো যায়, তাহলে বাংলাদেশের স্পেশাল টি-কফি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, দেশে ২০১৯–২০ সালে কফি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫৫.
কফি আমদানি: দেশের নির্ভরতা ও বাস্তবতা
বাংলাদেশে স্থানীয় উৎপাদন খুবই সীমিত হওয়ায় অধিকাংশ কফি আমদানিনির্ভর। প্রথম আলো এবং The Business Standard এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ২০১২ সালে কফি আমদানি ছিল মাত্র ২৬৪ টন এবং ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১,৭৪৫ টন।
বাংলাদেশের ক্যাফে সংস্কৃতিতে “ওয়েলনেস” ধারণা এখন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ওয়েলনেস ক্যাফে একটি ইউনিক হেলদি-লিভিং ও লাইফ স্টাইল কনসেপ্ট যেখানে কফির সাথে স্বাস্থ্যকর খাবার, শান্ত পরিবেশ, এবং মানসিক প্রশান্তির সমন্বয় রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ১৭টিরও বেশি ওয়েলনেস ক্যাফে আউটলেট চালু রয়েছে, যেগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ১০০০-১২০০ কাপ কফি বিক্রি হয়। এসব ক্যাফেতে সুগার-ফ্রি ল্যাটে, প্ল্যান্ট বেইজড মিল্ক কফি, ডিক্যাফ এবং অর্গানিক বীন্স ব্যবহার করা হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যসচেতন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে। ওয়েলনেস ক্যাফে শুধু কফি ব্যবসা নয়, বরং এটি নতুন এক জীবনধারার প্রতিনিধিত্ব করছে—যেখানে প্রতিটি কাপের ভেতর থাকে স্বাস্থ্য, সচেতনতা, এবং জীবনকে উপভোগ করার বার্তা।
কফির স্বাস্থ্য উপকারিতা
একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিদিন ১–২ কাপ কফি খাওয়ার মাধ্যমে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায়:
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ২৫–৩০ শতাংশ হ্রাস করে। পারকিনসনস ও অ্যালঝেইমার রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। বিষণ্নতা হ্রাস করে।
দেশে ব্যবসায়িক অবস্থান
বাংলাদেশে কফিকে কেন্দ্র করে একটি নতুন অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। কফি ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে দেশীয় উদ্যোক্তা, কর্পোরেট হাউজ এবং তরুণ স্টার্টআপ ফাউন্ডাররা। ঢাকায় বর্তমানে ৫০০-রও বেশি ছোট-বড় ক্যাফে রয়েছে। শুধু বসার জায়গার ক্যাফে নয়—ক্লাউড কিচেন কনসেপ্ট, কফি ট্র্যাক, রোস্টিং হাউজ এবং সাবস্ক্রিপশন বেসড কফি ডেলিভারিও চালু হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড যেমন Starbucks, Tim Hortons এখনও বাংলাদেশে না এলেও, দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো এখন নিজস্ব স্টাইলে Premium Experience দিচ্ছে—যেমন: North End, Crimson Cup, Wellness café।
বাংলাদেশে কফির উপর মোট আমদানি শুল্ক ও ভ্যাটসহ করহার প্রায় ৮৯.৩২ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তুলনামূলকভাবে ভারতের কফির উপর কর ৫৪ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪৫ শতাংশ আর পাকিস্তানে ৩০ শতাংশ। এই উচ্চ ট্যাক্স কফির দাম বাড়ায়, উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে এবং ভোক্তাদের জন্য এটি ব্যয়বহুল করে তোলে। যদি ট্যাক্স হার যৌক্তিক পর্যায়ে কমানো হয় তাহলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। কফি হবে আরও সহজলভ্য হবে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। রোস্টিং ও প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশের কফির বিশ্ববাজার
বিশ্বে কফি শিল্পের বাজার প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার, যার সবচেয়ে বড় অংশটি দখলে রেখেছে ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও ভারত ও ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে রপ্তানিকারক হিসেবে সফল হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববাজারে প্রবেশের জন্য যা প্রয়োজন: সরকারি সহায়তায় জাতীয় কফি নীতি ও চাষ প্রসার। কফি রিসার্চ সেন্টার ও এক্সপোর্ট কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইউনিট। কফি ফার্মার ট্রেনিং, রোস্টার ট্রেইনিং এবং কিউ গ্রেডার তৈরি। দেশীয় ব্র্যান্ডকে ই-কমার্স ও আন্তর্জাতিক ফুড ফেস্টিভ্যালে প্রমোট করা। বিশ্বের বাজারে 'বাংলাদেশি হিল কফি' একদিন 'স্পেশালিটি সিগনেচার' হতে পারে, যদি আমরা এখন থেকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করি।
কফি আমাদের কাছে এখন আর বিলাসিতা নয়—এটি হয়ে উঠছে প্রতিদিনের লাইফস্টাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সংস্কৃতি, এবং সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি কাপ কফি শুধু ঘ্রাণ নয়, বহন করে নতুন দিনের গল্প, নতুন স্বপ্ন।
বাংলাদেশের কফি যদি বিশ্বমঞ্চে পা রাখতে পারে, তাহলে তাতে শুধুই একটি পণ্য নয়, বরং আমাদের দেশের সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, এবং সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন "Coffee - Made in Bangladesh" বিশ্বজয় করবে—ভাষা, স্বাদ এবং আপন ঘ্রাণে।
তারা//
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
সড়কের পাশে গল্প করছিলেন দুই নারী, নিয়ন্ত্রণ হারানো লরিচাপায় নিহত
খুলনার ডুমুরিয়া তেলবাহী লরির চাপায় দুজন নিহত হয়েছেন। বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের নরনিয়া মহিলা মাদ্রাসার কাছে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- রশিদা বেগম (৪৫) ও রোকেয়া বেগম ওরফে রকি (৫৫)।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নরনিয়া গ্রামের রশিদ গাজীর স্ত্রী রশিদা বেগম ও একই গ্রামের ফজর আলী সরদারের স্ত্রী রোকেয়া বেগম রকি সাতক্ষীরা-যশোর সড়কের পাশে বসে গল্প করছিলেন। এ সময় যশোরগামী তেলবাহী একটি লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কে উল্টে যায়। এ সময় লরিচাপায় ঘটনাস্থলে তাদের মৃত্যু হয়।
চুকনগর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. কামরুল ইসলাম জানান, মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। গাড়িচালক ও তার সহকারী পালিয়েছে। তবে গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে।