শিক্ষকের স্কেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত চোখ, ৮ মাস ধরে শিশুটির চিকিৎসায় পরিবারের ছোটাছুটি
Published: 30th, April 2025 GMT
‘ছেলেরে সাজায়-গোছায় স্কুলে দিয়ে আসছিলাম। এক ঘণ্টা পরই স্কুল থেকে ফোন করে বলে, এখুনি আসেন। দৌড়ায় স্কুলে গিয়ে দেখি, চারদিকে নিস্তব্ধ। স্কুল ছুটি দিয়ে দিছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। একজন এসে বলল, রোহান চোখে ব্যথা পাইছে, প্রিন্সিপালের রুমে। সেখানে গিয়ে দেখি, আমার ছেলের চোখে ব্যান্ডেজ করে শোয়ায় রাখছে।’
২৮ এপ্রিল কুমিল্লার তিতাস উপজেলার নিজ বাড়িতে বসে এ কথাগুলো বলছিলেন ফারহান ইসলাম রোহানের (৭) মা মায়া আক্তার। প্রথম আলোর সঙ্গে কথাগুলো বলার সময় তাঁর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছিল।
মায়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর স্কুলশিক্ষকের স্কেলের আঘাতে তাঁর ছেলের ডান চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসার জন্য আট মাস ধরে ছেলেকে নিয়ে ছোটাছুটি করছেন তাঁরা। ছেলের চোখে দুবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, আঘাতে তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি চলে গেছে।
শিশুটির বাবা রবিউল ইসলাম, তিনি ওমানপ্রবাসী। রবিউল-মায়া দম্পতির সন্তান ফারহান ঘটনার সময় উপজেলার বাতাকান্দি এলাকার সেবা মাল্টিমিডিয়া স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। এই তথ্য জানিয়ে মায়া বলেন, স্কুলটির সহকারী শিক্ষক রাহাতুল ইসলাম সৌরভ (২৫) ফারহানের দিকে স্কেল ছুড়ে মেরেছিলেন।
মায়া তাঁর তিন সন্তান নিয়ে স্বামীর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ আকালিয়া গ্রামে থাকেন। ফারহানের যমজ বোন রয়েছে। এই বোন মাদ্রাসায় পড়ে। আর বড় বোন দশম শ্রেণির ছাত্রী।
ঘটনার বিষয়ে ফারহানের চাচা মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন, শিক্ষক রাহাতুল ক্লাসে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। ফারহানসহ ক্লাসের শিশুশিক্ষার্থীরা হইচই করলে শিক্ষক প্রচণ্ড রেগে যান। তিনি প্রথমে স্কেল দিয়ে ফারহানের পিঠে বাড়ি দেন। এতে স্কেল ভেঙে যায়। শিক্ষক নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার পরও হইচই বন্ধ হচ্ছিল না। তখন তিনি আরও রেগে যান। শিক্ষক ভাঙা স্কেলটি ফারহানের দিকে ছুড়ে মারেন। স্কেলটি ফারহানের ডান চোখে গিয়ে লাগে।
এ ঘটনায় গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষক রাহাতুলের বিরুদ্ধে তিতাস থানায় অভিযোগ করেন ফারহানের মা। অভিযোগে গুরুতর আঘাত করে চোখ নষ্ট করার কথা বলা হয়। অভিযোগটি মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছে তিতাস থানার পুলিশ। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩২৬ ধারায় করা এই মামলায় সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা-সংক্রান্ত নীতিমালা ২০১১’ জারি রয়েছে। এই নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাগাদাও দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের চড়-থাপ্পড় দেওয়া, চুল টানা, কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা, ‘নিল ডাউন’ করে রাখা, দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখা, স্কেল বা বেত দিয়ে মারার মতো শারীরিক শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটে। আর ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে সবার সামনে হাস্যাস্পদ করাসহ নানান মানসিক শাস্তি তো হরহামেশাই চলে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী স্কুলে শিশুসন্তানেরা পড়ে জানিয়ে এক মা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সন্তানেরা প্রায়ই অভিযোগ করে যে শিক্ষক বকা দেন। তারা একদিন স্কুলেও যেতে চাইছিল না। তিনি শিক্ষকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শিক্ষক উল্টো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান।
রাজধানীর খ্যাতনামা একটি স্কুলে মেয়েরা চুল ঠিকভাবে বেঁধে না গেলে বড় ক্লাসের শিক্ষার্থীদের দিয়ে মাথায় তেল ঢেলে দেওয়ার ‘রেওয়াজ’ আছে বলে অভিযোগ করেন আরেক অভিভাবক। অন্যদিকে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা শাসনের নামে ছাত্রদের ভয়াবহভাবে মারধর করছেন—এমন ভিডিও প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা যায়।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ ৩০ এপ্রিল পালিত হচ্ছে শিশুদের শারীরিক শাস্তি বিলোপের আন্তর্জাতিক দিবস। শিশুদের প্রতি সব ধরনের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলাই দিবসটির লক্ষ্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বাংলাদেশ পরিচালিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ অনুসারে, জরিপের সময়ের মাসখানেক আগে ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় ৮৯ শতাংশ শিশু পরিবারের সদস্যদের হাতে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। ৩০ শতাংশের শাস্তি গুরুতর ছিল। মা ও শিশুর লালন–পালনকারীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ মনে করেন, শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার দরকার আছে। জরিপে ৭০ হাজারের বেশি শিশু এবং সাড়ে ৫৩ হাজারের বেশি মা ও শিশু লালন–পালনকারী অংশ নিয়েছিলেন।
‘পুতের ভবিষ্যৎ-স্বপ্ন সব গেল’
ছেলে ফারহানের ঘটনা শুনে বাবা রবিউল দেশে এসেছিলেন। তিন মাস তিনি দেশে থেকে ছেলের চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি করেন।
শিশুদের পেটানো হয়—এমন স্কুলে কেন ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন, এ নিয়ে এখন আফসোস মা মায়া আক্তারের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পুতের এত বড় ক্ষতি কইরা দিল। আমার পুতেরে শেষ কইরা ফালাইল। পুতের ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন সব গেল।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্না থামাতে পারছিলেন না মায়া আক্তার। ছেলের চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বড় আশা নিয়ে ভারত গেছিলাম। ডাক্তাররা বলছে, এই চোখ আর ভালো হবে না।’
পরিবারটি বলছে, ঘটনার পর এলাকার একজন চিকিৎসকের কাছে ফারহানকে নিয়ে গিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। ওই চিকিৎসক শিশুর অবস্থা ভালো না জানিয়ে ঢাকা নিয়ে যেতে বলেন। এরপর তাঁরা প্রথমে কুমিল্লায়, পরে ঢাকার ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নিয়ে যান। সেখানে অস্ত্রোপচার হয়। পরে ঢাকার আরও দুটি হাসপাতালসহ চট্টগ্রামে তার চিকিৎসা করানো হয়। ভারতের হায়দরাবাদ ও চেন্নাইয়ের দুটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারসহ দেড় মাস চিকিৎসা শেষে গত ফেব্রুয়ারিতে ফারহানকে নিয়ে দেশে ফেরেন মা। এখন দেশে চিকিৎসক দেখাচ্ছেন।
ফারহানের চিকিৎসার পেছনে এখন পর্যন্ত ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানায় পরিবারটি। ফারহানকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে উপজেলার দক্ষিণ আকালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু সে এখন এক চোখে কিছু দেখছে না। পড়তে গেলে তার মাথাব্যথা করে। তাই চিকিৎসকেরা তাকে পড়াশোনায় চাপ না দিতে বলেছেন।
ফারহানের মা মায়া আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখন পর্যন্ত আসামি গ্রেপ্তার হলো না। তিনি এই ঘটনার বিচার চান।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তিতাস থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো.
স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকের পরিবার যা বলছে
স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা মো. শামীম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মিটমাটের জন্য বলেছিলাম। চিকিৎসা আমরা করাব বলেছিলাম। কিন্তু ফারহানের পরিবার কোনো আলোচনায় বসতে রাজি নন। তাঁরা বলেছেন, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করাবেন। তো চিকিৎসা করাক।’
এটা কি মিটমাট করার বিষয়—এই প্রশ্ন করলে শামীম সরকার বলেন, ‘ছেলেটার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। সে ক্ষতি তো আর পূরণ করা সম্ভব নয়।’
স্কুলের শিক্ষকেরা এভাবে শিক্ষার্থীদের মারধর করেন কি না জানতে চাইলে শামীম সরকার বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মারধর করা সম্পূর্ণ নিষেধ। এরপরও ওই শিক্ষক কেন এই কাজ করলেন, জানি না। ঘটনার পর তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’
শিক্ষক রাহাতুলের মুঠোফোনে কল করলে এক নারী ধরেন। তিনি নিজের নাম বলেন শিল্পী আক্তার। পরিচয় দেন রাহাতুলের মা বলে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে ইচ্ছা করে তো কাজটা করে নাই। বাচ্চারা চিল্লাচিল্লি করছিল, রাগের মাথায় স্কেল ছুড়ে মারছে।’
শিল্পী আক্তার জানান, রাহাতুল কুমিল্লার হোমনা ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের ছাত্র। ঘটনার ১০ মাস আগে রাহাতুল ওই স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন। রাহাতুলের বাবা মো. মোতাকাব্বির স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।
ফারহানের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রসঙ্গে শিল্পী আক্তার বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য খরচ লাগলে দেব। আমরা চাই, ঘটনাটির একটি মীমাংসা হোক। কিন্তু ওই পরিবার (ফারহানের) কোনো আলোচনাতেই বসতে চায় না।’
‘কোনো শিক্ষার্থীকে আঘাত করতে পারেন না শিক্ষক’
বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ‘দ্য গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু এন্ড অল করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন (জিআই)’ শিশুদের শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে ২০০১ সালে প্রচারাভিযান শুরু করে। ২০২০ সাল থেকে এই প্ল্যাটফর্ম ‘এন্ড করপোরাল পানিশমেন্ট’ নামে কাজ করে। এই প্ল্যাটফর্মের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে ২০২৪ সালের হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়, স্কুলে শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে জারি হওয়া নীতিমালাকে আইনে রূপ দেওয়া দরকার। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বাংলাদেশে বাড়ি, দিবাযত্নকেন্দ্র, অভিযুক্তদের রাখার প্রতিষ্ঠানে (শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র) এখনো শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ হয়নি।
তিতাস উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমাইয়া মমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফারহানের ঘটনাটির পর প্রশাসনের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল বলে প্রশাসনের এখানে সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ কম। অভিযুক্ত শিক্ষক ও তাঁর পরিবারকে ডাকা হয়েছিল। শিক্ষক আসেননি। কোনো শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীকে আঘাত করতে পারেন না।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক চ ক ৎসক উপজ ল র য গ কর র জন য পর ব র ইসল ম ঘটন র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
একটি টাইম স্কেল-সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্তদের দুটি উচ্চতর গ্রেড পেতে আইনি বাধা কাটল
সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবীদের ক্ষেত্রে একই পদে কর্মরত কোনো কর্মচারী দুই বা ততোধিক উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড (যে নামেই হোক) পেয়ে থাকলে, তিনি উচ্চতর গ্রেড পাবেন না উল্লেখ করে জাতীয় বেতন স্কেল স্পষ্টীকরণ-সংক্রান্ত পরিপত্র পুরোটাই অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন।
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা পৃথক চারটি আপিল ও আটটি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) নিষ্পত্তি করে আজ বুধবার রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকা আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় সংশোধন করে এ রায় দেন।
রায়ের পর রিট আবেদনকারীদের অন্যতম আইনজীবী ইব্রাহিম খলিল প্রথম আলোকে বলেন, স্পষ্টীকরণ–সংক্রান্ত পরিপত্রের প্যারা-গ অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে ২০১৫ সালের জাতীয় পে–স্কেলের উচ্চতর গ্রেডের প্রাপ্যতাসংক্রান্ত প্যারা-৭ যেমন আছে, তেমনই থাকবে। স্পষ্টীকরণ পরিপত্রের প্যারা-গ-এর কারণে দুটি উচ্চতর গ্রেড পাওয়ায় যে প্রতিবন্ধকতা, তা আর থাকল না। এটি না থাকার কারণে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ১৫ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী এই সুবিধা পাবেন। অর্থাৎ যাঁরা ২০১৫ সালের আগে একটা টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, তাঁদের দুটি উচ্চতর গ্রেড পেতে বাধা আইনি বাধা থাকছে না।
পে-স্কেলের ৭ অনুচ্ছেদে আছে ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে’
এর আগে সব পর্যায়ের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতনকাঠামো (জাতীয় পে–স্কেল)–সংক্রান্ত আদেশ ২০১৫ সালের ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়। এটি জাতীয় পে–স্কেল ২০১৫ নামে পরিচিত।
পে–স্কেলের ৭ অনুচ্ছেদে উচ্চতর গ্রেডের প্রাপ্যতা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। ৭ (১) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো স্থায়ী কর্মচারী পদোন্নতি ছাড়া একই পদে ১০ বছর পূর্তিতে এবং চাকরি সন্তোষজনক হওয়া সাপেক্ষে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১১তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্য হবেন।
৭ (২) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো কর্মচারী তাঁর চাকরির ১০ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্তির পর পরবর্তী ৬ষ্ঠ বছর পদোন্নতি প্রাপ্ত না হলে ৭ম বছরে চাকরি সন্তোষজনক হওয়া সাপেক্ষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্য হবেন।
৭ (৩) উপ–অনুচ্ছেদের ভাষ্য, (১) ও (২) উপ–অনুচ্ছেদে উল্লেখিত আর্থিক সুবিধা বেতন স্কেলের চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে এবং চতুর্থ গ্রেড বা তার ওপরের গ্রেডের কোনো কর্মচারী এই সুবিধা গ্রহণ করে এই আদেশের অধীন তৃতীয় গ্রেড বা তার ওপরের গ্রেডে বেতন প্রাপ্য হবেন না।
আর ৭ (৪) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো কর্মচারী দুই বা ততোধিক সিলেকশন গ্রেড স্কেল বা উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল) বা অন্য কোনো স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছার এক বছর পর পরবর্তী উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি এই অনুচ্ছেদের অধীন উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন না।
পরিপত্রের প্যারা-গ অবৈধ
জাতীয় বেতনকাঠামো প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর ‘জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ স্পষ্টীকরণ’ বিষয়ে ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পরিপত্র জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর (গ) অনুচ্ছেদে উচ্চতর গ্রেডের প্রাপ্যতা বিষয়ে বলা রয়েছে।
(গ) (১) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একই পদে কর্মরত কোনো কর্মচারী দুই বা ততোধিক উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড (যে নামেই হোক) পেয়ে থাকলে তিনি এই অনুচ্ছেদের অধীন উচ্চতর গ্রেড পাবেন না।
(গ) (২)–এর ভাষ্য, একই পদে কর্মরত কোনো কর্মচারী একটিমাত্র উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড (যে নামেই হোক) পেয়ে থাকলে উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড পাওয়ার তারিখ থেকে পরবর্তী ছয় বছর পূর্তির পর সপ্তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন।
(গ) (৩) উপ–অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একই পদে কর্মরত কোনো কর্মচারী কোনো প্রকার উচ্চতর স্কেল (টাইম স্কেল)/সিলেকশন গ্রেড (যে নামেই হোক) না পেয়ে থাকলে সন্তোষজনক চাকরির শর্তে তিনি ১০ বছর চাকরি পূর্তিতে ১১তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেড এবং পরবর্তী ৬ষ্ঠ বছরে পদোন্নতি না পেলে ৭ম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন।
আর সরকারি কর্মচারীদের প্রদত্ত এসব আর্থিক সুবিধা কোনোক্রমেই ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বরের আগে দেওয়া হবে না বলে পরিপত্রের (গ) (৪) উল্লেখ করা হয়।
আইনজীবী ইব্রাহিম খলিল প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৫ সালের পে–স্কেলের ৭ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে চতুর্থ গ্রেড বা তার ওপরের কর্মচারী উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন না। একই সঙ্গে ২০১৫ পে–স্কেলে আগে যেসব কর্মচারী দুই বা ততোধিক টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, তাঁরাও উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হবেন না মূল পে–স্কেলে বলা আছে। অথচ ২০১৫ সালের আগে যাঁরা একটি মাত্র টাইম স্কেল অথবা সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, তাঁরা একটিমাত্র উচ্চতর গ্রেড পাবেন বলে স্পষ্টীকরণ–সংক্রান্ত পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ২০১৫ সালের জাতীয় পে–স্কেলের ৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পরিপত্র দিয়ে মূল জাতীয় বেতনকাঠামো সংশোধন এখতিয়ারবহির্ভূত। যে কারণে রিটগুলো করা হয়।
মামলার পূর্বাপর
‘জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ স্পষ্টীকরণ’ বিষয়ে ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছর রিট করেন কয়েকজন সরকারি চাকরিজীবী। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে স্পষ্টীকরণ পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে। ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণার হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। ২০২০ সালে রাষ্ট্রপক্ষ নিয়মিত আপিল করে।
এ ছাড়া ওই পরিপত্র নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীরা পৃথক রিট করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষিত হয়।
হাইকোর্টের পৃথক রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক আপিল ও লিভ টু আপিল করে। ২০২০ সালে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের সঙ্গে অপর আপিল ও লিভ টু আপিলের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়। রাষ্ট্রপক্ষের এসব আপিল ও লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে আজ রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। রিট আবেদনকারীর পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন ও আইনজীবী ইব্রাহিম খলিল শুনানি করেন।