ভারত ও পাকিস্তান ফের একটি ভয়াবহ সংঘর্ষের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় উপমহাদেশ এমন অনিশ্চিত এক পরিস্থিতিতে ঢুকে পড়েছে, যেখানে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের পথ বন্ধ হয়ে গেছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে।

কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে হওয়া সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আরও কিছু পদক্ষেপের মধ্যে আছে আটারী সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া, ভিসা বাতিল করা এবং নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের পরিসর ছোট করে ফেলা।

এসব কথিত প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ কোনো তদন্ত ছাড়াই এবং পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ ছাড়া নেওয়া হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শুধু বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে ‘সীমান্ত-পারাপার সংযোগ’ রয়েছে।

কিন্তু ভারতের সংবাদমাধ্যমে একটি সাজানো প্রচারণার মাধ্যমে পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়।

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধলে ক্ষতি হবে কার১১ ঘণ্টা আগে

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হামলাকারী ও তাদের মদদদাতাদের জন্য ‘অকল্পনীয় শাস্তি’ দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। এর ফলে ভারতে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে, মোদি সরকার হয়তো কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে চলেছে।

এতে ২০১৯ সালের বালাকোট–সংকটের স্মৃতি ফিরে আসছে। ওই ঘটনায় ভারতীয় যুদ্ধবিমান সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে দাবি করেছিল, সেখানে জঙ্গি আস্তানা ছিল। জবাবে পাকিস্তান জম্মুতে বিমান হামলা চালায়। ওই সময় পাকিস্তান একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে ও পাইলটকে আটক করে। পরে মিত্রদেশগুলোর সহায়তায় সংকট নিরসন হয় ও পাকিস্তান সেই পাইলটকে ফেরত পাঠায়।

ভারতের ২৩ এপ্রিলের ঘোষণার পর ইসলামাবাদও সতর্কভাবে সমন্বিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির এক বৈঠকের পর দেওয়া বিবৃতিতে পাকিস্তানও একগুচ্ছ পাল্টা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। তারা ভারতের পদক্ষেপগুলোকে ‘একতরফা, অন্যায় ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

পাকিস্তান সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের ভারতীয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে সতর্ক করেছে, পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত পানির প্রবাহ থামানো বা অন্যদিকে সেই পানিপ্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ‘যুদ্ধের কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে’ এবং তার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে’।

আরও পড়ুনতালেবান সরকার কেন ভারতের দিকে ঝুঁকছে ২৯ এপ্রিল ২০২৫

প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তান বলেছে, ভারতের এই ঘোষণার পর ইসলামাবাদ শিমলা চুক্তিসহ ভারতের সঙ্গে করা সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ‘স্থগিত রাখার’ অধিকার সংরক্ষণ করছে; যদিও কোনো চুক্তি সরাসরি বাতিল করা হয়নি।

পাকিস্তান আরও জানিয়েছে, তারা ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, ভারতীয় উড়োজাহাজের জন্য আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে এবং সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত করেছে। মূলত পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ছিল ভারতের নেওয়া পদক্ষেপেরই প্রতিরূপ।

ভারত সিন্ধু চুক্তি ‘স্থগিত’ করার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা হঠাৎ করে আসেনি। গত কয়েক বছর ধরেই নয়াদিল্লি ১৯৬০ সালের এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছিল। অথচ এই চুক্তি ছয় দশক ধরে যুদ্ধ, সংঘাত ও উত্তেজনার মধ্যেও টিকে ছিল এবং দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টনের একটি কাঠামো দিয়েছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। যেমন ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চেনাব ও ঝিলম নদীতে ভারতের পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে যখন দ্য হেগে সালিসি আদালতে শুনানি হয়, তখন ভারত তা বয়কট করে। পানিসংকটে ভোগা পাকিস্তান এই প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিল। ভারত চেয়েছিল নিরপেক্ষ কোনো বিশেষজ্ঞ বিষয়টি দেখুক।

আরও পড়ুনভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম২৮ এপ্রিল ২০২৫

২০২৩ সালের জানুয়ারিতেই ভারত পাকিস্তানকে চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার সংশোধন সম্পর্কে অবহিত করে। তখন ইসলামাবাদ জানায়, তারা ইন্দুস ওয়াটারস কমিশনে বৈঠকের মাধ্যমে ভারতের যেকোনো উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত এবং ভারতের প্রতি চুক্তি মেনে চলার আহ্বান জানায়।

২০২৪ সালের আগস্টে নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামাবাদকে চুক্তি পর্যালোচনা ও পুনরায় আলোচনার জন্য আহ্বান জানায়। পাকিস্তানকে পাঠানো বার্তায় ভারত দাবি করে, ‘মৌলিক ও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন’ এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে চুক্তিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এতে ভারত জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করে।

২০২৫ সালের ২৪ এপ্রিল ভারতের পাকিস্তানকে পাঠানো চিঠিতে আবারও এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়, তবে এবার অতিরিক্তভাবে ‘পাকিস্তানের দ্বারা চলমান সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদ’ চুক্তি স্থগিত করার যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়।

বর্তমানে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, নয়াদিল্লি যদি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রলুব্ধ হয়। ভারতের কর্মকর্তারা মনে করছেন, তাঁদের কঠোর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের নীতি এখন ‘কার্যকর’ হয়েছে এবং এটিকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। ২৪ এপ্রিল বিহারে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, সন্ত্রাসী ও তাদের মদদদাতাদের ‘পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত’ তাড়া করা হবে। এই বক্তব্যকে ভারতের সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের একটি শক্ত ইঙ্গিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

ভারতের এই সিদ্ধান্ত চুক্তির ধারা বা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। চুক্তি অনুযায়ী, কোনো একক পক্ষ একতরফাভাবে চুক্তি স্থগিত বা বাতিল করতে পারে না। চুক্তি পরিবর্তন বা বাতিল করতে হলে উভয় পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন। ভারতের ঘোষণা অনুযায়ী, ‘পাকিস্তান যদি বিশ্বাসযোগ্য ও অপরিবর্তনীয়ভাবে সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদে সমর্থন ত্যাগ না করে, তবে সিন্ধু চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত থাকবে।’

এই মুহূর্তে ‘স্থগিত’ বলার মানে হলো, ভারত আর পানির প্রবাহসংক্রান্ত তথ্য ও প্রকল্প নকশা সম্পর্কে পাকিস্তানকে তথ্য দেবে না; যদিও ভারত এই তথ্য আদান-প্রদান কয়েক বছর আগেই কার্যত বন্ধ করে দিয়েছিল। ভারত চাইলে আরও চাপ সৃষ্টির জন্য অতিরিক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে বর্তমানে ভারতের কাছে পানির প্রবাহ থামানো বা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটানোর মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। তাই স্বল্প মেয়াদে ভারতের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সীমিত থাকবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর গুরুতর পরিণতি হতে পারে।

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগলে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে২৭ এপ্রিল ২০২৫

বর্তমানে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, নয়াদিল্লি যদি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রলুব্ধ হয়। ভারতের কর্মকর্তারা মনে করছেন, তাঁদের কঠোর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের নীতি এখন ‘কার্যকর’ হয়েছে এবং এটিকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। ২৪ এপ্রিল বিহারে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, সন্ত্রাসী ও তাদের মদদদাতাদের ‘পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত’ তাড়া করা হবে। এই বক্তব্যকে ভারতের সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের একটি শক্ত ইঙ্গিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) ও আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছাকাছি ভারী অস্ত্র মোতায়েনের খবর পাওয়া গেছে। মোদি হয়তো ভাবছেন, তিনি ইসরায়েলের কৌশল অনুকরণ করে পাকিস্তানকে ‘শাস্তি’ দিতে পারবেন। কিন্তু ভারত যদি কোনো সামরিক হামলা চালায়, তাহলে পাকিস্তান শক্ত প্রতিরোধ দেখাবে, যার ফলাফল হতে পারে অনিশ্চিত ও অপ্রত্যাশিত এবং এর বড় মূল্য দিতে হতে পারে নয়াদিল্লিকে। এতে উত্তেজনা আরও বাড়বে ও পূর্ণাঙ্গ সংকট তৈরি হতে পারে, যার মাত্রা হয়তো ২০১৯ সালের সংকটের চেয়েও ভয়াবহ হবে।

২০১৯ সালে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় সংকট নিরসন হয়েছিল। এবারও কি তা সম্ভব হবে? যদি দ্রুত কোনো তৃতীয় পক্ষ এগিয়ে না আসে, তাহলে পরমাণু অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

পারমাণবিক যুদ্ধের সীমার নিচে সীমিত যুদ্ধের ধারণা বিপুল ঝুঁকি বহন করে। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি যেকোনো মূল্যে এড়াতে হবে। যদিও ভারতীয় পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত বড় ধরনের যুদ্ধের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না, তবু ভুল–বোঝাবুঝি এড়াতে, সংকট নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে দ্রুত একটি ব্যাকচ্যানেল যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার। অন্যথায় সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ হতে পারে যে তা কল্পনাও করা কঠিন।

মালিহা লোধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পদক ষ প ন ত ইসল ম ব দ পদক ষ প র ব ত ল কর পর স থ ত নয় দ ল ল র প রব প রব হ র জন য র একট ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

ভারত-পাকিস্তান কি যুদ্ধের একেবারে কিনারায়

ভারত ও পাকিস্তান ফের একটি ভয়াবহ সংঘর্ষের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় উপমহাদেশ এমন অনিশ্চিত এক পরিস্থিতিতে ঢুকে পড়েছে, যেখানে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের পথ বন্ধ হয়ে গেছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে।

কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে হওয়া সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আরও কিছু পদক্ষেপের মধ্যে আছে আটারী সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া, ভিসা বাতিল করা এবং নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের পরিসর ছোট করে ফেলা।

এসব কথিত প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ কোনো তদন্ত ছাড়াই এবং পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ ছাড়া নেওয়া হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শুধু বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে ‘সীমান্ত-পারাপার সংযোগ’ রয়েছে।

কিন্তু ভারতের সংবাদমাধ্যমে একটি সাজানো প্রচারণার মাধ্যমে পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়।

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধলে ক্ষতি হবে কার১১ ঘণ্টা আগে

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হামলাকারী ও তাদের মদদদাতাদের জন্য ‘অকল্পনীয় শাস্তি’ দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। এর ফলে ভারতে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে, মোদি সরকার হয়তো কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে চলেছে।

এতে ২০১৯ সালের বালাকোট–সংকটের স্মৃতি ফিরে আসছে। ওই ঘটনায় ভারতীয় যুদ্ধবিমান সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে দাবি করেছিল, সেখানে জঙ্গি আস্তানা ছিল। জবাবে পাকিস্তান জম্মুতে বিমান হামলা চালায়। ওই সময় পাকিস্তান একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে ও পাইলটকে আটক করে। পরে মিত্রদেশগুলোর সহায়তায় সংকট নিরসন হয় ও পাকিস্তান সেই পাইলটকে ফেরত পাঠায়।

ভারতের ২৩ এপ্রিলের ঘোষণার পর ইসলামাবাদও সতর্কভাবে সমন্বিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির এক বৈঠকের পর দেওয়া বিবৃতিতে পাকিস্তানও একগুচ্ছ পাল্টা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। তারা ভারতের পদক্ষেপগুলোকে ‘একতরফা, অন্যায় ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

পাকিস্তান সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের ভারতীয় সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে সতর্ক করেছে, পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত পানির প্রবাহ থামানো বা অন্যদিকে সেই পানিপ্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ‘যুদ্ধের কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে’ এবং তার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে’।

আরও পড়ুনতালেবান সরকার কেন ভারতের দিকে ঝুঁকছে ২৯ এপ্রিল ২০২৫

প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তান বলেছে, ভারতের এই ঘোষণার পর ইসলামাবাদ শিমলা চুক্তিসহ ভারতের সঙ্গে করা সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ‘স্থগিত রাখার’ অধিকার সংরক্ষণ করছে; যদিও কোনো চুক্তি সরাসরি বাতিল করা হয়নি।

পাকিস্তান আরও জানিয়েছে, তারা ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, ভারতীয় উড়োজাহাজের জন্য আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে এবং সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত করেছে। মূলত পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ছিল ভারতের নেওয়া পদক্ষেপেরই প্রতিরূপ।

ভারত সিন্ধু চুক্তি ‘স্থগিত’ করার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা হঠাৎ করে আসেনি। গত কয়েক বছর ধরেই নয়াদিল্লি ১৯৬০ সালের এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছিল। অথচ এই চুক্তি ছয় দশক ধরে যুদ্ধ, সংঘাত ও উত্তেজনার মধ্যেও টিকে ছিল এবং দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টনের একটি কাঠামো দিয়েছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। যেমন ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চেনাব ও ঝিলম নদীতে ভারতের পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে যখন দ্য হেগে সালিসি আদালতে শুনানি হয়, তখন ভারত তা বয়কট করে। পানিসংকটে ভোগা পাকিস্তান এই প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিল। ভারত চেয়েছিল নিরপেক্ষ কোনো বিশেষজ্ঞ বিষয়টি দেখুক।

আরও পড়ুনভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম২৮ এপ্রিল ২০২৫

২০২৩ সালের জানুয়ারিতেই ভারত পাকিস্তানকে চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার সংশোধন সম্পর্কে অবহিত করে। তখন ইসলামাবাদ জানায়, তারা ইন্দুস ওয়াটারস কমিশনে বৈঠকের মাধ্যমে ভারতের যেকোনো উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত এবং ভারতের প্রতি চুক্তি মেনে চলার আহ্বান জানায়।

২০২৪ সালের আগস্টে নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামাবাদকে চুক্তি পর্যালোচনা ও পুনরায় আলোচনার জন্য আহ্বান জানায়। পাকিস্তানকে পাঠানো বার্তায় ভারত দাবি করে, ‘মৌলিক ও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন’ এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে চুক্তিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এতে ভারত জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করে।

২০২৫ সালের ২৪ এপ্রিল ভারতের পাকিস্তানকে পাঠানো চিঠিতে আবারও এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়, তবে এবার অতিরিক্তভাবে ‘পাকিস্তানের দ্বারা চলমান সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদ’ চুক্তি স্থগিত করার যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়।

বর্তমানে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, নয়াদিল্লি যদি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রলুব্ধ হয়। ভারতের কর্মকর্তারা মনে করছেন, তাঁদের কঠোর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের নীতি এখন ‘কার্যকর’ হয়েছে এবং এটিকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। ২৪ এপ্রিল বিহারে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, সন্ত্রাসী ও তাদের মদদদাতাদের ‘পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত’ তাড়া করা হবে। এই বক্তব্যকে ভারতের সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের একটি শক্ত ইঙ্গিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

ভারতের এই সিদ্ধান্ত চুক্তির ধারা বা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। চুক্তি অনুযায়ী, কোনো একক পক্ষ একতরফাভাবে চুক্তি স্থগিত বা বাতিল করতে পারে না। চুক্তি পরিবর্তন বা বাতিল করতে হলে উভয় পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন। ভারতের ঘোষণা অনুযায়ী, ‘পাকিস্তান যদি বিশ্বাসযোগ্য ও অপরিবর্তনীয়ভাবে সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদে সমর্থন ত্যাগ না করে, তবে সিন্ধু চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত থাকবে।’

এই মুহূর্তে ‘স্থগিত’ বলার মানে হলো, ভারত আর পানির প্রবাহসংক্রান্ত তথ্য ও প্রকল্প নকশা সম্পর্কে পাকিস্তানকে তথ্য দেবে না; যদিও ভারত এই তথ্য আদান-প্রদান কয়েক বছর আগেই কার্যত বন্ধ করে দিয়েছিল। ভারত চাইলে আরও চাপ সৃষ্টির জন্য অতিরিক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে বর্তমানে ভারতের কাছে পানির প্রবাহ থামানো বা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটানোর মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। তাই স্বল্প মেয়াদে ভারতের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সীমিত থাকবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর গুরুতর পরিণতি হতে পারে।

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগলে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে২৭ এপ্রিল ২০২৫

বর্তমানে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, নয়াদিল্লি যদি কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রলুব্ধ হয়। ভারতের কর্মকর্তারা মনে করছেন, তাঁদের কঠোর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের নীতি এখন ‘কার্যকর’ হয়েছে এবং এটিকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। ২৪ এপ্রিল বিহারে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, সন্ত্রাসী ও তাদের মদদদাতাদের ‘পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত’ তাড়া করা হবে। এই বক্তব্যকে ভারতের সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের একটি শক্ত ইঙ্গিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) ও আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছাকাছি ভারী অস্ত্র মোতায়েনের খবর পাওয়া গেছে। মোদি হয়তো ভাবছেন, তিনি ইসরায়েলের কৌশল অনুকরণ করে পাকিস্তানকে ‘শাস্তি’ দিতে পারবেন। কিন্তু ভারত যদি কোনো সামরিক হামলা চালায়, তাহলে পাকিস্তান শক্ত প্রতিরোধ দেখাবে, যার ফলাফল হতে পারে অনিশ্চিত ও অপ্রত্যাশিত এবং এর বড় মূল্য দিতে হতে পারে নয়াদিল্লিকে। এতে উত্তেজনা আরও বাড়বে ও পূর্ণাঙ্গ সংকট তৈরি হতে পারে, যার মাত্রা হয়তো ২০১৯ সালের সংকটের চেয়েও ভয়াবহ হবে।

২০১৯ সালে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় সংকট নিরসন হয়েছিল। এবারও কি তা সম্ভব হবে? যদি দ্রুত কোনো তৃতীয় পক্ষ এগিয়ে না আসে, তাহলে পরমাণু অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

পারমাণবিক যুদ্ধের সীমার নিচে সীমিত যুদ্ধের ধারণা বিপুল ঝুঁকি বহন করে। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি যেকোনো মূল্যে এড়াতে হবে। যদিও ভারতীয় পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত বড় ধরনের যুদ্ধের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না, তবু ভুল–বোঝাবুঝি এড়াতে, সংকট নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে দ্রুত একটি ব্যাকচ্যানেল যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার। অন্যথায় সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ হতে পারে যে তা কল্পনাও করা কঠিন।

মালিহা লোধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ