পররাষ্ট্র উপদেষ্টা রোববার জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যদিও মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সরকার জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে তথাকথিত ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি (সমকাল অনলাইন, ২৯ এপ্রিল ২০২৫)। 
আলোচনাটি যে হঠাৎ এসে গেছে– এমন মনে করার কারণ নেই। গত বছর ১১ নভেম্বর আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই মানবিক করিডোরের বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছিল। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের একটি ধারণা দিয়েছিলেন। ওই সভাতেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.

) মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি ও মানবিক করিডোর খোলার প্রস্তাব রাখেন।

দু’মাস পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দুই দিনের সফরে বাংলাদেশ আসেন। তখনই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর দুই দিনের সফর শেষে ১৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টই বলেছিলেন– ‘মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। পরিস্থিতি অনুকূল হলে বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে বাংলাদেশকে চ্যানেল বা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে যথাযথ অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন’ (সমকাল, ১৬ মার্চ ২০২৫)।
সর্বশেষ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন রোববার এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে করিডোরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। কারণ এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সে ব্যাপারে বিস্তারিত আপাতত বলছি না। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব (সমকাল, ২৮ এপ্রিল ২০২৫)।
বিধৃত পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানুষের জন্য বাংলাদেশকে মানবিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি জাতিসংঘের অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে যুদ্ধরত অনেক দেশেই বেসামরিক লোকদের কাছে মানবিক সহায়তা প্রদানে মানবিক করিডোর স্থাপন ও ব্যবহার করা হয়েছে। এসবের কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃপ্রণোদিত আলোচনার মাধ্যমে, কোনো কোনোটি তৃতীয় পক্ষ বিশেষত জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে। উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, ফল সবসময় খুব একটা ভালো হয়নি।
যেমন ১৯৮৯ সালে প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় বেসামরিক মানুষদের সাহায্য করার জন্য লাচিন করিডোর স্থাপিত হয়েছিল। এটি নাগোর্নো-কারাবাখের আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক করিডোর বা ‘জীবনরেখা’ হিসেবে বিবেচিত ছিল। শুরুতে কিছুদিন ভালো চললেও বছর দুয়েকের মাঝেই করিডোরটি আজারবাইজান বন্ধ করে দেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, প্রতিপক্ষ এটিকে সামরিক সরবরাহ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ‘অবৈধ’ পরিবহনের কাজে ব্যবহার করছিল; যদিও  আর্মেনিয়া ও তার মিত্র প্রজাতন্ত্রগুলো এসব অভিযোগ অস্বীকার করে।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন করে আক্রমণের পর আজারবাইজানি বাহিনী পুরো নাগোর্নো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফলে নাগোর্নো-কারাবাখের প্রায় সব আর্মেনীয় বাসিন্দা লাচিন করিডোর দিয়ে আর্মেনিয়ায় চলে যায়। এভাবেই একটি মানবিক করিডোরের অমানবিক মৃত্যু ঘটে।

বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় মানবিক করিডোরের ইতিহাস আরও রক্তাক্ত। সেখানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মানবিক করিডোর।
প্রথমে ১৯৯৩ সালের ১৬ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৮১৯ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে স্রেব্রেনিকা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে একই বছরের ৬ মে নিরাপত্তা পরিষদের ৮২৪ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ৬টি মানবিক করিডোর ঘোষণা করা হয়। এগুলোকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী ইউনিটের সুরক্ষাধীনে রাখা হয়। এটা জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের একটি বিবেচিত হয়ে থাকে। কারণ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মতো যুদ্ধক্ষেত্রে এই নিরাপদ এলাকাগুলোকে কীভাবে সুরক্ষিত করা হবে, সেটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট রূপরেখা ছিল না। ফলে প্রস্তাবটি পরে জটিল ও কঠিন কূটনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। কারণ এর পক্ষে ভোট দেওয়া রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক কারণে নিরাপদ এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ইচ্ছুক ছিল না। এ অবস্থায় ১৯৯৫ সাল নাগাদ জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকাগুলোতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে এবং স্রেব্রেনিকা গণহত্যার ক্ষেত্র তৈরি করে। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার একটি।

উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদের ৮১৯ নম্বর প্রস্তাবে স্রেব্রেনিকাকে ‘বল প্রয়োগসহ সব প্রয়োজনীয় উপায় ব্যবহার করে সুরক্ষিত নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকার ওপর অব্যাহত আক্রমণের পাশাপাশি সারায়েভোর অব্যাহত অবরোধের ফলে শেষ পর্যন্ত বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় অপারেশন ডেলিবারেট ফোর্স নামে ন্যাটো হস্তক্ষেপের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের শেষ নাগাদ প্রতিটি নিরাপদ এলাকায় ‘রিপাবলিকা শ্রপস্কা আর্মি’ বা বসনিয়ান সার্ব সেনাবাহিনী আক্রমণ এবং স্রেব্রেনিকা ও জেপা দখল করে।

আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী এবং জেনারেল লরেন্ট নকুন্ডার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। সেখানেও জাতিসংঘের প্রস্তাবমতে গোমা অঞ্চলে একটি মানবিক করিডোর খোলার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দেশটির সমস্যা সমাধানে এই পদক্ষেপও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে, এমন মনে করার অবস্থা এখনও সৃষ্টি হয়নি।
২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ও বিভিন্ন সময় নিরাপদ অঞ্চল, উত্তেজনা কমানোর অঞ্চল বা নো-ফ্লাই জোন প্রস্তাব বা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই তেমন কাজে লাগেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। সিরিয়ার বর্তমান অবস্থাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
বস্তুত বিশ্বজুড়ে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে যেসব জায়গায় ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো শেষ পর্যন্ত শুধু মানবিক করিডোরে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি। অনিবার্যভাবেই সামরিক নানা বিষয় যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যে এমনটি ঘটবে না– সে ব্যাপারে আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। কারণ আরাকান রাজ্যে এ ধরনের করিডোর মিয়ানমার সহজভাবে গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। ভূরাজনৈতিক কারণে এ অঞ্চলে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চীনের দীর্ঘদিনের স্বার্থ-সংঘাত সুবিদিত। সঙ্গে রয়েছে ভারত ও রাশিয়ার স্বার্থও। সর্বোপরি রাখাইনে মানবিক সহায়তার করিডোরে সেখানকার বেসামরিক নাগরিকদের লাভ হবে কিনা, তারও নিশ্চয়তা নেই। 

আমরা জানি, আরাকান আর্মির রসদ সরবরাহের অন্যান্য পথ বন্ধ করে রেখেছে মিয়ানমার জান্তা সরকার। এখন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘মানবিক সহায়তা’ তারা নিজেদের বদলে বেসামরিক নাগরিকদের হাতে তুলে দেবে? আবার আরাকান আর্মির হাতেও রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এই জনগোষ্ঠীর আরও এক লাখ সদস্য প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
কথা হচ্ছে, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কঙ্গো কিংবা সিরিয়া– কোথাও মানবিক করিডোর সফল হয়নি। সর্বশেষ ইউক্রেন-রাশিয়াতেও জাতিসংঘ প্রস্তাবিত মানবিক করিডোরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এখন সেটা বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ক্ষেত্রে কী ম্যাজিক দেখাতে পারে, বোধগম্য নয়। প্রস্তাব জাতিসংঘ বা যেখান থেকেই আসুক; সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।

মোশতাক আহমেদ; কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, জাতিসংঘ

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কর ড র আর ক ন আর ম ব যবহ র কর প রস ত ব র র প রস ত ব কর ড র স পর স থ ত আর ম ন য উপদ ষ ট ত হয় ছ র খ ইন

এছাড়াও পড়ুন:

ভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম

সীমান্তে হুমকির মুখে আছে ভারতের সেনাবাহিনী। অথচ তার আধুনিকীকরণ এখনো শেষ হয়নি। সেই বাস্তবতা সামনে চলে আসতে পারে। এই ঝুঁকি হয়তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্তে সংযত থাকতে বাধ্য করবে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চলতেই থাকে। শেষবার যখন তা সরাসরি মুখোমুখি সংঘাতে রূপ নিয়েছিল, তখন ভারতীয় কর্মকর্তারা এক অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। আর তা হলো দেশের বিশাল সেনাবাহিনী ছিল পুরোনো ও সীমান্তের তাৎক্ষণিক হুমকি মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নয়।

২০১৯ সালে পাকিস্তানের হাতে একটি ভারতীয় জেট ভূপাতিত হওয়ার অপমান ভারতের সামরিক শক্তির আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টায় গতি এনে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেনাবাহিনীতে কোটি কোটি ডলার ঢালেন। অস্ত্র কেনার জন্য নতুন আন্তর্জাতিক অংশীদার খুঁজে বের করেন। সেই সঙ্গে দেশীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়।

এসব প্রচেষ্টা আদৌ কতটা ফল দিয়েছে, তা হয়তো খুব শিগগির পরীক্ষা হয়ে যেতে পারে।

ভারত ও পাকিস্তান আবারও একটি সামরিক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীরে প্রাণঘাতী একটি সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। আর এই হামলার জন্য তারা পাকিস্তান সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ করেছে। উত্তেজনা বেড়ে এমন জায়গায় গেছে যে ভারত পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত একটি প্রধান নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এর আগে দুই দেশের একাধিক যুদ্ধের সময়েও তা কখনো করা হয়নি।

পাকিস্তান কাশ্মীর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সেই সঙ্গে এই পানিপ্রবাহ বন্ধের সিদ্ধান্তকে তারা ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

ভারতীয় কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ায় ভারতবাসী হতবাক হয়ে গেছেন। পাকিস্তানের ওপর আঘাত হানতে মোদি অভূতপূর্ব অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পড়েছেন। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংযোগ বহু আগেই স্তিমিত হয়ে গেছে। বৈশ্বিক শক্তিগুলো বর্তমানে অন্য সব সংকট নিয়ে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিচ্ছেন যে এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি ও বিপজ্জনক অচলাবস্থার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সামরিক বাহিনী এখনো রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মোদিকে সংযত থাকতে বাধ্য করতে পারে।

২০১৮ সালে একটি সংসদীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভারতের সেনাবাহিনীর ৬৮ শতাংশ সরঞ্জাম ছিল ‘প্রাচীন’, ২৪ শতাংশ বর্তমান সময়ের জন্য মানানসই এবং মাত্র ৮ শতাংশ ছিল সর্বাধুনিক। পাঁচ বছর পর, ২০২৩ সালের একটি হালনাগাদে সামরিক কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, চ্যালেঞ্জের বিশালতার কারণে অবস্থার যথেষ্ট পরিবর্তন আসেনি।

সংসদীয় সাক্ষ্যমতে, সর্বাধুনিক সামরিক সরঞ্জামের অনুপাত প্রায় দ্বিগুণ হলেও তা এখনো আধুনিক সেনাবাহিনীর চাহিদার তুলনায় অনেক কম। অধিকন্তু, অর্ধেকের বেশি সরঞ্জাম এখনো পুরোনো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই সীমাবদ্ধতার কারণে মোদি হয়তো আরও সীমিত ধরনের হামলার মধ্যে সীমিত থাকবেন। যেমন সীমান্তের কাছাকাছি ছোটখাটো বিমান হামলা বা বিশেষ বাহিনীর অভিযান। এতে জনরোষ প্রশমিত হবে, বিব্রতকর দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাবে আবার পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়াও খুব বেশি হবে না। পাকিস্তান ইতিমধ্যেই যেকোনো ভারতীয় হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

চ্যালেঞ্জ হলো এসব নতুন অস্ত্রব্যবস্থা এমন দক্ষতায় ব্যবহার করা, যাতে তা প্রতিপক্ষের কাছে ‘কার্যকর প্রতিরোধ’ হিসেবে প্রমাণিত হয়। শুক্লা বলেন, ‘আমি নিশ্চিত হতে চাই, যেন আমরা নিজেদের ধোঁকা না দিই।’

জনগণের আবেগ মোদিকে পাকিস্তানের ওপর আঘাত হানতে উদ্বুদ্ধ করলেও, ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই আবার তাকে চাপ দিতে পারে, যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়।

অন্যদিকে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে নেপথ্যে থেকে দেশ চালিয়ে এসেছে। তারা সম্ভবত রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে দিয়েই এই সংঘাতকে বাড়তে দেবে। এর ফলে সেনাবাহিনী দেশের ভেতরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারবে।

ভারত নিজেদের এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হাজির করছে, দেখাতে চাইছে যে তারা সহজেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে পারবে। যদি এই দাবির সত্যতা পরীক্ষার মুখে পড়ে, তাহলে আরেক প্রতিবেশী চীনও তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।

ভারত গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের তুলনায় চীনকে সীমান্তের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে হিমালয়ে ভারতীয় ও চীনা সেনাদের প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর। তা ছাড়া চীন বারবার ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশেও করছে।

এর মানে, ভারতের সামরিক নেতাদের এখন পাকিস্তান ও চীন—এই দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। এর ফলে সরবরাহ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে উঠবে।  

২০১৯ সালে পাকিস্তানের হাতে একটি ভারতীয় জেট ভূপাতিত হয়। ঘটনার এক বছরের কম সময় পর ২০২০ সালে ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত হয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় জেনারেল এবং দিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজের প্রধান দুষ্যন্ত সিং বলেন, সেই জেট ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা ভারতের জন্য একপ্রকার সতর্কবার্তা ছিল।

দুষ্যন্ত সিং বলেন, এর পর থেকে ভারত নিজেদের সামরিক ঘাটতি পূরণের জন্য বিভিন্ন পথ অনুসন্ধান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে নতুন মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সংগ্রহ করা হয়েছে। ফ্রান্স থেকে ডজন ডজন যুদ্ধবিমান আনা হয়েছে। কেনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও মিসাইল।

বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল অনির্ভরযোগ্য হয়ে পড়ায় ভারত নিজস্ব সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনেও প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এই উদ্যোগ এখনো ধীরগতিতে এগোচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর জন্য তা মজবুত ভিত্তি গড়ে দেবে।

দুষ্যন্ত সিং বলেন, ‘এই আধুনিকীকরণের ফলাফল রাতারাতি আসবে না। এতে সময় লাগবে।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের সামরিক আধুনিকীকরণের চ্যালেঞ্জ বহুস্তরীয়—প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিকও।

মোদি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটার প্রক্রিয়া সহজ করার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করছেন বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এ ছাড়া মোদি যে গুরুত্বপূর্ণ জেনারেলকে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনি ২০২১ সালে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এতে কাজ আরও জটিল হয়ে পড়ে।

ভারতের অর্থনীতি এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রায় ১০ গুণ বেশি। ফলে সামরিক বাহিনীর জন্য টাকা কোনো সমস্যা নয়। তবে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় এখনো মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশের কম। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, তা যথেষ্ট নয়। সরকারকে দেশের বিশাল জনগণের অন্যান্য প্রয়োজনীয়তার দিকেও মনোযোগ দিতে হচ্ছে।

২০২০ সালের চীনের সঙ্গে সংঘাতের পর চার বছরের জন্য ভারতকে সীমান্তে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন রাখতে হয়েছে। এর ফলে আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টা ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। আরেকটি বড় বাধা ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী রাশিয়া থেকে অস্ত্র আসা বিলম্বিত করেছে।

সরকারি সংসদীয় সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, অর্থ বরাদ্দ থাকলেও বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্ডারগুলো আটকে ছিল।

এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে ভারত সবচেয়ে জরুরি ঘাটতিগুলো পূরণের দিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন। পাশাপাশি, গোপন অভিযান বাড়ানো হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানভিত্তিক বহু ভারতবিরোধী জঙ্গিকে টার্গেট করে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে ইউক্রেনের পর ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক। পাকিস্তান ছিল পঞ্চম স্থানে।

রাশিয়া এখনো ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ভারতের রাশিয়া থেকে কেনাকাটা প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। ভারত এখন বেশি করে ঝুঁকছে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দিকে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে রাশিয়া থেকে কেনা পাঁচটি এস-৪০০ মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মধ্যে তিনটি মোতায়েন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে এই মিসাইল কেনায় কড়া আপত্তি জানিয়েছিল।

ফ্রান্স থেকে কেনা ৩৬টি রাফালে যুদ্ধবিমান ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে। আরও ২৬টি কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। ভারত নিজস্বভাবে তৈরি প্রচুরসংখ্যক যুদ্ধজাহাজও মোতায়েন করছে।

নতুন প্রযুক্তির প্রভাব সম্পর্কে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেন, রাফালের বিমান সংযুক্ত করাটা ভারতীয় বিমানবাহিনীর সক্ষমতায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছে। তবে শুক্লা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, চ্যালেঞ্জ হলো এসব নতুন অস্ত্রব্যবস্থা এমন দক্ষতায় ব্যবহার করা, যাতে তা প্রতিপক্ষের কাছে ‘কার্যকর প্রতিরোধ’ হিসেবে প্রমাণিত হয়।
শুক্লা বলেন, ‘আমি নিশ্চিত হতে চাই, যেন আমরা নিজেদের ধোঁকা না দিই।...ভয় হলো, যদি অস্ত্রব্যবস্থা থাকেও, শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনের সময় দেখা গেল যে আমাদের কাছে তা আসলে নেই।’

মুজিব মাশাল দ্য টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো চিফ  
সুহাসিনী রাজ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ জাভেদ হুসেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কারাগারে গাঁজা সরবরাহ করতে গিয়ে নিজেই কারাগারে
  • ডিইপিজেডে বিদ্যুৎ নেই, ৯০ কারখানায় ছুটি
  • মঙ্গলবার ৭ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব জায়গায়
  • পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে আরও ২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত
  • পর্তুগাল ও স্পেনে নজিরবিহীন বিদ্যুৎ বিপর্যয়, পর্যুদস্তু জনজীবন
  • হাসপাতালে ডায়রিয়ার প্রকোপ শয্যা ও স্যালাইন সংকট
  • বিদ্যুৎ না থাকায় ডিইপিজেডে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ
  • রাবিতে ছড়িয়ে পড়েছে ছোঁয়াচে রোগ ‘স্ক্যাবিস’
  • ভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম