৩৪ বছরেও টেকসই বেড়িবাঁধ পায়নি কুতুবদিয়ার মানুষ
Published: 29th, April 2025 GMT
কক্সবাজার সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়া দ্বীপের পশ্চিমাংশের এই এলাকাটি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। নিহত হয় চার হাজারের বেশি মানুষ। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সাগরে বিলীন হয়েছিল এই ইউনিয়নের অন্তত দেড় হাজারের বেশি ঘরবাড়ি-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা অবকাঠামো। পাশের আলী আকবরডেইল ইউনিয়নেও ঘূর্ণিঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের খুদিয়ারটেকসহ কয়েকটি গ্রামের ১০ হাজার ঘরবাড়ি। ভয়াল এই ঘূর্ণিঝড়ের পর তিন দশক পার হলেও এখনো জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো টেকসই বেড়িবাঁধ পাননি ইউনিয়ন দুটির বাসিন্দারা।
প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এলেই উপকূলের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে যায়, স্বজন হারানোর বেদনায় সিক্ত হন বাসিন্দারা। বিভীষিকার সেই রাত তাড়া করে তাঁদের। প্রতিবছরের মতো এবারও দিবসটি ঘিরে কুতুবদিয়ায় সভা, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। এসব কর্মসূচিতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং দ্বীপের জন্য ফেরি সার্ভিস চালুর দাবি তোলেন বাসিন্দারা।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বিদ্যমান ভাঙা বেড়িবাঁধটি সংস্কারের নামে টাকা খরচ হলেও তার সুফল পাচ্ছে না দ্বীপের মানুষ। গত তিন বছরে ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ করা হলেও এখনো ৭-৯ কিলোমিটার বাঁধ ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯৯১ সালের ২২ এপ্রিল বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ২৪ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে ঘূর্ণিঝড়টি ২৯ এপ্রিল রাতে ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার (১৫৫ মাইল) বেগে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে। এর প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়াসহ উপকূলীয় এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সরকারি হিসাবে, ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলায় ১০২টি উপজেলায় মৃত্যু হয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জনের। ১০ লাখের বেশি ঘরবাড়ির বিলীন হওয়ায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন ১ কোটির বেশি মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার জেলাতে মৃত্যু হয়েছিল ৮৪ হাজার মানুষের। এর মধ্যে কুতুবদিয়াতেই মারা গেছেন ১৮ হাজার।
বেড়িবাঁধে বিপন্ন জীবন
কৈয়ারবিল ইউনিয়নের সাগর তীরবর্তী এলাকা হাজি মফজল মিয়াপাড়া ও মৌলভিপাড়া। গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বেড়িবাঁধ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। আশপাশে বাঁশ-কাঠ-পলিথিন ও টিনের ছাউনিযুক্ত খুপরি তৈরি করে বসতি করছে মানুষ। বাসিন্দারা জানান, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস সাগর কিছুটা শান্ত থাকে। এপ্রিল-মে থেকে বছরের অবশিষ্ট সাত মাস উত্তাল থাকে সাগর। তখন দেখা দেয় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। তখন আতঙ্কে দিন কাটে তাঁদের।
সরেজমিন দেখা যায়, জোয়ারের পানিতে বেশ কিছু ঘর প্লাবিত হচ্ছে। ঘরের উঠানে রোপণ করা কিছু নারকেলগাছ সাগরে বিলীন হওয়ার পথে। এর মধ্যেই সৈকতে উৎপাদন হচ্ছে শুঁটকির। শুঁটকি মহালের পাশে ছোট্ট একটি খুপরিতে বসবাস করেন বৃদ্ধা লায়লা বেগম। জীবনে তিনি ৬০টির বেশি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখেছেন বলে জানান। ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে নিজের চার মেয়েকে হারিয়েছেন জানিয়ে লায়লা বেগম (৬৭) প্রথম আলোকে বলেন, সাগরে দিন দিন বিলীন হচ্ছে দ্বীপ। গত তিন দশকে বসতবাড়ি ও পেশা হারিয়ে দ্বীপের ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ অন্য স্থানে চলে গেছেন। যাঁরা রয়ে গেছেন, সবাই আশায় বুক বেঁধে আছেন কখন একটি টেকসই বেড়িবাঁধ হবে।
লায়লা বেগম বলেন, ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের আগে তাঁর বসতবাড়ি ছিল দুই কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মধ্যেই। তখন তার পাঁচ কানি (দুই একর) জমি ও বসতঘর ভেসে গিয়েছিল। গত তিন দশকে তিনি চারবার ঘর পাল্টিয়েছেন। এখন যে ঘরে থাকছেন, সেটিও জলোচ্ছ্বাসের প্লাবিত হয়।
লায়লা বেগমের ছেলে ফরিদুল আলম (৪৬) বলেন, বর্ষাকালে গ্রামের কয়েক হাজার মানুষকে চরম আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়। দুর্যোগের সংকেত পড়লেই শুরু করতে হয় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়ঝাঁপ।
ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের ৩৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই রাতের বিভীষিকা ভুলতে পারেননি হাজি মফজল পাড়ার কৃষক আলী হোসেনও (৫৮)। ঘূর্ণিঝড়ে সময় তিনি দুই ভাই, দুই বোন ও তিন সন্তানকে হারিয়েছেন। বর্তমানে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে আলী হোসেনের সংসার। আলী হোসেন বলেন, তাঁর বাড়িটি যে জায়গায় ছিল, এখন সেখানে জাহাজ নোঙর করে। জায়গাটি তীর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে। জলোচ্ছ্বাসে ভিটেবাড়ি বিলীন হওয়ায় গত ২৬ বছরে তিনি চারটি ঘর পাল্টিয়েছেন। এবার ঘরটি বিলীন হলে আর কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা থাকবে না।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার আলী আকবরডেইল ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ভেঙে অচল হয়ে পড়েছে দেশের সর্ববৃহৎ বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সম্প্রতি তোলা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ট কসই ব ড় ব ঘ র ণ ঝড় উপক ল
এছাড়াও পড়ুন:
পরিবারের আটজনকে হারানোর স্মৃতি এখনো ভোলেননি মরিয়ম-কালাম দম্পতি
১৯৯১–এর ঘূর্ণিঝড়ে নিজেদের এক মেয়েসহ পরিবারের আটজন সদস্যকে হারান আবুল কালাম ও মরিয়ম বেগম দম্পতি। ৩৪ বছর পরও এখনো ভয়াল সেই স্মৃতি ভুলতে পারেননি তাঁরা। এখনো ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে পড়লে দুজন আঁতকে ওঠেন।
আবুল কালাম ও মরিয়ম বেগম চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার উপকূলীয় জুঁইদণ্ডী ইউনিয়নের হাজি চাঁদ মিয়া মাঝির বাড়ির বাসিন্দা। গতকাল সোমবার বাড়িতে গিয়ে দেখা হয় দুজনের সঙ্গে। আবুল কালাম ২০১৮ সালে অসুস্থ হয়ে বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। অবশ হয়ে যায় তাঁর দুটি হাতও। তিনি কথা বলতে না পারায় মরিয়ম বেগম ঘটনার বর্ণনা করেন।
মরিয়ম জানান, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁর স্বামী, এক কন্যা, শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্যেই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে যে যাঁর মতো ছুটতে থাকেন। সকালে মরিয়ম দেখেন, চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ। পরনের কাপড় নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজন স্বজনদের খুঁজতে থাকেন। ঘরের ভেতরেই পান তাঁর মেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবরসহ পরিবারের ছয় সদস্যের লাশ। পরিবারের আরও দুই সদস্যের সন্ধান আর পাননি। মরিয়ম বলেন, ‘সব কটি লাশ মাটি খুঁড়ে এক কাপড়ে দাফন করা হয়। কাফনের কাপড় ছাড়া লাশগুলো মাটিচাপা দেওয়া হয়।’
নিজের এক মেয়েকে কীভাবে রক্ষা করেন, সেই বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমার মেয়ে তানজিনার বয়স তখন চার বছর। তার পরনের কাপড় দাঁতে চেপে ধরে তাকে নিয়ে গাছে উঠে যাই। তখন মনে হয়েছিল, মেয়ে বুঝি মারা গেছে। তবে মেয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল’। মরিয়ম আরও বলেন, ‘এরপর ৩৪ বছর কেটে গেছে। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, আরেক ছেলের জন্য কনে খুঁজছি। তবু সেই দিনগুলোর কথা ভুলতে পারি না।’
আনোয়ারা উপকূলে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের কারণে এখনো জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানির ঝুঁকি রয়ে গেছে