নবীজির (সা.) প্রতি দরুদ পাঠের উপকারিতা অনেক। সাধারণত প্রতিদান হিসাবে একবার দরুদ পাঠ করলে দশটি রহমত, দশটি পাপ মাফ এবং বেহেশতে দশ স্তরের মর্যাদার কথা জানা যায়। এ ছাড়াও দরুদ পাঠের আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে, যা সাধারণত খুব একটা আলোচনা করা হয় না।
প্রথমত, দরুদ পড়া আল্লাহর হুকুম। আল্লাহর হুকুম পালন করলে তিনি খুশি হন এবং তার নৈকট্য অর্জন হয়। দরুদ পড়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ রাসুলের ওপর ‘সালাত’ পড়েন। ইমানদারগণ, তোমরাও তার নামে দরুদ পড়ো এবং অধিক পরিমাণে সালাম পাঠাও। (সুরা আহজাব, আয়াত: ৫৬)
দ্বিতীয়ত, দরুদ পড়া আমাদের ওপর নবীজির (সা.
তৃতীয়ত, নবীজির (সা.) প্রতি দরুদ পাঠের মাধ্যমে তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন তাঁর ওপর রহমত করেন। আর দোয়া একটি ইবাদত। নু’মান ইবনে বাশির (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, ‘দোয়া হলো ইবাদত। তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, ‘তোমরা আমার কাছে দোয়া করো, আমি কবুল করব’ (সুরা গাফির: ৬০)।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১,৪৬৯)
সুতরাং যখন আমরা বারবার দরুদ পড়ব, তখন প্রকারান্তরে আমরা ইবাদতের মধ্যে থাকব।
চতুর্থত, দরুদ পাঠের সওয়াব আল্লাহর কাছে জমা থাকে। যেমন, আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পড়বে, আল্লাহ তাকে দশবার রহমত করবেন।’ এই ‘রহমত’ দ্বারা উদ্দেশ্য কেবল পার্থিব নয়, বরং পরকালের কঠিন সময়ে আল্লাহর রহমতের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি।
পঞ্চমত, দরুদ পাঠ করা আল্লাহর পক্ষ হতে মুমিনদের জন্যে একটি সম্মান। সাইয়েদ কুতুব (রহ.) বলেছেন, ‘আল্লাহ মুমিনদের দুরুদকে তার দুরুদের সঙ্গে এবং তাদের সালামকে তার সালামের সঙ্গে মিলিয়ে নেন।’ (সুরা আহজাবের ৫৬ নম্বর আয়াতের তাফসির, তাফসিরে ফি জিলালিল কুরআন)
আরও পড়ুননামাজ: দাসের মহিমা০৪ মার্চ ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দর দ প ঠ র আম দ র আল ল হ বল ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
‘তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না’
পবিত্র কোরআনের অন্যতম সুন্দর একটি ঘোষণা হলো, আল্লাহর পথে চলা মুমিনদের জন্য দুশ্চিন্তা ও ভয়ের অনুপস্থিতি। আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ১১২ নম্বর আয়াতে বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মশীল হয়, তার জন্য তার প্রতিদান তার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১১২)
এই আয়াতে একটি চমৎকার অলঙ্কারিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। যদি লক্ষ্য করা যায়, আয়াতের প্রথম অংশে আল্লাহ একবচনের সর্বনাম ব্যবহার করেছেন, ‘মান’ (যে ব্যক্তি) এবং ‘ওয়াজহাহু’ (তার চেহারা), ‘ফালাহু’ (তার জন্য) এবং ‘আজরুহু’ (তার প্রতিদান)।
কিন্তু আয়াতের শেষাংশে এসে সেই ব্যক্তির প্রতিদান এবং মুক্তির ঘোষণা করার সময় আল্লাহ হঠাৎ বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহার করলেন, ‘আলাইহিম’ (তাদের উপর) এবং ‘লা ইয়াহ্যানুন’ (তারা চিন্তিত হবে না)।
এই আকস্মিক পরিবর্তন কেন? একবচনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘ফা-লা খাওফা আলাইহি ওয়া লা হুয়া ইয়াহ্যান’ (তার কোনো ভয় নেই এবং সে চিন্তিত হবে না) বলা হলো না কেন? এই বহুবচনে রূপান্তরের নেপথ্যে কী প্রজ্ঞা ও সৌন্দর্য নিহিত?
একবচনের পর বহুবচনের কারণ: দুটি ব্যাখ্যাএই অলঙ্কারিক প্রশ্নের জবাবে তাফসির ও ভাষাতত্ত্বের পণ্ডিতগণ দুটি প্রধান ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
১. প্রচলিত ব্যাখ্যা: ‘মান’-এর তাৎপর্য
প্রথম ও প্রচলিত ব্যাখ্যাটি হলো, পূর্ববর্তী যুগের পণ্ডিতদের দেওয়া যুক্তি। তাঁরা বলেন, এই পরিবর্তন ঘটেছে ‘মান্’ বা ‘যে ব্যক্তি’ শব্দটির অর্থগত দিক বিবেচনা করে।
‘মান্’ যদিও দেখতে একবচন বা একক ব্যক্তিবাচক বিশেষ্য, কিন্তু এটি এমন একটি নাম যা বহু লোককে অন্তর্ভুক্ত করে। অর্থাৎ, ‘যে ব্যক্তি’ বলতে এখানে সেই দলের সবাইকে বোঝানো হচ্ছে, যারা এই শর্তগুলো পূরণ করবে।
আরও পড়ুন‘তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না’১২ নভেম্বর ২০২৫আরবি ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে, যখন এমন একটি শব্দ (যেমন ‘মান্’) ব্যবহৃত হয় যা শব্দে একবচন হলেও অর্থে বহুবচন, তখন পরের অংশকে শব্দের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একবচন রাখা যায়, অথবা অর্থের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বহুবচন ব্যবহার করা যায়।
এক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা একবচনের পর বহুবচন ব্যবহার করে ‘মান্’-এর অর্থের ওপর জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ, যারা যারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে সৎকর্ম করবে, তাদের সবাই এই পুরস্কার লাভ করবে। এটি হলো বাহ্যিক কারণ।
২. নির্বাচিত পরিবর্তন: গভীর মনস্তাত্ত্বিক কারণ
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি প্রথমটির কারণ অনুসন্ধানের একটি গভীরতর উত্তর। এটি শুধু ব্যাকরণগত কারণ নয়, বরং এখানে বহুবচন ব্যবহারের বিশেষ রহস্য বা প্রজ্ঞা কী ছিল? কেন আল্লাহ একবচনের ধারাবাহিকতা বজায় না রেখে বহুবচনের অর্থের উপর জোর দিলেন?
এর উত্তর খুঁজে বের করতে গবেষকরা কোরআনে মুমিনদের প্রসঙ্গে ‘লা খাওফুন আলাইহিম ওয়া লা হুম ইয়াহ্যানুন’ (তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না) বাক্যটির ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করেছেন। দেখা যায়, এই বাক্যটি কোরআনের বিভিন্ন স্থানে তেরো বার এসেছে এবং প্রতিবারই তা বহুবচন-এর কাঠামোয় এসেছে।
যেমন:
সুরা বাকারা, আয়াত: ৩৮: “অতঃপর আমার পক্ষ থেকে যখন তোমাদের নিকট পথের নির্দেশ আসবে, তখন যারা আমার পথের নির্দেশ অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিত হবে না।”
সুরা আন’আম, আয়াত: ৪৮: “আর আমরা তো রাসুলদেরকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপেই প্রেরণ করি। সুতরাং যারা ইমান আনে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়, তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিত হবে না।”
সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৩৫: “অতএব, তোমাদের নিকট যখন তোমাদের মধ্য থেকে রাসুলগণ এসে আমার আয়াতগুলো শুনিয়ে দেবে, তখন যারা তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করবে, তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না।”
এই বহুবচনের ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জন্য একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রশান্তি নিশ্চিত করেছেন।
আরও পড়ুনকোরআনের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে ‘কোরআন জার্নালিং’২২ জুলাই ২০২৫ঐক্য ও সাহচর্য: মানুষ সম্মিলিত জীবন ও ঐক্যের মাধ্যমে মানসিক স্বস্তি লাভ করে এবং একাকীত্ব দূর হয়। বহুবচন ব্যবহার করার কারণে মুমিনদের এই ঘোষণাটি এমনভাবে আসে যে, তারা সবাই একত্রে এই ভয় ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাচ্ছে। এটি ভীতি ও দুশ্চিন্তা দূর করার পাশাপাশি ঐক্যের মাধ্যমে মানসিক স্বস্তি এনে দেয়।
নিরাপত্তার নিশ্চয়তা: এই বহুবচন যেন মুমিনদের প্রতি এক সুদৃঢ় বার্তা—তারা সবাই একই পথের যাত্রী এবং সবাই সম্মিলিতভাবে আল্লাহর এই নিরাপত্তা লাভে ধন্য।
আধ্যাত্মিক ইঙ্গিত: শাফা'আত ও সম্মিলিত রহমতএই বহুবচনের ব্যবহারে আরও একটি আধ্যাত্মিক ইঙ্গিত থাকতে পারে। অর্থাৎ, এই ভয় ও দুশ্চিন্তা তাদের কাছ থেকে সম্মিলিতভাবে দূর করা হয়েছে। এর কারণ হতে পারে:
পারস্পরিক সুপারিশ: আখেরাতে মুমিনরা একে অপরের জন্য সুপারিশ লাভের সুযোগ পাবে। মুমিনদের সম্মিলিত প্রার্থনা ও সুপারিশের কারণে তাদের ভয় ও দুঃখ দূর হতে পারে।
সম্মিলিত রহমত: যারা সৎকর্মশীলদের সঙ্গে একত্রে জীবনযাপন করেছে, তাদের সাহচর্যের বরকতে তারা আল্লাহর সম্মিলিত রহমত লাভ করবে। এই কারণেই বলা হয়, "সৎকর্মশীলদের সঙ্গী দুর্ভাগা হয় না।" এই সম্মিলিত রহমতের কারণেও হয়তো তাদের ভয় ও দুঃখ দূর হবে।
শেষ কথাকোরআনের ১১২ নং আয়াতে একবচনের পর বহুবচন ব্যবহার করা কেবল ব্যাকরণগত স্বাধীনতা নয়, বরং এটি একটি সুনিপুণ অলঙ্কারিক কৌশল।
এই পরিবর্তনের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা একদিকে যেমন ঘোষণা করেছেন যে, আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি (মান্)-এর জন্য সুনিশ্চিত প্রতিদান রয়েছে, তেমনি অন্যদিকে বহুবচনের মাধ্যমে মুমিনদের জন্য সম্মিলিত মানসিক প্রশান্তি, ঐক্য ও নিরাপত্তার বার্তা দিয়েছেন। মুমিনদের ভয় ও দুশ্চিন্তা দূর করার এই ঘোষণাটি যেন কেবল একটি ব্যক্তিগত পুরস্কার নয়, বরং একটি দলগত মুক্তির ঘোষণা, যা তাদের মনে শান্তি ও ভরসা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এই আয়াতটি মুমিনদের মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় করে যে, তারা একা নয়, বরং সবাই মিলে এক নিরাপদ কাফেলা, যাদের জন্য আল্লাহ এই দুনিয়া ও আখেরাতে রেখেছেন পরম নিরাপত্তা ও শান্তি।
আরও পড়ুন‘তোমরাও তো এমনই ছিলে, আল্লাহ তোমাদের অনুগ্রহ করেছেন’১১ নভেম্বর ২০২৫