দেশের হাওর অঞ্চলে এখন পুরোদমে চলছে ধান কাটা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষকের বিরাম নেই। ব্যস্ততা ছিল ইন্দ্রজিৎ দাস ও স্বাধীন মিয়ারও। ধান কাটতেই গিয়েছিলেন ফসলের মাঠে। দুজন পাশাপাশি মাঠে ফসল কাটছিলেন। হঠাৎ আকাশ কালো করে আসে মেঘ। সঙ্গী কৃষকেরা সেই মেঘ দেখে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান; কিন্তু যাননি এই দুই কৃষক। একটু বাড়তি ধান কেটে সময় বাঁচানো, কিছু বেশি আয় করা, নিজেদের সাশ্রয়? কে জানে!

কিন্তু সেই ফসল কাটাই কাল হলো দুজনের জন্য। সকাল পৌনে ১০টার দিকে বজ্রপাতসহ বৃষ্টি শুরু হয়। তখন বজ্রপাতে দুজনেরই মৃত্যু হয়। দুই কৃষকের জীবন সমাপ্ত হয়, ব্যস্ততার হয় অবসান।

বজ্রপাতে নিহত দুই কৃষক ইন্দ্রজিৎ দাসের (৩০) বাড়ি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের হালালপুরে এবং স্বাধীন মিয়ার (১৫) বাড়ি একই উপজেলার খয়েরপুর গ্রামে।

শুধু এই দুজন নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত রোববার ও গতকাল সোমবার বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার রাত থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত সময়ে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরে ২৪ ঘণ্টায় বজ্রপাতে এটি সর্বোচ্চ মৃত্যু বলে জানিয়েছে দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরাম।

বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লার মুরাদনগর, দেবীদ্বার ও বরুড়া উপজেলায় পাঁচজন, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ও মিঠামইনে তিনজন, নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও মদনে দুজন এবং সুনামগঞ্জের শাল্লা, চাঁদপুরের কচুয়া এবং হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে একজন করে বজ্রপাতে মারা আছেন। চলতি বছর ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে আর এত মৃত্যু হয়নি বলে জানান ডিজাস্টার ফোরামের সমন্বয়কারী মেহেরুন নেছা। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোববার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত বজ্রপাতে এ বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে। এর আগে চলতি মাসের ১৬ তারিখ বজ্রপাতে নয়জনের মৃত্যু হয়েছিল।

ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য, গতকালের এ মৃত্যু নিয়ে বজ্রপাতে চলতি মাসে ৪৫ জনের মৃত্যু হলো। এটিও এ বছরের সর্বোচ্চ। আর এ মাসে বজ্রপাতে ৩০ জন আহত হয়েছেন।

মেহেরুন নেছা বলছিলেন, বজ্রপাতে নিহত হওয়ার সংখ্যাটাই কেবল খবর হয়; কিন্তু এতে যে অনেক মানুষ আহত হয়, তা নিয়ে কথা তেমন হয় না। অথচ বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের ভোগান্তি অনেক।

হাওর এলাকায় বেশি মৃত্যু, কৃষকই বড় ভুক্তভোগী

গত রোববার থেকে সোমবার পর্যন্ত বজ্রপাতে নিহত ১৩ জনের মধ্যে ৭ জনেরই মৃত্যু হয়েছে হাওর এলাকার। নিহত এসব মানুষের বেশির ভাগই কৃষিজীবী।

দেশে প্রায় প্রতিবছর বজ্রপাতে যত জনের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে বেশির ভাগ মৃত্যুই হয় জলাভূমির হাওর অঞ্চলে।

গতকাল হাওরের জেলা কিশোরগঞ্জে তিনজন, নেত্রকোনায় দুজন, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে একজন করে মারা যান বজ্রপাতে।

বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজন কৃষক। যে দুজনের কথা দিয়ে এ প্রতিবেদন শুরু হয়েছিল, তাঁরা ধান কাটতেই গিয়েছিলেন মাঠে। হাওরের জেলা ছাড়া কুমিল্লায় যে দুজনের মৃত্যু হয়, তাঁরাও কৃষক। দুজনের নাম নিখিল দেবনাথ (৫৮) ও জুয়েল ভূঁইয়া (৩০)। দুজনেরই বাড়ি জেলার মুরাদনগর উপজেলায়।

দুর্যোগবিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন হাওরে ধান কাটার সময়। খোলা এই প্রান্তরে কৃষকের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয়। এখন কৃষকদের সতর্কতা নিতে হবে। মেঘ দেখলে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।

বজ্রপাতে প্রাণ হারালেন কৃষিকাজে থাকা ৩ নারী

গত ২৪ ঘণ্টায় নিহত ১৩ জনের মধে৵ তিনজন নারী। তাঁদেরই একজন বিশাখা রানী (৩৫)। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের নাহারা গ্রাম। বিশাখা ওই এলাকার কৃষক হরিপদ সরকারের স্ত্রী।

কচুয়া থানার ওসি আজিজুল ইসলাম জানান, বাড়ির পাশে স্বামী-স্ত্রী মিলে নিজ জমি থেকে ধান তুলছিলেন। এ সময় কাছাকাছি কোথাও বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। এ সময় বিশাখা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার আড়িয়ামুগুর হাওরে গতকাল বজ্রপাতে দুর্বাসা দাস (৩৫) নামে এক ধান কাটা শ্রমিক প্রাণ হারান।

মিঠামইন উপজেলার শান্তিগঞ্জ হাওরে বজ্রপাতে ফুলেছা বেগম (৬৫) নিহত হন গতকাল। মিঠামইন থানার এসআই অর্পণ বিশ্বাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সকালে বাড়ির পাশে ধানের খড় শুকাতে দিচ্ছিলেন ফুলেছা বেগম। এ সময় বজ্রপাতে তাঁর মৃত্যু হয়।

বজ্রপাতের ঝুঁকি সামলাতে যা করতে হবে

দেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বজ্রপাতের সংখ্যা এবং তীব্রতা বাড়ে। দিন দিন দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ‘বজ্রপাতের সতর্কতা’ আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে।

এপ্রিল থেকে মে মাসে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি হয় সাধারণত। এর কারণ প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, এ সময় কালবৈশাখীর প্রকোপ বাড়ে। এ ধরনের ঝড়ের বৈশিষ্ট্য হলো এর সঙ্গে থাকে বজ্রপাত, ঝোড়ো হাওয়া, শিলাবৃষ্টি।

বজ্রপাতের ঝুঁকি প্রশমনে একগুচ্ছ সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর মধ্যে আছে বজ্রপাতের জানালা ও দরজা বন্ধ রাখতে হবে, গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশগুলোর প্লাগ খুলে রাখতে হবে, জলাশয়ে থাকলে দ্রুত উঠে আসতে হবে এবং অবশ্যই বিদ্যুৎ পরিবাহক বস্তুর ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে এবং সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে।

মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, এখন যে ঝড়-বৃষ্টি হয়, তা খুব বেশি সময় ধরে থাকে না। তাই মেঘ দেখলে অন্তত আধা ঘণ্টা সময়ও যদি নিরাপদে থাকা যায়, তবে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

দেশে টানা প্রায় চার দিনের তাপপ্রবাহ শেষে গত রোববার রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গতকালও চট্টগ্রাম বিভাগে কিছুটা কম হলেও অন্য বিভাগের প্রায় সবখানে বৃষ্টি হয়। এর মধ্যে সিলেটে সর্বোচ্চ ১১৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আজ মঙ্গলবার দেশের রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।

আবহাওয়াবিদ মো.

ওমর ফারুক বলেন, আজ মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাত হতে পারে। তাই সাবধানতা রাখতে হবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ ও ভৈরব, হবিগঞ্জ; প্রতিনিধি, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও চাঁদপুর]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জন র ম ত য ক শ রগঞ জ ১৩ জন র ম উপজ ল র দ জন র ন র পদ এ সময় গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজের আগুনে পাঁচজন দগ্ধ

গাজীপুরে একটি বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডারের লিকেজের আগুনে পাঁচজন দগ্ধ হয়েছেন। গতকাল রোববার রাত আটটার দিকে নগরের মোগরখাল মোল্লা মার্কেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। দগ্ধদের ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গাজীপুর নগরের মোগরখাল মোল্লা মার্কেট এলাকার একটি বাসায় গতকাল রাত আটটার দিকে পারভিন আক্তার নামের এক নারী রান্না করছিলেন। এ সময় গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে হঠাৎ আগুন ধরে যায়। এতে পারভিনসহ পাঁচজন দগ্ধ হন। তাঁদের প্রথমে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁদের ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়।

দগ্ধ অন্য চারজন হলেন সীমা আক্তার (৩০), তাসলিমা আক্তার, পারভিন আক্তারের দেড় বছরের ছেলে আয়ান, শেফালী বেগম (৪০) ও তাঁর মেয়ে তানজিলা।
বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কায়সার আহমেদ বলেন, গ্যাস লিকেজ থেকে আগুনে পাঁচজন দগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের উদ্ধার করে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ওসি জানান, তাসলিমার শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া দুজন ৯০ শতাংশ, একজন ৩২ শতাংশ ও অন্য একজন ২৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ কর্মীকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে থানা ঘেরাও
  • সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তরুণকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে নিহত যুবদল কর্মী
  • ৯ জেলায় বজ্রপাতে ১৫ জনের মৃত্যু
  • ৭ জেলায় বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যু
  • ৬ জেলায় বজ্রপাতে ১২ জনের মৃত্যু
  • ভারতে পুলিশ বাহিনীর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যের ওপর হামলা
  • আর্নে স্লট: কিংবদন্তির জায়গা নিলেন এবং নিজেই কিংবদন্তি হয়ে গেলেন
  • পেহেলগামের ঘটনায় একের পর এক বাড়ি ধ্বংস, সরকারকে সতর্ক করল কাশ্মীরের দলগুলো
  • গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজের আগুনে পাঁচজন দগ্ধ