মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে মার্কিন তৎপরতা
Published: 28th, April 2025 GMT
বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতি এবং কূটনীতির ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান কিছু পরিবর্তন ও সমীকরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন এ মুহূর্তে যে বিষয়টি আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে সেটি হচ্ছে, প্রতিবেশী মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ইস্যু। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক ও বৃহৎ পরাশক্তিগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের সেই পারস্পরিক স্বার্থ ও সমীকরণ যেমন এক ধরনের বোঝাপড়া গড়ে তুলেছে, তেমনি একে অন্যের প্রতি সতর্ক অবস্থানও তৈরি করছে। কেননা, এখানে সব পক্ষের স্বার্থের হিসাব এক নয়। আছে বিভিন্ন পক্ষের নিজস্ব এজেন্ডা।
চীন-রাশিয়া ও কিছু ক্ষেত্রে ভারতের বলয়ে থাকা মিয়ানমার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির আগ্রহ নতুন নয়; কিন্তু কোনোভাবেই তারা এখানে সুবিধা করতে পারছিল না। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও আরাকান আর্মির অগ্রগতি তাদের সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা এখন মানবিক সাহায্যের কৌশলে এখানে তাদের কর্তৃত্ব, প্রভাব ও অবস্থান বাড়াতে চায়।
আমরা দেখেছি, গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে এসেছিলেন। সেটা কতখানি রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তামূলক সফর; কতখানি মিয়ানমার বিষয়ে পশ্চিমা ছকের অংশ, তা ভবিষ্যতে আরও স্পষ্ট হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেই সফরে তিনি আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশকে। এ ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল, আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য দখল ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিলে তখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে।
সাদা চোখে এই সরল কৌশল সামনে রেখে গুতেরেস বলেছেন, জাতিসংঘের দাতা দেশগুলোও রাখাইন রাজ্যে তাদের সাহায্য সরবরাহের একটি নিরাপদ করিডোর চায়। সেখানে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য করিডোরটি প্রয়োজন; যদিও তিনি কোনো সামরিক সাহায্যের বিষয়ে কিছু বলেননি। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, রাখাইনের জন্য করিডোর দিতে অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে (সমকাল, ২৮ এপ্রিল ২০২৫)।
বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) তৎপরতা দৃশ্যমান না হলেও অজানা নয়। সীমান্তের বাইরে আরাকান আর্মি ও চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের যোদ্ধারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে উৎখাত করে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টায় যুদ্ধরত। সেটা না হলেও আপাত তাদের লক্ষ্য আরাকান রাজ্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
মার্চ মাসে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা লে.
চলতি মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে আসেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন মার্কিন নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশে তারা বৈঠক করেন। সেখানে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, বাংলাদেশের মিডিয়ায় তেমন আলোকপাত হয়নি। যদি সামরিক সহায়তার আলোচনা থেকে থাকে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে?
আরও প্রশ্ন হচ্ছে, কোন কোন দেশ মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে? মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাশের চিন রাজ্যটিও আরাকান আর্মি দখল করেছে। এ অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর নাম ‘চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’। এরা যৌথভাবে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এই চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের এক সময়ের আলোচিত সন্ত্রাসী সংগঠন ‘কুকি চিন গোষ্ঠী’র যোগাযোগ থাকার সংবাদ বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় এসেছিল।
এটা স্পষ্ট, আরাকান আর্মি ও চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এ দুই শক্তিকে সমর্থন দিয়ে মিয়ানমার সামরিক জান্তাকে উৎখাতে ইন্ধন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতও। তারাও আরাকান আর্মির রাখাইন রাজ্যের পূর্ণ দখল দেখতে চায়। তাদের স্বার্থ ভারতের মিজোরামের সঙ্গে থাইল্যান্ডের সংযোগ। বাংলাদেশে আত্মগোপনে থাকা আরসাপ্রধানের হঠাৎ গ্রেপ্তারের কারণ যা-ই হোক; এই অঙ্ক মেলানো যায়, জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরসা ও আরাকান আর্মির সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া গেলে সেটা হবে রাখাইনের ‘গেম চেঞ্জার’।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব হিসাব-নিকাশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রসঙ্গটি কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে? বাংলাদেশের প্রধান এজেন্ডা সেটাই হওয়া উচিত। আরাকান আর্মির রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর যে কৌশলের কথা বলা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে জান্তা সরকার চীন-রাশিয়ার সমর্থনে টিকে আছে। শুধু তাই নয়; বিদ্রোহীদের সঙ্গেও চীনের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত যোগাযোগ আছে। চীন বঙ্গোপসাগর এলাকাজুড়ে কৌশলগত অবস্থান ও নিজেদের সামরিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে চীন থেকে সাবমেরিন কেনা হয়েছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েই সমাধান চেয়ে এসেছে। বঙ্গোপসাগর ঘিরে এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া কি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে? এ কারণেই কি তাদের তিনটি যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশে ‘শুভেচ্ছা সফর’ করেছিল?
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যের ক্ষমতা কাঠামোর এই পরিবর্তনের পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর যুক্তিকে সমর্থন করা যেতে পারে। কিন্তু সীমান্ত খুলে দেওয়ার মাধ্যমে কোনো আঞ্চলিক প্রক্সি যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি সমীচীন হবে না।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ও আর ক ন আর ম আর ক ন আর ম র র খ ইন র জ য পর স থ ত ত অবস থ ন কর ড র
এছাড়াও পড়ুন:
অভিযান, পণ্য জব্দের পরও দমছে না চোরাকারবারিরা
দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে নজরদারি। নিরাপত্তা চৌকিতে বিজিবির তৎপরতাও কম নয়। এরপরেও সিলেটের দুর্গম সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে থামছে না চোরাচালান। স্থানীয়রা বলছেন, দুর্গম অঞ্চলের সীমান্ত জোনে স্থানীয়দের সহায়তা পায় তারা।
সিলেট সীমান্তে বারবার অভিযানে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পণ্যদ্রব্য উদ্ধার করা হচ্ছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোটি কোটি টাকার পণ্যদ্রব্য উদ্ধার করা হলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে চোরাকারবারি ও বহনকারীরা। এ ছাড়া এসব পণ্য কোন চক্রের মাধ্যমে বাজারে নিয়ন্ত্রিত হয়, তার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
এক সপ্তাহ আগে আড়াই কোটি টাকার পণ্য উদ্ধারের পর শনিবার সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) আওতাধীন সিলেট জেলার বিভিন্ন সীমান্ত থেকে ৬ কোটি টাকার পণ্য উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে পণ্যবাহী তিনটি ট্রাকও রয়েছে।
জানা গেছে, শনিবার বিজিবি-৪৮ এর উপঅধিনায়ক মেজর নূরুল হুদার নেতৃত্বে সীমান্তে পৃথক অভিযান পরিচালনা করা হয়। তামাবিল, প্রতাপপুর, সংগ্রাম ও শ্রীপুর সীমান্তে অভিযানকালে অবৈধভাবে ভারত থেকে আনা বিপুল পরিমাণ পণ্যসহ চোরাচালানের মালপত্র পরিবহনে ব্যবহৃত তিনটি ট্রাক ও পিকআপ জব্দ করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ভারতীয় এসব পণ্যের মূল্য ৬ কোটি টাকা বলে বিজিবি জানিয়েছে।
এর আগে গত ১৬ এপ্রিল ৪৮ বিজিবি বিছনাকান্দি, সোনারহাট, পান্থুমাই, সংগ্রাম, লাফার্জ, বাংলাবাজার, প্রতাপপুর, উৎমা ও শ্রীপুর বিওপি ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার চোরাচালানের মালপত্র জব্দ করে। ১৪ এপ্রিল ভারতীয় দুম্বা, ছাগলসহ ৬১ লাখ টাকার এবং ১২ এপ্রিল ১ কোটি ২৮ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য উদ্ধার করে বিজিবি।
জানা গেছে, সিলেটের চোরাচালানের পণ্য নিয়ন্ত্রণকারী জৈন্তাপুরের হরিপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের এরই মধ্যে তছনছ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। সেখানে অভিযান পরিচালনার পর চোরাকারবারিরা রুট পরিবর্তন করে নানা কৌশলে বিভিন্ন স্থানে পণ্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আগে হরিপুর বাজারের গুদামে রাখা হতো চোরাই পণ্য। সেসব গুদামে ব্যবসায়ীরা এখন আগের মতো ভারতীয় পণ্য রাখার সাহস পাচ্ছেন না। তারা সরাসারি সীমান্ত থেকে পণ্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এ কারণেই সীমান্তে চোরাই পণ্যের প্রবাহ বেড়েছে।
চোরাকারবারি ও বহনকারীদের আটক প্রসঙ্গে ৪৮ বিজিবি অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল নাজমুল হক সমকালকে জানান, অভিযানের সময় বিজিবির তৎপরতা টের পেয়ে পণ্য ফেলে পালিয়ে যান চোরাকারবারি চক্রের সদস্যরা। যার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের আটক করা সম্ভব হয় না। বিজিবি যেমন অভিযান করছে, তেমনি চোরাকারবারিদের একটা নেটওয়ার্কও রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা খবর রাখে অভিযানের।
সিলেট জেলা সীমান্তের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোরাই পণ্যের সরবরাহ আসে গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রতাপপুর সীমান্ত হয়ে। সেখানকার এলাকা সমতল। তাই চোরাই পণ্য সরবরাহে সুবিধা বেশি। এর পরই রয়েছে সংগ্রাম, বিছনাকান্দি ও তামাবিল সীমান্ত।
এ ছাড়া জৈন্তাপুর উপজেলার রাজবাড়ি বিওপির আওতাধীন ডিবির হাওর, ঘিলাতলা, ফুলবাড়ী ও টিপরাখলা সীমান্ত দিয়ে বেশি চোরাচালান হয়। অভিযোগ রয়েছে, এসব এলাকার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আশ্রয় ও সহায়তা পায় চোরাকারবারিরা। এ বিষয়ে গোয়াইনঘাট থানার তোফায়েল আহমেদ জানান, সীমান্ত এলাকায় মূলত বিজিবি টহল দেয়। স্থানীয়রা সচেতন হলে এবং প্রশাসনকে সহায়তা দিলে সমস্যা কমবে।