শহীদকন্যা লামিয়ার আত্মহনন নিয়ে সরকারের জবাব কী
Published: 28th, April 2025 GMT
কন্যারা সাধারণত বাবাদের অতিপ্রিয় হয়, বাবারাও হন কন্যাঅন্তঃপ্রাণ। যে কোনো সন্তানের কাছেই বাবা এক ধরনের ছাতা। বাবা চলে যাওয়া মানে মাথার ওপর থেকে সেই ছাতা সরে যাওয়া, সন্তানের পরিচয় হয়ে পড়ে এতিম। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে বাবা হারিয়ে লামিয়া এতিম হলেও খোদ রাষ্ট্রই হতে পারত তার ভরসার জায়গা। তাই লামিয়ার আত্মহনন মানে রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা।
লামিয়ার বাবা জুলাই আন্দোলনের শহীদ জসিম হাওলাদার। গণঅভ্যুত্থানের সময় গত ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ জুলাই মারা যান। ১৭ বছরের কলেজপড়ুয়া কন্যা স্বাভাবিকভাবেই বাবার মৃত্যুশোকে কাতর ছিল। বাবা না থাকলেও তাঁর কবর জিয়ারত হয়তো লামিয়াকে কিছুটা সান্ত্বনা দিত। কিন্তু সেটাই কিনা তার জন্য কাল হলো! লামিয়ারা ঢাকাই ছিল। জসিম হাওলাদারকে দাফন করা হয় তাঁর গ্রামের বাড়িতে– পটুয়াখালীর দুমকীতে। গত ১৮ মার্চ সেখানে বাবার কবর জিয়ারত করে বাড়ি ফেরার পথে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় লামিয়া। শোকে কাতর লামিয়ার জন্য এ ছিল যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বাবাহীন লামিয়া এ যন্ত্রণা সইতে পারেনি।
ঘরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেও শেষ রক্ষা হয়নি, প্রতিবেশীদের কারও কারও কটু কথা থেকে লামিয়া রেহাই পায়নি। লামিয়া আত্মহননের পর পথ বেছে নিয়ে প্রমাণ করেছে তার দিনগুলো কতটা হতাশায় কেটেছে। এটা সত্য, লামিয়া থানায় মামলা করেছিল। তার মামলায় দুইজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর ভিত্তি করে পড়ে ওঠা দল এনসিপিও তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। এসব প্রচেষ্টা কতটা যথেষ্ট ছিল সে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। লামিয়া হয়তো এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, বাঁচার জন্য আর কোনো আশ্রয় খুঁজে পায়নি।
লামিয়া শহীদের সন্তান হিসেবে এমন সময়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয় যখন সেই শহীদদের রক্তের ওপর গড়ে ওঠা সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। লামিয়া ও তার পরিবারকে এই সরকার নিরাপত্তা দিতে পারেনি। শহীদের একজন সন্তান তার বাবার কবর জিয়ারত করার মতো নিরাপত্তা নেই! এর চেয়ে হতাশাজনক বিষয় আর কী হতে পারে? মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও সেভাবে তার ভরসা হয়ে উঠতে না পারার ব্যর্থতাও আমাদের।
ধর্ষণের শিকার হলে মেয়েরা কতটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। লামিয়ার নাজুকতা ছিল দুই দিক থেকে। বাবাহীন লামিয়া এমন পরিস্থিতিতে পড়ার পর তাকে যেভাবে মানসিক সমর্থন দেওয়ার দরকার ছিল তার ঘাটতিই এখন প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে। একদিকে সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে আর অন্যদিকে শহীদের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছে! এ কেমন বৈপরীত্ব? লামিয়ার পরিবারের প্রতি এ কেমন অবহেলা।
আমাদের সমাজও কতটা নিষ্ঠুর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাও আমরা দেখছি। ধর্ষণের মতো একটা জঘন্য অপরাধের শিকার কাউকে সমর্থন না দিয়ে কটু কথা শোনানোর মতো ধৃষ্টতা দেখানো হয়। সোমবার প্রকাশিত সমকালের এ-সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম ছিল লামিয়ার মায়ের বক্তব্য– ‘মাইয়ারেও বাঁচাইতে পারলাম না’। পরিস্থিতির কারণে মেয়ের দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা শেষ হলেই তাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন মা রুনা বেগম। সেই সুযোগও পেলেন না তিনি।
লামিয়ার আত্মহনন আমাদের জন্য লজ্জার। আত্মহনন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ব্যক্তি কেন নিজেকে এমন অসহায় অবস্থায় আবিস্কার করেন, যেখান থেকে বেঁচে থাকার আর কোনো ভরসা পান না? সে উত্তরগুলো খুঁজতেই হবে। লামিয়ার বিষয়টি বিশেষ, সেখানেই যখন আমরা ব্যর্থ অন্যদের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। তারপরও যদি আমাদের সম্বিৎ ফিরে আসে। তার আত্মহনন জুলাই অভ্যুত্থানের জন্য কলঙ্ক। বিষয়টি এ সরকার যত দ্রুত বুঝতে পারে, ততই মঙ্গল।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ল ই অভ য ত থ ন আম দ র র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শহীদকন্যা লামিয়ার আত্মহনন নিয়ে সরকারের জবাব কী
কন্যারা সাধারণত বাবাদের অতিপ্রিয় হয়, বাবারাও হন কন্যাঅন্তঃপ্রাণ। যে কোনো সন্তানের কাছেই বাবা এক ধরনের ছাতা। বাবা চলে যাওয়া মানে মাথার ওপর থেকে সেই ছাতা সরে যাওয়া, সন্তানের পরিচয় হয়ে পড়ে এতিম। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে বাবা হারিয়ে লামিয়া এতিম হলেও খোদ রাষ্ট্রই হতে পারত তার ভরসার জায়গা। তাই লামিয়ার আত্মহনন মানে রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা।
লামিয়ার বাবা জুলাই আন্দোলনের শহীদ জসিম হাওলাদার। গণঅভ্যুত্থানের সময় গত ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ জুলাই মারা যান। ১৭ বছরের কলেজপড়ুয়া কন্যা স্বাভাবিকভাবেই বাবার মৃত্যুশোকে কাতর ছিল। বাবা না থাকলেও তাঁর কবর জিয়ারত হয়তো লামিয়াকে কিছুটা সান্ত্বনা দিত। কিন্তু সেটাই কিনা তার জন্য কাল হলো! লামিয়ারা ঢাকাই ছিল। জসিম হাওলাদারকে দাফন করা হয় তাঁর গ্রামের বাড়িতে– পটুয়াখালীর দুমকীতে। গত ১৮ মার্চ সেখানে বাবার কবর জিয়ারত করে বাড়ি ফেরার পথে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় লামিয়া। শোকে কাতর লামিয়ার জন্য এ ছিল যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বাবাহীন লামিয়া এ যন্ত্রণা সইতে পারেনি।
ঘরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেও শেষ রক্ষা হয়নি, প্রতিবেশীদের কারও কারও কটু কথা থেকে লামিয়া রেহাই পায়নি। লামিয়া আত্মহননের পর পথ বেছে নিয়ে প্রমাণ করেছে তার দিনগুলো কতটা হতাশায় কেটেছে। এটা সত্য, লামিয়া থানায় মামলা করেছিল। তার মামলায় দুইজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর ভিত্তি করে পড়ে ওঠা দল এনসিপিও তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। এসব প্রচেষ্টা কতটা যথেষ্ট ছিল সে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। লামিয়া হয়তো এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, বাঁচার জন্য আর কোনো আশ্রয় খুঁজে পায়নি।
লামিয়া শহীদের সন্তান হিসেবে এমন সময়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয় যখন সেই শহীদদের রক্তের ওপর গড়ে ওঠা সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। লামিয়া ও তার পরিবারকে এই সরকার নিরাপত্তা দিতে পারেনি। শহীদের একজন সন্তান তার বাবার কবর জিয়ারত করার মতো নিরাপত্তা নেই! এর চেয়ে হতাশাজনক বিষয় আর কী হতে পারে? মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও সেভাবে তার ভরসা হয়ে উঠতে না পারার ব্যর্থতাও আমাদের।
ধর্ষণের শিকার হলে মেয়েরা কতটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। লামিয়ার নাজুকতা ছিল দুই দিক থেকে। বাবাহীন লামিয়া এমন পরিস্থিতিতে পড়ার পর তাকে যেভাবে মানসিক সমর্থন দেওয়ার দরকার ছিল তার ঘাটতিই এখন প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে। একদিকে সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে আর অন্যদিকে শহীদের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছে! এ কেমন বৈপরীত্ব? লামিয়ার পরিবারের প্রতি এ কেমন অবহেলা।
আমাদের সমাজও কতটা নিষ্ঠুর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাও আমরা দেখছি। ধর্ষণের মতো একটা জঘন্য অপরাধের শিকার কাউকে সমর্থন না দিয়ে কটু কথা শোনানোর মতো ধৃষ্টতা দেখানো হয়। সোমবার প্রকাশিত সমকালের এ-সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম ছিল লামিয়ার মায়ের বক্তব্য– ‘মাইয়ারেও বাঁচাইতে পারলাম না’। পরিস্থিতির কারণে মেয়ের দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা শেষ হলেই তাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন মা রুনা বেগম। সেই সুযোগও পেলেন না তিনি।
লামিয়ার আত্মহনন আমাদের জন্য লজ্জার। আত্মহনন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ব্যক্তি কেন নিজেকে এমন অসহায় অবস্থায় আবিস্কার করেন, যেখান থেকে বেঁচে থাকার আর কোনো ভরসা পান না? সে উত্তরগুলো খুঁজতেই হবে। লামিয়ার বিষয়টি বিশেষ, সেখানেই যখন আমরা ব্যর্থ অন্যদের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। তারপরও যদি আমাদের সম্বিৎ ফিরে আসে। তার আত্মহনন জুলাই অভ্যুত্থানের জন্য কলঙ্ক। বিষয়টি এ সরকার যত দ্রুত বুঝতে পারে, ততই মঙ্গল।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com