অনেক হয়রানিমূলক, বিদ্বেষমূলক মামলা হচ্ছে: আইন উপদেষ্টা
Published: 28th, April 2025 GMT
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, অনেক হয়রানিমূলক, বিদ্বেষমূলক মামলা হচ্ছে। অন্যের জায়গা-জমি ও ব্যবসা দখল করার জন্যও মামলা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকার পুলিশ-আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকার দেওয়ার চেষ্টা করছে।
আজ সোমবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা। সেখানে হয়রানিমূলক মামলার অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের আইনে কোথাও তো মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা দেওয়া নেই। যে যার মতো মামলা করছে। এখানে অনেক হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে, বিদ্বেষমূলক মামলা হচ্ছে, অন্যের জায়গা-জমি দখল, ব্যবসা দখল করার জন্য মামলা হচ্ছে। এগুলো অত্যন্ত আনফরচুনেট (দুর্ভাগ্যজনক), অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। মামলা করে ফেলার পর পুলিশ-আদালত প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিকার দেওয়ার চেষ্টা করছি। যখন এত বেশি লোককে আসামি করা হয়, এত মামলা করা হয়, আমাদের জন্যও কঠিন হয়ে যায়।’
অধ্যাপক আসিফ বলেন, মামলা হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে অভিযোগের কোনো বস্তুনিষ্ঠতা পাওয়া না গেলে কাউকে যেন গ্রেপ্তার না করা হয়। আবার আদালতের পক্ষ থেকেও যেখানে বস্তুনিষ্ঠতা নেই, সেখানে যতভাবে আইনগত প্রতিকার দেওয়া সম্ভব, সেটি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে, আপনি ইরেশ যাকেরের নাম বলেছেন, এ রকম ছাড়াও আরও কিছু ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে, আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ করব, মামলাগুলো যারা করে, তাদের একটু খুঁজে বের করেন। খুঁজে বের করে মামলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তাঁদের উন্মোচন করেন। তাঁরা যদি কোনো হীন উদ্দেশ্যে, শত্রুতামূলক উদ্দেশ্যে, অন্যের ব্যবসা, জায়গা-জমি দখলের উদ্দেশ্যে কিংবা চাঁদার উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলাগুলো করে থাকেন, আপনাদের প্রতি অনুরোধ তাঁদের ভূমিকা প্রকাশ করেন, জনগণের কাছে দেখিয়ে দেন। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে আরও কী ব্যবস্থা নেব, সারাক্ষণ এটা চিন্তাভাবনা করছি।’
এদিকে আইন মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বক্তব্যে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর চার কাজে বিড়ম্বনা কমানো, সময় বাঁচানো ও অর্থ ব্যয় কমানো তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য ইতিমধ্যেই তাঁরা বেশ কিছু সংস্কারকাজ করেছেন বলেও জানান।
সংশোধনের কিছু উদাহরণ দিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, দেওয়ানি কার্যবিধির যুগান্তকারী বেশ কিছু সংশোধন করা হয়েছে, যা উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগতভাবে অনুমোদন হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের আগামী সভায় এটি চূড়ান্ত অনুমোদন হতে পারে।
ফৌজদারি কার্যবিধিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, দেশে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ মামলা হয়। আর জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয় ৩৫ হাজার মামলা। সংস্থাটিতে বছরে দুই লাখ মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে আদালতে মামলার চাপ কমপক্ষে ৪০ শতাংশ কমে যাবে।
আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সেরা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সেরা প্যানেল আইনজীবীর হাতে সম্মাননাসূচক ক্রেস্ট তুলে দেন আইন উপদেষ্টা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক সৈয়দ আজাদ সুবহানী।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইন উপদ ষ ট ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
স্বল্পসময়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পরিবেশ
আর্থিকভাবে বিচারপ্রাপ্তিতে অসমর্থ জনগণকে সহায়তা দিতে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ প্রণয়ন এবং এ-সংক্রান্ত একটি সরকারি সংস্থার মাধ্যমে সরকারিভাবে আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। তৃণমূল পর্যায়ে জনকল্যাণমূলক আইনি সেবার বার্তা পৌঁছে দেওয়া ও সরকারি খরচে আইনি সেবার বিষয়ে অধিকতর জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৮ এপ্রিলকে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, সমাজে যেন প্রত্যেক মানুষ নিজেদের মধ্যে বিরোধে না জড়িয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা নিয়ে বসবাস করতে পারে।
দেশে বর্তমানে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলো এখন শুধু আইনি সহায়তা প্রদানের কেন্দ্র হিসেবেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। মামলাজট কমানোর লক্ষ্যে এসব অফিস এখন ‘এডিআর কর্নার’ বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এ জন্য আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধিমালা প্রণয়ন করে লিগ্যাল এইড অফিসারদের এডিআর বা বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির আইনি ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে একে অনেকাংশে পরিপূর্ণ আকার প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের ক্ষমতাকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে দেওয়ানি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে একজন সিনিয়র সহকারী জজ বা সহকারী জজকে লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তারা আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে যাচ্ছেন।
বিদ্যমান আইনে লিগ্যাল এইড অফিস থেকে যেসব আইনি সেবা প্রদান করা হয় তা হলো– যে কোনো ব্যক্তি তার আর্থিক সামর্থ্য যা-ই হোক না কেন, সরকারি আইনগত সহায়তা কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত আইনগত তথ্যসেবা গ্রহণ, আইনগত পরামর্শ গ্রহণ কিংবা বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে আপসযোগ্য বিরোধ বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার সেবা; অসহায় ও দরিদ্র ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলার প্রয়োজন হলে সরকারি খরচে মামলা করা ও পরিচালনা; মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ; আদালত থেকে প্রেরিত মামলার মধ্যস্থতা; বিনামূল্যে ওকালতনামা সরবরাহ; আইনজীবীর ফি পরিশোধ; মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক সব ব্যয় পরিশোধ; ফৌজদারি মামলার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যয় পরিশোধ; মধ্যস্থতাকারী বা সালিশকারীর সম্মানী পরিশোধ; ডিএনএ টেস্টের যাবতীয় ব্যয় পরিশোধ এবং বিনামূল্যে রায় কিংবা আদেশের অনুলিপি সরবরাহ।
সাধারণ নাগরিকরা জাতীয় হেল্পলাইন কল সেন্টারের টোল ফ্রি নম্বর- ১৬৪৩০ এ কল করে, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে এবং বিডি লিগ্যাল এইড অ্যাপ ব্যবহার করে বিনামূল্যে সরকারি আইনি সেবা নিতে পারেন। এ ছাড়া জাতীয় লিগ্যাল এইড দপ্তরের ই-মেইল ও ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ করেও তা সম্ভব। এমনকি বিদেশ থেকে +৮৮০৯১২৩১৬৪৩০ নম্বরে ফোন করেও বিনামূল্যে সরকারি আইনি সেবা নেওয়া যায়।
দেশে এখন প্রায় ৪৪ লাখ দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন (সমকাল, ১২ নভেম্বর ২০২৪)। এই মামলাজট কমাতে দেশে বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যন্ত লিগ্যাল এইড কমিটির কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হলেও সীমাবদ্ধতার কারণে এ আইনের সুফল দেশের আপামর জনসাধারণ ভোগ করতে পারছে না।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে চলমান কার্যক্রম আমাদের নতুন ভাবনা জাগিয়েছে। আমরা চাই মামলাজটমুক্ত বিদেশি বিনিয়োগের অনুকূল স্বল্প সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তিপূর্ণ একটি চমৎকার পরিবেশ। দেশে আদালতের বাইরে লিগ্যাল এইড অফিস হোক মামলা নিষ্পত্তির অন্যতম কেন্দ্র।
মহসিনুল হক: স্পেশাল জজ (জেলা ও দায়রা জজ), কুমিল্লা