আমরা যখন ট্রলার থেকে কটকা ঘাটে নামলাম, তখন গাঢ় নীল আকাশের বুকে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। মেঘের উপর সূর্যের আলো পড়েছে। চোখে পড়ল একজোড়া বানর এগিয়ে আসছে। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে আছে চারপাশ।

খানিকটা এগুলেই ইট বাঁধানো সরু পথ। অনাবিল আনন্দ নিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম কটকার গহীনে। অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলো কৃত্রিম অনেক কিছু দিয়ে সাজানো। কিন্তু সুন্দরবনের সবই প্রাকৃতিক। তাই এখানে ভালোলাগাটা অন্যরকম। এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো কেওড়া বাগানের বিশাল প্রান্তর। আমরা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কেওড়া বনে প্রবেশ করতেই দেখা মিলল দলবদ্ধ চিত্রা হরিণ, বানর আর শূকরের। কোনো উদ্দাম হুঙ্কার বা আস্ফালন নেই বন্যপ্রাণীগুলোর মধ্যে। দূরে ওরা নীরবে দাঁড়িয়ে আছে, কোনোটা নড়াচড়া করছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে কটকা অভয়ারণ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। বনের মাটিতে গজিয়ে থাকা শ্বাসমূল মাড়িয়ে বনের আরও গভীরে প্রবেশ করলাম।

ছাতার মতো দেখতে কেওড়াগাছ। এর পাতা হরিণদের প্রিয় খাবার। ওরা যেটুকু নাগাল পায় খেয়ে সাবাড় করে নেয়। হরিণদের আকৃষ্ট করার জন্য এক পর্যটক গাছে উঠে কেওড়ার ডাল ভেঙে মাটিতে ফেলল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দূর থেকে দলবদ্ধ চিত্রা হরিণ ছুটে এসে খেতে শুরু করল। মনে হলো প্রতিনিয়ত পর্যটকদের আনাগোনার কারণে হরিণের ডর ভয় ভেঙে গেছে, ওদের মধ্যে বন্যতা বলে আর কিছুই নেই। অনেকেই নিবিড় ভালোবাসায় কাছে গিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় হরিণের সাথে ছবি তুলতে থাকল।

চোখ ফিরিয়ে পশ্চিম দিগন্তে তাকাতেই দেখি, সাগরের উপর নীল আকাশে বিশাল পাহাড়ের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘের পাল। সমুদ্রের দূরদিগন্তে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পানির পাহাড়! চোখে পড়ছে শুধু পানি আর পানি। নেই কোনো সবুজের চিহ্ন, দিগন্ত বিস্তৃত সাগর। পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। সূর্যাস্ত দেখার জন্য এই স্থানটি বেশ মনোরম। নিচে ঢেউয়ের তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে। ছোটো ছোটো ঢেউগুলো ছলকে ছলকে আঘাত হানছে জলাভূমির পাড়ে। তীরে জমে যাচ্ছে ক্রিমের মতো ফেনা। সাগর থেকে বয়ে আসা স্নিগ্ধ বাতাস শরীর মন জুরিয়ে দিচ্ছে। সূর্যাস্তের এক মোহনীয় দৃশ্য! চারদিকে রং বদল হচ্ছে। অস্তগামী সূর্যের শেষ আলো খেলা করছে সমুদ্রের জলের উপর। দিগন্ত উপরে শেষ বিকালের সূর্যের আলো পড়ে রংধনুর রঙে সেজেছে মেঘের দল।

প্রকৃতির আছে অসীম ক্ষমতা, যা জীবন নিয়ন্ত্রণ ও সুন্দর করে। ইটপাথরের ব্যস্ত জীবন ছেড়ে প্রশান্তির খোঁজে আসা পর্যটকরা বিভোর হয়ে দেখছে কটকার অপরূপ সৌন্দর্য। গহীন বন আর প্রকৃতিও পর্যটকদের নিজের বুকে আপন করে নিয়েছে। ভ্রমণের মূল আয়োজক জনাব ইয়াসিন আলীর কাছে সিহাব এসে বলল, স্যার, আসেন সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুলি। তিনি বললেন, কয়েক মিনিট পর সূর্যাস্তের ক্রমক্ষয়িষ্ণু শেষ আলো যখন অদ্ভুত আবহ তৈরি করবে জলের বুকে, আমরা তখন একসঙ্গে ক্যামেরাবন্দি হবো।

কিছুক্ষণ পর লালচে বৈদ্যুতিক শিখার মতো কেমন অপার্থিব রকম আলোকিত হয়ে উঠলো চারদিক। হলদেটে সূর্যরশ্মি যেনো আদরের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে সমুদ্রের জলকে। পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্য, যেনো সাগরের বিশাল গহ্বরে ডুবে যেতে চাইছে; তামাটে অবয়ব রেখে যাচ্ছে পানিতে। আকাশ থেকে সূর্যের রক্তিম আলো জলের উপর এমনভাবে পড়েছে, যেনো আগুন লেগেছে সমুদ্রের বুকে। 

আগের যুগের কোন রাজা-বাদশা এখানে ভ্রমণে এলে হয়ত রং-তুলিসহ চিত্রকর সাথে নিয়ে আসত দৃশ্যপট একে রাখার জন্য! আমাদের হাতে হাতে দামী মোবাইল থাকায় রং-তুলি, চিত্রকর এসবের প্রয়োজন হলো না। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ডুব দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে, কেউ ডুবন্ত সূর্যকে হাতের মুঠোয় বন্দি করে কেউবা অস্তাচলের সূর্যের আলোর নিচে বিভিন্ন ঢংয়ে ক্যামেরা বন্দি হচ্ছে। পাশের নলখাগড়ার জঙ্গল থেকে এক ঝাঁক বুনো পাখি সশব্দে ডানা মেলে উড়াল দিল আকাশে। ওরা আকাশের সোনালি-তামাটের আভায় তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডেকে উড়ে চলেছে নীড়ের দিকে। প্রকৃতি দেখে যে জ্ঞান অর্জন করা যায় তা বই পড়ে সম্ভব নয়। ইট পাথরের শহরের মানুষেরা এমন মায়াবী প্রকৃতির কাছে এলে খুশিতে শিহরিত না হয়ে পারবে না। অবশ্য, প্রকৃতির কাছে এলেও সবাই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে না। প্রকৃতির প্রেমে মুগ্ধ হয়ে মনে হচ্ছে, সমাজ সংসারে আর না ফিরে বৃন্দাবনে বাঘ, বানর, হরিণের সাথে থেকে যাই।

ওয়াসী জানতে চাইলো, আব্বু কখন জাহাজে ফিরবে? আমি হাসতে হাসতে বললাম সূর্য যখন সাগরে ডুব দেওয়ার পর আকাশে চাঁদ জাগবে ততক্ষণে আমরা পৌঁছে যাবো জাহাজে। দৃশ্যপট দেখা শেষ না হতেই সমস্ত কোলাহল থেমে গিয়ে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। যখন ফিরছি তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামতে চলেছে। প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো চারদিকে। প্রকৃতি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের রূপের যত দ্রুত পরিবর্তন করে নিতে পারে, পৃথিবীর অন্য কিছুই নিজেকে এতটা দ্রুত পরিবর্তন করতে পারে না। ফিরতি পথে হঠাৎই জঙ্গলের ভেতর থেকে কিসের যেন শব্দ শুনে মুহূর্তে থমকে দাঁড়ালাম। শেষ দৃশ্যপট হিসেবে দেখতে পেলাম, পাশের হেতালঝোঁপ দিয়ে একটি বন্য শূকর বাচ্চাসহ দৌড়ে যাচ্ছে। ট্রলারে চড়ে উন্মত্ত সমুদ্রের সফেন উচ্ছ্বাস প্রাণ ভরে দেখতে দেখতে রওনা হলাম জাহাজের দিকে। কটকা খাল থেকে যখন জাহাজে ফিরে এলাম ততক্ষণে আঁধার ঘনিয়েছে। নিস্তব্ধ আকাশে মিটমিট করে জ্বলছে হাজার তারার দল।

আছি যান্ত্রিক কোলাহল আর নেটওয়ার্কের বাইরে। নেই কোনো অফিসের ফোন কল কিংবা মেসেঞ্জারের নোটিফিকেশন। ভ্রমণের পুরো সময়টা আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত দখলে। রাতের খাবারের পর সহকর্মীরা কেউ গল্পগুজব, কেউ খেলাধুলা আবার কেউ গান বাজনায় মেতে উঠলো। জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের একদম শেষ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত দুবলার চরের দিকে। গাইড বলল, আপনাদের জন্য ভয়ংকর সুন্দর এক জীব বৈচিত্র্য অপেক্ষা করছে দুবলার চরে। সারাদিনের ভ্রমণ আর আড্ডায় মশগুল থেকে রাতে ঘুমের রাজ্যে ডুবে গেলাম। ঘুমের ঘোরে কল্পিত চিত্রে ধরা পড়ল, বনের মেঠো পথ ধরে চলার সময় বন্য বানর, শূকর, হরিণ দেখছি। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর থেকে গর্জে উঠলো বাঘের কণ্ঠস্বর! ভেঙে যাচ্ছে জঙ্গলের চারপাশের নিস্তব্ধতা। বনের গাছের পাতায় পাতায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাঘের গর্জন। বাঘের হুঙ্কারে গাছের ডালের শত শত পাখি উড়াল দিচ্ছে আকাশপানে। দিগবিদিক হয়ে দৌড়াচ্ছে বন্য হরিণের পাল। আমি ভয়ে শিহরিত হয়ে থরথর করে কেঁপে উঠে দেখি, জাহাজে বিছানায় শুয়ে আছি।

মধ্যরাতে বিছানায় ওপাশ ফিরে দেখি স্ত্রী-সন্তান গভীর ঘুমে  অচেতন। জানালার পর্দা টেনে সাগরের জলে চোখ রাখলাম। সাগরের জলের উপর নক্ষত্রের আলো পড়েছে, মেঘ, চাঁদ প্রতিবিম্ব হয়ে আয়নার মতো ফুটে উঠেছে জলের বুকে! মনে হচ্ছে, এটাই জল, জোছনা আর মেঘের ত্রিমুখী মিলন মেলা! ভরা জোছনায় জলের সঙ্গে চাঁদ ও মেঘের এভাবেই মিলন হয়।

কিছু পরিস্থিতিতে মানুষের নিজের একান্ত বলে কিছু সময় থাকা উচিত। আমি জাহাজের ছাদে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার আগে কিছুক্ষণ পিছনের ইঞ্জিনের পাশে দাঁড়ালাম। নেকড়ের গর্জনের মতো ধেয়ে আসছে বাতাস; চলন্ত জাহাজের গায়ে লেগে চাপাস্বরে গুমগুম করছে ঢেউয়ের আওয়াজ।

ছাদে এসে দেখছি চারপাশে ভৌতিক নীরবতা। যান্ত্রিক জীবনের কোলাহল নেই। নেই মানুষের হট্টগোল। চারপাশে নিস্তব্ধতার এক দেয়াল। আমরা শহুরে মানুষ এমন নিস্তব্ধতায় অভ্যস্ত নই। এমন অদ্ভুত নৈঃশব্দের মাঝে সত্যি মনে শিহরণ জাগানো অনুভব সৃষ্টি হয়। জীবনের নিখাদ শান্তি লুকিয়ে থাকে এমন প্রকৃতির ছোঁয়ায়। দিগন্তের দেয়াল ভেদ করে চোখ পড়ল আকাশপানে। আকাশের বুকের দৃশ্যপট রাজকীয় ভঙ্গিতে জেগে উঠছে। চাঁদের নীলাভ আভা আর শত শত তারার কারণে, আকাশটাকে মনে হচ্ছে নীল ময়ুরের পেখমের মতো। পুরো আকাশ গিজগিজ করছে তারায়। আকাশের বুকে যেন চাঁদ তারার মেলা বসেছে। পূর্ণ আকৃতির রুপোর থালার মতো জ্বলজ্বলে চাঁদ দেখে মনে হলো আজ পূর্ণিমা।

চারপাশে মেলে ধরা প্রকৃতির বিচিত্র শোভা দেখতে চোখের পলক ফেলতে পারছি না। কোনটা রেখে কোনটা দেখব তা স্থির করতে পারছি না। একবার দিগন্তের বাঁকে চোখ মেলে তারা ভরা আকাশ দেখছি, আবার চোখ নামিয়ে সমুদ্রের বুকে রুপালি জলের নাচ দেখছি। সাগরের এত জল আর ঘূর্ণায়মান তারার নকশার মাঝে আমি আগে কখনো আসিনি। জোছনাশোভিত সাগরের দৃশ্য বিদ্যুতের ঝলকের মতো জীবন্ত করে তুলছে মন।  এমন দৃশ্যের জন্য শহরের হাজার ব্যস্ততাকে দূরে ঠেলে বনে চলে আসা যায়।

এমন সুন্দর মুহূর্তেও, ভাবনায় ক্লান্তি, বিষাদ, মন খারাপের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে সহধর্মিণীকে ডেকে এনে চাঁদের  নরম আলোয় ভিজতে ভিজতে, গল্প করে সারারাত কাটিয়ে দিতে পারতাম! প্রকৃতির মাঝে ডুবে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেলাম নির্জন সাগরের বাইরের জীবনের কথা। যখন হিমশীতল ঠান্ডায় শরীর বরফের মতো হয়ে এলো তখন রুমে ফিরে গেলাম। মানুষ মৃত্যুর কথা ভেবে আবেগ তাড়িত হয় অথচ প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে জীবনকে উপভোগ করার কথা চিন্তা করে না।

দুবলার চর বঙ্গোপসাগরের একেবারে মোহনায় অবস্থিত। আমরা পরদিন সকালে সূর্যের নরম আলোয় ভিজতে ভিজতে দুবলার চরের উদ্দেশ্যে ট্রলারে রওনা হলাম। জলের উপর ছড়িয়ে পরছে কাঁপা কাঁপা ঢেউ। ট্রলার ঢেউয়ের তালে নাচতে লাগলো। সকালের তাজা ও ঠাণ্ডা বাতাস শরীর শীতল করে দিচ্ছে। পাখির ঝাক উড়ে যাচ্ছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে নীরবতা ভেঙে যাচ্ছে। দূরের বালুর তীরে ঝাঁকে ঝাঁকে বসে আছে সাদা বকের দল। বকের ঝাঁক দেখে মনে হচ্ছে তীরে বকফুল ফুটে আছে। আমাদের ট্রলারে উত্তেজনার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ট্রলারে দাঁড়ানো ও বসা প্রতিটি মানুষ তন্ন তন্ন করে খুঁজছে প্রকৃতির সৌন্দর্য। দৃশ্য দেখে সহকর্মীদের কারো চেহারা উত্তেজনায় থমথম করছে, কারো চোখে নগ্ন উল্লাস।

আমাদের সুন্দরবনের শেষ সীমানা, বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা দুবলার চরে নামিয়ে দেয়া হলো। তীরে বর্ণিল প্রজাপতির ঝাঁকের মতো মাথার উপর উড়ে বেড়াচ্ছে বুনো পাখির দল। পাখিরা  ডানা মেলে ওড়ার সময় কিচিরমিচির শব্দে যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আকাশ রঙ্গিন করে ফেলা পাখির ঝাকের মতোই আনন্দে উড়তে চাইছে মন। পাখিদের যাপিত জীবনের কলরব শুনতে চাইলে তাকে আসতে হবে দুবলার চর। ট্রলার থেকে নেমেই প্রাণ ভরে তাজা বাতাসে ভরে নিলাম নিজের ফুসফুস। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন পর বিশুদ্ধ শ্বাস নিলাম। কয়েক কদম এগুতেই চোখে পড়ল জ্যান্ত মাছকে শুঁটকি করার জন্য চাতালে শুইয়ে রাখা হয়েছে। চাতালের অগণিত মাছ দেখে মনে হচ্ছে এখানে সাগর জলে মাছ গিজগিজ করে। চাতালের শুঁটকির কড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছে। দুবলার চরে না এলে দেখা হতো না শুঁটকি কীভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।

দুবলার চর মূলত জেলে গ্রাম। চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরার জেলেরা বন বিভাগের পূর্বানুমতিসাপেক্ষে চরে সাময়িক বসতি গড়ে। এখানে জেলেদের পাঁচ মাসের জন্য আগমন ঘটে। এই সময়ে মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি শুকানোর কাজ। আমরা যখন হাঁটছি তখন তীরে গুমড়ে মরছে বাতাস। এমন শীতল দমকা হাওয়ার ছোঁয়া পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। গোখরা সাপের মতো হিসহিসিয়ে উঠছে ঢেউয়ের আওয়াজ। দিগন্তবিস্তৃত বালুর ওপর সূর্যের আলো পড়ে প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করে উঠছে। সাগরের বুকে চোখ মেলতেই দেখছি রোদের আলো নীল জলের উপর ঝলক খেলছে। দক্ষিণে জমিনের লেশমাত্র নেই শুধু পানি আর পানি। বিস্তৃর্ণ জলের সীমানার ওপারে চোখে পড়ছে শুধু ধুধু নীল আকাশ আর নীল জল। 

কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর দলছুট হয়ে সহকর্মীরা যে যার মতো দুবলার চর দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কয়েক ডজন বড় নৌকা সাগরের তীরে বালুকনার উপর সারিবদ্ধভাবে সাজানো। এগুলো সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত হয়। সারিবদ্ধ কাঠের নৌকাগুলো আমাদের দারুণ বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠলো। এই নৌকা নিয়ে সাগরের অথৈ জলে জেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া আহরণ করে জীবন-জীবিকা চালায়। ওরা নৌকা নিয়ে উত্তাল সাগরের জলের বুকে কাঁপন তুলে বীরদর্পে বড় বড় মাছ ধরে নিয়ে আসে।

চলতি পথে ওয়াসী জিজ্ঞেস করলো, আব্বু, নৌকাগুলো এভাবে পানি থেকে টেনে টানে রেখেছে কেন? এগুলো কি রং করার জন্য রাখা হয়েছে? উত্তরে বললাম, আরে ব্যাটা এগুলো ভাটার কারণে আটকে পড়েছে, জোয়ার এলে আবার জলে ভাসবে। ও আবার জিজ্ঞেস করলো, জোয়ার ভাটা কি আব্বু? বললাম, এখন ভাটা চলছে যখন তীর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাব তখন বুঝবে জোয়ার কি!

আমাদের ভাবীরা ও তাদের বাচ্চারা সাগরের জলে নেমে পড়েছে। বাচ্চাদের শরীরে জল আর বালির মাখামাখি চলছে। ভাবীরা ঢেউয়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যেন সংসারের ক্লান্তি সমুদ্রের জলে ঢেলে দিচ্ছেন। সামিহা জল দেখে উত্তেজিত ভঙ্গিতে  অস্পষ্টভাবে বলল, আব্বু মাম মাম। বুঝতে পারলাম ও জলে নামতে চাইছে। ও কোল থেকে নেমে পড়ল। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে ওর ছোট্ট শরীরে লাগছে, ও খুশিতে শিহরিত হয়ে উঠছে। সমুদ্রের বুকে জলের কাছে এসে আমিও যেন কৈশোরে ফিরে যাচ্ছি। কিশোর বয়সে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আনন্দ করার স্মৃতি মনে পড়ছে।

জলের বুকে কাঁপন তুলে বয়ে যাচ্ছে সাগর থেকে আসা বাতাস। আমি চারপাশের প্রকৃতির প্রতি মনোযোগ নিবেশ করলাম। কল্পনাকেও হার মানায় সাগরের জলের আকার। এত বিপুল জল ধারণ করার মতো গভীর আর প্রশস্ত কিছুই নেই সাগরের মতো। সাগরের দিকে তাকিয়ে জমা জলকে মনে হচ্ছে মেলে দেওয়া বিশাল চাদরের মতো। দিগন্তের নিচে নীল জলের উপরে নীল আকাশ। এই নীল জলের সাগর তলে কুমির তিমি ডলফিনসহ ভয়ংকর প্রাণীর আভাস। দিগন্তে ভাসছে শিমুল তুলার মতো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের পাল। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে নীল জলের উপর গাঙচিলের দৃষ্টিনন্দন উড়াউড়ির মতো, এখানেও উত্তাল সমুদ্রের উপর তরঙ্গায়িত বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে গাংচিলের দল। একটা বাদামি পাখনার মাছরাঙা এক ঝলকে পানিতে নেমে ছোঁ মেরে লম্বা ঠোঁটে জ্যান্ত রুপালি মাছ শিকার করে উড়াল দিল। সাগর আর আকাশের মেলবন্ধন অদ্ভুত শান্তি জাগায় মনে। সমস্ত অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চায় যেন। লেখালিখির জন্যে ওর চেয়ে সেরা জায়গা আর হয় না। বুড়ো বয়সে বিশ্রামের জন্যও আদর্শ।

এমন প্রকৃতির সান্নিধ্যে এলে প্রবল হতাশা ও বিষাদের অন্ধকারে ডুবে থাকা নিঃসঙ্গ মানুষটিও, খুশিতে জ্বলে উঠবে দুপুরের সূর্যের মতো। এখানে বাতাস উন্মাদ,পরিবেশ ভয়ঙ্কর সুন্দর। যাদের এমন দৃশ্যপট দেখার সুযোগ হয় তাদের নিজেকে ভাগ্যবান মনে করা উচিত। আমাদের পিছনে গজপঞ্চাশেক দূরে হরেক রকমের শুঁটকির পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানদার। দুবলার চরের শুঁটকি দামে তুলনামূলক সস্তা আবার গুণগত মানও ভালো। সহকর্মীরা ঘুরে ঘুরে কিনছে পছন্দের শুঁটকি। সৈকতে মেঘ আর সমুদ্রের  মিতালি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছে আমাদের মতো অগনিত পর্যটক।

পিছনে চোখ ফেরাতেই দেখছি সাদা বালুকার উপর দিয়ে হেঁটে চলছে এক সুন্দরী তরুণী। মেয়েটি সোনালি ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে বিহ্বল চোখে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছে সাগরের ঢেউ। হেঁটে চলা মেয়েটির খোলা চুলগুলো উন্মাদ হাওয়ায় উড়ছে পতাকার মতো। গাঢ় রেশমি চুলের নারী যে কাউকেই আকৃষ্ট করে। ঘণ্টাখানেক পর আমাদের দলের সহযাত্রীরা প্রায় সবাই ফিরে এলো তীরে। সঞ্জয়দা একজনকে বলছেন দুবলার চরের মন্দির ঘুরে এসেছেন। এখানে না কি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কার্ত্তিক মাসে ভরা পূর্ণিমায় রাসমেলা হয়। পুণ্যার্থীরা রাস উপলক্ষে এখানে আসেন সমুদ্রস্নান করে পাপ মুক্ত হতে। অনেক পুণ্যার্থী দুবলার চরে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে সমুদ্রের জলে ফল ভাসিয়ে দেন। কেউবা আবার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভজন-কীর্তন গেয়ে সাগরের দেবতাদের সন্তুষ্ট করেন। পুণ্যার্থীরা মনে করে, সাগরের তীরে রাশ মেলায় ধর্মীয় আচার অনুশীলন করার মাধ্যমে পাপ ধুয়ে-মুছে পবিত্র হয় শরীর। পূর্ণ হয় মনস্কামনা!
 

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র স র য র আল স ন দর য র স ন দর ল র উপর দ শ যপট সহকর ম ক র মত জ বন র আম দ র পর স র র জন য ভ রমণ

এছাড়াও পড়ুন:

উপকূল রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ধস, প্লাবনের আশঙ্কা সুন্দরবন তীরবর্তী জনপদে

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মালঞ্চ নদীর চর দেবে গিয়ে উপকূল রক্ষা বাঁধের পাঁচ নম্বর পোল্ডারের সিংহড়তলী অংশে ভয়াবহ ধসের সৃষ্টি হয়েছে। শনিবার দুপুরে শুরু হওয়া ধস আজ সোমবার আরও গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এর আগে শুক্রবার রাতে আকস্মিকভাবে চুনকুড়ি ও সিংহড়তলী এলাকায় চর দেবে যাওয়ার পর থেকেই বাঁধে ধস শুরু হয়।

খবর পেয়ে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে কাজ করছেন।

ধস একেবারে জনবসতির কোল ঘেঁষে হওয়ায় গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নদীতে জোয়ারের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাঁধের অবশিষ্ট দুই থেকে আড়াই ফুট অংশ যে কোনো সময় নদীতে বিলীন হতে পারে। এতে সুন্দরবন তীরবর্তী কয়েকটি জনপদ লবণ পানিতে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মালঞ্চ নদীর ছয়টি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিলেও সিংহড়তলী অংশের অবস্থা সবচেয়ে সংকটাপন্ন। তারা জানান, দ্রুত বিকল্প বাঁধ নির্মাণ করা না হলে পরবর্তী জোয়ারে সাত থেকে আটটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।

স্বেচ্ছাসেবক আব্দুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, ‘মাত্র সাত-আট মাস আগে এখানে মাটির কাজ হয়েছিল। বাঁধের পাশে অতিরিক্ত মাটি নেওয়ায় বাঁধ অনেকটা খাড়া হয়ে ছিল। কয়েকদিন ধরে ফাটল দেখা দেয়ার পর শনিবার থেকে ধস শুরু হয়। পাউবো তাৎক্ষণিকভাবে জিওশিট চাপিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করলেও শনিবার রাতে সবকিছু ধসে যায়।’

স্থানীয় বনজীবীদের নেতা বাবলুর রহমান সমকালকে বলেন, শনিবার দুপুরে বাঁধের প্রায় ৩০ ফুট অংশ নদীতে ধসে পড়ে। রোববার সকালের জোয়ারে আরও এক দফা ধসের পর বাঁধের অবশিষ্ট উচ্চতা এখন মাত্র দেড় থেকে দুই ফুট। তিনি বলেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সিংহড়তলী, চুনকুড়ি, হরিনগর, যতীন্দ্রনগর, ছোট ভেটখালীসহ অন্তত সাতটি গ্রাম তাৎক্ষণিকভাবে প্লাবিত হতে পারে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য নীপা রানী সমকালকে বলেন, ছয় নম্বর ওয়ার্ডের অন্তত ছয়টি অংশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। সিংহড়তলীর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বসতবাড়ির পাশে ভাঙন দেখা দেয়ায় এলাকাবাসী উদ্বাস্তু হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অনেকেই ইতোমধ্যে একাধিকবার সর্বস্ব হারিয়েছেন।

ঘটনাস্থলে থাকা পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দীন সমকালকে বলেন, শনিবার বিকেলে ভাঙন কবলিত অংশে শতাধিক জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হলেও তাতে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়নি। এখন বাঁধের ভেতর দিয়ে ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের রিং বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। তিনি জানান, রোববার রাতের মধ্যে বিকল্প বাঁধ নির্মাণ শেষ করা গেলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনী খাতুন সমকালকে বলেন, স্থানীয়দের সহযোগিতায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ভাটার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। পানি নামলে শত শত গ্রামবাসীকে নিয়ে ভাঙন রোধে পুনরায় কাজ শুরু করা হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনে অস্ত্রসহ বনদস্যু আটক
  • উপকূল রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ধস, প্লাবনের আশঙ্কা সুন্দরবন তীরবর্তী জনপদে
  • সুন্দরবনের কোন ফুলের মধুর কত দাম
  • শিল্পের শহর কি ফিরে পাবে হারানো গৌরব