সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে গতকাল রোববার ও আজ সোমবার ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লার মুরাদনগর ও বরুড়া উপজেলায় ৪ জন, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ও মিঠামইনে ৩ জন, নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও মদনে ২ জন, সুনামগঞ্জের শাল্লায় একজন, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে একজন, মৌলভীবাজারের বড়লেখায় একজন, চাঁদপুরের কচুয়ায় একজন, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে একজন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে একজন মারা গেছেন।

কুমিল্লা
কুমিল্লার বরুড়া ও মুরাদনগরে বজ্রপাতে দুই স্কুলছাত্রসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে বরুড়ায় দুই স্কুল ছাত্র এবং মুরাদনগরে দুই কৃষকের মৃত্যু হয়। সোমবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বরুড়া উপজেলার পয়ালগাছা গ্রামের মৃত খোকন মিয়ার ছেলে ফাহাদ হোসেন (১৩) এবং বিল্লাল হোসেন ছেলে মোহাম্মদ জিহাদ (১৪) দুপুরে হালকা বৃষ্টির মাঝে মাঠে ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় হঠাৎ বজ্রপাত হলে দুই ছাত্র মারাত্মকভাবে আহত হন। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।

অপর ঘটনায় মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানা এলাকায় বজ্রপাতে দুই কৃষক মারা গেছেন।

স্থানীয়রা বলেন, পূর্বধইর পূর্ব ইউনিয়নের কোরবানপুর পশ্চিম পাড়ার মৃত বীর চরন দেবনাথের ছেলে নিখিল দেবনাথ (৫৫) ও উপজেলার আন্দিকোট ইউনিয়নের দেওড়া গ্রামের জসিম উদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে জুয়েল ভূঁইয়া (৩২) মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ সময় আহত হন আরও ২ ব্যক্তি।

বরুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হাসান বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে। পরিবারের কোনও অভিযোগ না থাকায় বিনা ময়নাতদন্তে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি শিশু আহত হয়েছে।

বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, কোরবানপুর পূর্বপাড়া কবরস্থানের পাশের মাঠে দুই জন কৃষক বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। তাদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। পরে পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে আইনি প্রক্রিয়া শেষ মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে খয়েরপুর আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের হাওরে ধান কাটার সময় সকাল পৌনে ১০টার দিকে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।

নিহতরা হলেন ইন্দ্রজিৎ দাস (৩০) ও স্বাধীন মিয়া (১৫)। ইন্দ্রজিৎ উপজেলার কলমা ইউনিয়নের হালালপুর গ্রামের মৃত যতিন্দ্র দাসের ছেলে। স্বাধীনের বাবার নাম ইদ্রিস মিয়া; বাড়ি খয়েরপুর গ্রামে। এতে আহত হয়েছেন একজন।

এছাড়াও একই গ্রামের শ্রমিক সহোদর দাস (৫০) বজ্রপাতে আহত হয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছেন।

অষ্টগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

প্রায় একই সময়ে মিঠামইন উপজেলার শান্তিগঞ্জ হাওরে বজ্রপাতে ফুলেছা বেগম (৬৫) নামের এক নারী নিহত হয়েছেন। তিনি ওই এলাকার মৃত আশ্রাব আলীর স্ত্রী।

মিঠামইন থানার এসআই অর্পণ বিশ্বাস বলেন, আজ সকালে বাড়ির পাশে ধানের খড় শুকাতে দিচ্ছিলেন ফুলেছা বেগম। এ সময় বজ্রপাত হলে নিহত হন তিনি।

নেত্রকোণা
নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের ধনুন্দ গ্রামে নিজ বাড়িতে গতকাল রোববার রাত ১০টার দিকে বজ্রপাতে আহত হন দিদারুল ইসলাম (২৮)। পরিবারের লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তিনি পাশের খারনৈ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর এলাকায় একটি ইফতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন।

তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাইযুল ওয়াসীমা নাহাত বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই শিক্ষকের দাফনের জন্য পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।

আজ সকাল সাতটার দিকে মদন উপজেলার তিয়োশ্রী গ্রামে মো.

আরাফাত (১০) বাড়ি থেকে বের হয়ে মাদ্রাসার উদ্দেশে রওনা হয়। এ সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। হঠাৎ করে একটি বজ্রপাতে তার শরীর ঝলসে যায়। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আরাফাত ওই গ্রামের সালাম মিয়ার ছেলে। সে তিয়োশ্রী মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত।

সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার আটগাঁও গ্রামের বুড়িগাঙ্গাল হাওরে আজ সকালে বজ্রপাতে রিমন তালুকদার নামের এক কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। রিমন আটগাঁও গ্রামের বাসিন্দা এবং শাল্লা ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকালে গ্রামের পাশের বুড়িগাঙ্গাল হাওরে গরুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যান রিমন তালুকদার। একপর্যায়ে বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হয়। রিমন তালুকদার নিরাপদ স্থানে যাওয়ার আগে বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

তার মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম।

হবিগঞ্জ
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার হাওরে বজ্রপাতে দুর্বাসা দাস (৩৫) নামে এক ধান কাটা শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়াও এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ৩ জন।

সোমবার সকালে এই ঘটনা ঘটে। তাদের উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন আছেন।

বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তি উপজেলার আড়িয়ামুগুর গ্রামের কালাবাসী দাসের ছেলে।

বিষয়টি নিশ্চিত করেন বানিয়াচং থানার (ওসি) গোলাম মোস্তফা।

জানা যায়, সকাল থেকেই উপজেলার আড়িয়ামুগুর গ্রামের পূবের হাওরে ধান কাটছিলেন দুর্বাসা দাসসহ তার স্বজনরা। এসময় ঝড়ো বৃষ্টির সাথে বজ্রপাত হলে দুর্বাসা দাস বজ্রাঘাতের শিকার হন। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এছাড়াও আহন হন তার ভাই ভূষণ দাস (৩৪) ও বোন সুধন্য দাস (২৮)।

এদিকে একই উপজেলার বাগহাতা গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে বায়েজিদ মিয়া (১৩) নামে এক শিশু বজ্রাঘাতে আহত হয়েছে। তাকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

হবিগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আজাদুর রহমান বলেন, বজ্রাঘাতে নিহতের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হবে।

চাঁদপুর
চাঁদপুরের কচুয়ায় বজ্রপাতের বিকট শব্দে বিশাখা রানী (৩৫) নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। আজ বেলা ১১টায় উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের নাহারা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। বিশাখা ওই এলাকার কৃষক হরিপদ সরকারের স্ত্রী।

কচুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল ইসলাম জানান, বাড়ির পাশে স্বামী–স্ত্রী মিলে নিজ জমি থেকে ধান তুলছিলেন। এ সময় কাছাকাছি কোথাও বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। এ সময় বিশাখা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

হাসপাতালের চিকিৎসক সোহেল জানান, তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। বজ্রপাতের শব্দের কারণে তিনি হার্ট অ্যাটাক করে ঘটনাস্থলে মারা যান।

মৌলভীবাজার
বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের শ্রীধরপুর গ্রামে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে মাখন রবি দাস (৪৮) নামে এক চা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। 

সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। নিহত মাখন ওই ইউনিয়নের অহিদাবাদ চা বাগানের মৃত শংকুরা রবি দাসের ছেলে।

স্থানীয়রা জানান, সোমবার মাখন রবি দাস শ্রীধরপুর গ্রামের আলমাছ মিয়ার জমির ধান চুক্তিতে কেটে দিচ্ছিলেন। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হয়। এতে ঘটনাস্থলে মাখন মারা যান।

উত্তর শাহবাজপুর ইউপির চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন আহমদ বজ্রপাতে চা শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি। পুলিশও এসেছে। মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফনের জন্য নিহতের স্বজনরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করবেন।

শরীয়তপুর
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলায় বজ্রপাতে সেফালী বেগম (৩৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।

সোমবার দুপুরে উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের বেপারীকান্দি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহত সেফালী বেগম ওই এলাকার সোহরাব হোসেন বেপারীর স্ত্রী।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার দুপুরের দিকে আকাশ মেঘলা হয়ে আসে। গৃহপালিত গরুর জন্য ঘাস সংগ্রহ করতে সেফালী বেগম মাঠে যান। ঘাস কাটার সময় আকস্মিকভাবে শুরু হয় বজ্রসহ বৃষ্টি। হঠাৎ বজ্রপাত হলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা দ্রুত ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে ভেদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। তবে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবায়দুল হক বলেন, বজ্রপাতে এক নারীর মৃত্যুর খবর পেয়েছি। মরদেহ হাসপাতালেই রয়েছে। এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বাঞ্ছারামপুর
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে জমিতে কাজ করার সময় বজ্রপাতে মানিক মিয়া (৬৫) নামে এক কৃষক নিহত হয়েছেন। তার সঙ্গে থাকা হানিফ মিয়া (৬০) গুরুতর আহত হয়েছেন।

আহত হানিফ মিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

সোমবার দুপুরে উপজেলার সোনারামপুর ইউনিয়নের চর-মরিচাকান্দি বিলপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে।

নিহত মানিক মিয়া চর-মরিচাকান্দি বিলপাড়ার বাসিন্দা মৃত কালাগাজীর ছেলে ও আহত হানিফ মিয়া আহসান উল্লার ছেলে। তারা দুজনই একই পাড়ার বাসিন্দা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলা সোনারামপুর ইউনিয়নের চর মরিচাকান্দি গ্রামের বিলপাড়ে দুপুরে সাড়ে বারোটার দিকে জমিতে কৃষিকাজ করে বাড়ি ফেরার সময় আকস্মিক বজ্রপাত হলে তারা গুরুতরভাবে আহত হন।

স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে দ্রুত বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মানিক মিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে বাঞ্ছারামপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোর্শেদুল আলম চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আমি জেনে পুলিশ পাঠিয়েছি এবং আইনি প্রক্রিয়া শেষে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও চাঁদপুর জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা]

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স স মব র দ প র পর ব র র ক ন শ চ ত কর ক শ রগঞ জ স ন মগঞ জ ম র দনগর উপজ ল র ল ইসল ম র উপজ ল র জন য সময় ব আহত হ এ সময় র সময় মরদ হ এ ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

দাউদ হায়দার: কবির দেশ ছাড়ার কষ্ট

সময়টা আশির দশক; এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। প্রতিবাদে চলছে রাজপথে আন্দোলন! কৈশোর থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটছে তারুণ্যে। ছড়া লিখছি স্থানীয় পত্রপত্রিকায়! বরিশাল শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠন বরিশাল কবিতা পরিষদ, অক্ষর সাহিত্য পরিষদের সব আসরে নিয়মিত আমিও। পড়ছি কবিতা কবিতা আর কবিতা!

আমরা তখনই নাজিম হিকমাত পড়ি! শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আমাদের নিত্যসঙ্গী। আর ছিলেন দাউদ হায়দার।

দাউদ হায়দারের নাম বিশেষভাবে উচ্চাতি হতো। কারণ, কবিতা লেখার অপরাধে তাঁকে মাতৃভূমি ছাড়তে হয়েছিল! এ ছাড়া লিখেছিলেন নতুন জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের নতুন কবিতা! ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতার বইটি যেন স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। দাউদ হায়দারের গদ্যও অসাধারণ তাঁর কবিতার মতো। আমরা যারা সাংবাদিক দাউদ হায়দারের কলাম পড়তাম, তারা জানি কত সহজে তিনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি নিয়ে লিখতে পারতেন।

দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত কবিতায় ধর্মবিরোধিতার অভিযোগে ১৯৭৩ সালে দাউদ হায়দারকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে গোপনে একটি বিমানে একমাত্র যাত্রী হিসেবে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দেশছাড়া দাউদ হায়দারকে কলকাতায় আশ্রয় দিয়েছিলেন কবি ও লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়; নিজের সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে। 
শোনা যায়, সেই আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং!

এ সময় কলকাতা আসেন জার্মান কবি ও কথাশিল্পী গুন্টার গ্রাস। এ উপলক্ষে যে সাহিত্যের আয়োজন, তার পুরো দায়িত্বে ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। তিনি গ্রাসকে বলেন, দাউদ হায়দারকে জার্মানিতে আশ্রয় দেওয়া যায় কিনা। গুন্টার গ্রাস জার্মানিতে ফিরে সেখানকার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে দাউদকে জার্মানিতে বসবাসের ব্যবস্থা করেন।
জার্মানিতে প্রথমে দাউদ হায়দার গ্রন্টার গ্রাসের প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিলেন কিছুদিন। তারপর ডয়চে ভেলে রেডিওতে চাকরি নেন।
২০০৭ সালে আমার ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় আমন্ত্রিত প্রকাশক হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়। কবি শামসুর রাহমান ও গুন্টার গ্রাসের বড় আকারের পোস্টার ছেপে নিয়ে যাই। সেখানে খোদ গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে দেখা হবে– কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু সেই সুযোগ করে দেন এমন আরেকজন, যাঁর সঙ্গে দেখা হওয়াও কল্পনায় ছিল না।

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার আমন্ত্রিত প্রকাশদের জন্য ৬ দিন নানা সেমিনার কর্মসূচিতে থেকে ক্লান্ত আমি যখন বাংলা বলার লোক খুঁজে পাচ্ছি না, তখন এক সকালে ক্যাপ পরিহিত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা মেলা সেন্টারে! দেখেই চিনে ফেলি তাঁকে! বলি, আপনি তো মনে হচ্ছে কবি দাউদ হায়দার! নিজেই নিজের পরিচয় তুলে ধরি তাঁর কাছে! কিন্তু তিনি কোনো কারণে চটে ছিলেন। বললেন, দেশে এত বড় বড় প্রকাশক থাকতে আপনি কোন ধান্দা করে এখানে চলে এলে! আমি উত্তর দেওয়ার কোনো ভষা খুঁজে পেলাম না! পাল্টা মেজাজ দেখিয়ে বললাম, এরা ছোট প্রকাশকদের ট্রেনিং দেয় বই প্রকাশনা নিয়ে। তাই সব সময় বড় প্রকাশকদের ডাকে না। উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হলো না। আমারও মনে হয়েছিল, প্রবাসী এই কবির সঙ্গে বোধ হয় এখানেই ইতি।

অবাক করার বিষয়, পরদিন সকালেই দাউদ হায়দার এলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর স্টলে। আমাদের বইপত্র দেখে দারুণ খুশি। তিনি নিজে থেকে বললেন, রবীন, আমি দুঃখিত আপনাকে গতকাল বাজেভাবে বকেছি! কবি দাউদ হায়দার হয়ে উঠলেন ‘দাউদ ভাই’। অন্য কথায় বন্ধু দাউদ হায়দার। হোয়াইট ওয়াইন হাতে প্রতিদিন স্টলে আসেন; প্রবাসী বাঙালি লেখক-পাঠকদের সঙ্গে চলে মজার আড্ডা। 
একদিন দুপুরে দাউদ ভাই এসে বলেন, রবীন, আপনি কি গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে মিট করতে চান? আমি বললাম, বলেন কী! চাই না মানে! কিন্তু এও কি সম্ভব? দাউদ ভাই বললেন, গুন্টার গ্রাস বইমেলার জন্য এসেছেন। পাশের একটা হোটেলে আছেন। তাঁর সেক্রেটারির সঙ্গে কথা হয়েছে। আগামীকাল খুব সকালে যেতে হবে। সেই সঙ্গে গুন্টার গ্রাসের পোস্টার নিয়ে আপনিও চলুন।
অনেক সকালে উঠতে হবে শুনে আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। রাতে আর ঘুমালাম না। সকালে পোস্টার নিয়ে ট্রেনে চলে এলাম ম্যাসেসেন্টারে। গুন্টার গ্রাসের দুই সেক্রেটারি পোস্টারটা দেখলেন। তারপর আমাদের দু’জনকে নিয়ে হোটেলের মধ্যে নিয়ে গেলেন। একটা টেবিলে তখন সকালের নাশতা খাচ্ছিলেন গ্রাস। দাউদ ভাই আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন বাংলাদেশের তরুণ প্রকাশক ও লেখক হিসেবে। আমার তখন নোকিয়া বাটন ফোন ছিল। কয়েকটা ছবি তুলে দিলেন গুন্টার গ্রাসের একজন সেক্রেটারি। তিনি তখনও নোবেল পাননি। বাংলাদেশ ভ্রমণের স্মৃতি শেয়ার করলেন সেই ছোট্ট সাক্ষাতে। আমি বলতে গেলে কোনো কথাই বললাম না। দুই গুণী মানুষের পাশে বসে শুধু শুনছিলাম।

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার শেষ চার দিন দাউদ ভাইয়ের জন্য হয়ে উঠল অনেক আনন্দের! গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে ছবি তুলে এনে আয়োজকদের দেখালাম। ওরাও খুব খুশি! একজন বললেন, কীভাবে সম্ভব হলো, রবীন? আমি বললাম, আমাদের দেশের নামকরা কবি-সাংবাদিক দাউদ হায়দার গুন্টার গ্রাসের বন্ধু! 
সেবার দাউদ হায়দারের দেশ থেকে বের করে দেওয়া বোহেমিয়ান জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলাম না। কারণ তো কিছুটা জানি। বাংলাদেশের বই, লেখকসহ নানা বিষয়ে দাউদ ভাইয়ের সঙ্গে গল্প চলতে থাকে। একজন নিঃসঙ্গ প্রবাসে থাকা কবির সব কথা শোনার মতো বয়সও আমার হয়নি। তাঁর ছোট ভাইয়ের মতো থাকতে ভালো লাগত। দাউদ হায়দারের বড় ভাই রশীদ হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল– এটা শুনে অনেক খুশি হয়েছিলেন।  

দাউদ ভাই দেশে ফিরতে চাইতেন। বলতেন, দেশ তো মায়ের মতো। একটা বেদনা তাঁর সব সময় ছিল। আমিও ভাবি, মাত্র ১০ দিন দেশ ছেড়ে আমি বিদেশের মাটিতে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। পেট ভরে সাদা ভাত-ডাল খাব, তাও কোথাও পাই না। আর এই কবি মা-বাবা, ভাই-বোন ছাড়া বছরের পর বছর আছেন কী করে!
দেশ ছেড়ে, মা ছেড়ে থাকার কষ্টের কথা দাউদ হায়দার কবিতায় লিখে গেছেন ১৯৮৩ সালে; কলকাতায় অবস্থানকালে।
‘মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভিতরে উড়ে যাই। 
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশ ঘুরে আসি। 
মনে হয়, মনুমেন্টের চুড়োয় উঠে 
চিৎকার করে
আকাশ ফাটিয়ে বলি:
দ্যাখো, সীমান্তের ওইপারে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভিনদেশী।’
(তোমার কথা, দাউদ হায়দার)

রবীন আহসান: কবি ও প্রকাশক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তরুণকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে নিহত যুবদল কর্মী
  • ৭ জেলায় বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যু
  • ৬ জেলায় বজ্রপাতে ১২ জনের মৃত্যু
  • ভারতে পুলিশ বাহিনীর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যের ওপর হামলা
  • আর্নে স্লট: কিংবদন্তির জায়গা নিলেন এবং নিজেই কিংবদন্তি হয়ে গেলেন
  • পেহেলগামের ঘটনায় একের পর এক বাড়ি ধ্বংস, সরকারকে সতর্ক করল কাশ্মীরের দলগুলো
  • গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজের আগুনে পাঁচজন দগ্ধ
  • ‘এবং বই’ বুক রিভিউ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত
  • দাউদ হায়দার: কবির দেশ ছাড়ার কষ্ট