এক মাসে নির্যাতিত ৪৪২ নারী-শিশু, ধর্ষণের শিকার ১৬৩
Published: 28th, April 2025 GMT
চলতি বছরের মার্চ মাসে ৪৪২ জন নারী-শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এছাড়া, ধর্ষণের শিকার হয়েছের ১৬৩ জন। এরমধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছন ৩৬ জন।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায়।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া বেগম শান্তি জানান, ধর্ষণের শিকার ২ জনকে হত্যা করা হয়। এছাড়া, ৫৫ জন কন্যাসহ ৭০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
সম্প্রতি নারীর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে রাবেয়া বেগম শান্তি বলেন, “বর্তমানে নারীর প্রতি বিদ্বেষ, বিদ্বেষমূলক আচরণ ও ভাষা নারীর স্বাধীন চলাফেরাকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছে। যেখানে সেখানে নারীর পোশাক, নারীর সাজসজ্জা, নারীর চলাফেরা নিয়ে প্রকাশ্যে অপমান করা হচ্ছে। গণপরিসরে নারীকে নানাভাবে শারীরিক ও মৌখিকভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নভাবে নারীর প্রতি ঘৃণা ছাড়ানো হচ্ছে, নারীকে বহুভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এবং, বাধাহীনভাবেই তারা সমাজে এসকল অপকর্ম সাধন করতে পারছে, যা তাদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। নারীর অগ্রগতিকে বাধা দেওয়ার লক্ষ্যে ভীতির পরিবেশ তৈরীর জন্য এ ধরণের অপচেষ্টা করা হচ্ছে।”
“আমরা লক্ষ্য করছি যে, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার সহিংসতার মাত্রা পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। মাত্রা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। ১৮ বছরের নীচে কন্যা শিশুদের উপর অন্যদিকে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাসের ক্ষেত্রে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।”
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা কারাগার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি (আবরার ফাহাদ হত্যা) পালিয়ে যাচ্ছে, শিশু ধর্ষণের আলোচিত ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জামিনে মুক্তি পাচ্ছে। সারা দেশে ছিনতাইসহ অপহরণ, খুন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে নারীসহ সকল মানুষ নিরাপত্তাহীন ও বিপন্ন বোধ করছে।”
নারী বিদ্বেষী অপসংস্কৃতির প্রভাব এ দেশের নারী জাগরণের পথিকৃত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিও পরিলক্ষিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিকৃতিতে কালি লেপন, রংপুরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন হয়েছে। আমরা মনে করি, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সমাজের অচলায়তন ভেঙে নারীদের আলোর পথের সন্ধান দিয়েছেন। তিনি সমাজের অবরোধ ভাঙার জন্য, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য, নারীর মুক্তির জন্য আজীবন যে সংগ্রাম করে গেছেন।“
এ সময় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সুফিয়া কামালসহ নারী জাগরণের পথিকৃতদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার জোর দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্দোলন সম্পাদক বলেন, “আপনারা জানেন যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে নারীর জন্য ৬০% কোটা বহাল ছিলো। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি যে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ খসড়া প্রজাপনে এই বিধান রোহিত করা হয়েছে। যা কিনা নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিকালে অগ্রসর করার জন্য অসঙ্গতিপূর্ণ।” বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০২৫ এ নারী কোটা এখান রাখার দাবি জানায়।
“সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। নারী সমাজের দীর্ঘ দিনের দাবি দাওয়া নিয়ে নারী সমাজের পক্ষ থেকে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বিভিন্ন সুপারিশসমূহ প্রধান উপদেষ্টার কাছে দিয়েছে। যেখানে এ দেশের গত পাঁচ দশকের নারী আন্দোলনের অবাস্তবায়িত মূল মূল দাবিসমূহের প্রতিফলন ঘটেছে, যা নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি অতীতের মতো সুপারিশ পেশের সঙ্গে সঙ্গে মৌলবাদী, নারী বিদ্বেষী গোষ্ঠী ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীর অধিকার এবং নারী- পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। আমরা আশা করবো এই অপতৎপরতা, অপকৌশল রোধে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর মানবাধিকার রক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকার, সকল রাজনৈতিক দল ও সমাজ এগিয়ে আসবে।”
তিনি বলেন, “সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে উচ্ছৃঙ্খল জনতা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। বিবেক বা যুক্তির জায়গায় মনোজগতে স্থান নিয়েছে প্রতিহিংসা। এই উচ্ছৃঙ্খল জনতা শুধু জনসমক্ষে প্রতিপক্ষকে হেনস্তা, মারধর ও অপমান করেই ক্ষান্ত হচ্ছেনা। গণপিটুনির মাধ্যমে প্রকাশ্যে হত্যা করা হচ্ছে মানুষকে, এর সাথে চলছে লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এর মাধ্যমে ধ্বংসের খেলা।”
শিক্ষার্থীরাও দলে দলে বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দাবি আদায়ের নামে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে তারা। শিক্ষাঙ্গনেও বিভিন্নভাবে শিক্ষকদের অবমাননা, জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা, এবং পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করছে না। এই হেনস্থা থেকে নারী শিক্ষকগণও রেহাই পাচ্ছেন না।”
“বিচার প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা ও বিভিন্ন জটিলতা এবং বিচার প্রাপ্তির প্রতি তৈরী হওয়া এক ধরনের অনীহার কারণে বিভিন্ন ঘটনায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য যখন তখন মব সহিংসতার অপতৎপরতা চালু হয়েছে যার ফলে সকল ক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন। এইসকল ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সবসময় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। সবকিছু মিলিয়ে দেশের এক বিশেষ জটিল, সঙ্কটময়, পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়েছে।”
আমাদের দেশের সকল পর্যায়ে নারীর অবস্থান এবং অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর সমঅধিকার, সমমর্যাদা এবং সমঅংশীদারিত্বের প্রশ্নে সমপ্রতিনিধিত্বে নারী এখনও উপেক্ষিত, এখনও অনেক পিছিয়ে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “নারীর সম্পদ সম্পত্তিতে সমঅধিকার নেই, নীতিনির্ধারণী এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়েও নারীর উপস্থিতি অপ্রতুল। আমাদের দেশে নারীর অংশগ্রহণে দেশের অর্থনীতির পশ্চাৎপদতা হ্রাস পেলেও জনগণের মনোজগতে মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা এখনও বিরাজমান।”
“আমরা মনে করি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নারীর মুক্তির যে আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়েছে, তা নিয়ে নানা বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে নারী সমাজ নিজেদেরকে অগ্রসর করে নিয়ে চলেছে। এই নারী সমাজকে আরও অগ্রসর করে নিতে হলে আমাদের নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ধর্মের দোহাই না দিয়ে বক্তিগতভাবে একজন নাগরিক এবং একজন মানুষ হিসেবে এদেশের ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অর্ধেক জনগোষ্ঠী- নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সকলেরই যুক্তিসঙ্গত চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন ঘটবে- এই প্রত্যাশা করি।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে,
নারী বিদ্বেষী প্রচার প্রচারণা বন্ধ করার লক্ষ্যে এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। মব সহিংসতার অবসান ঘটনোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস প্রতিহত করা উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা/রায়হান/ইভা
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র র জন য লক ষ য সরক র গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
বিজয় যখন কড়া নাড়ছে
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া জাগায়। দেশবাসীসহ বিশ্ব জানতে পারে, জাতিগত গণহত্যার মধ্যেই চলেছিল পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এখানে সে সময়ের একটি আলোচিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
আত্মসমর্পণের আগে
ঢাকায় বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরের বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁদের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। আকস্মিক সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে নিবিড় পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি এলিট নিধনের অংশ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এটা অবশ্যই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তান হাই কমান্ডের পূর্ণ জ্ঞাতসারে ঘটেছে।
এসব মৃতদেহের আবিষ্কার ঢাকা শহরে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, পাল্টা হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে, এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে।
ঢাকার মূল শহরের পাশের রায়েরবাজারে কতগুলো বিচ্ছিন্ন গর্তে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। আমি নিজে ৩৫টি গলিত দেহ দেখেছি। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, তাঁরা চার-পাঁচ দিন আগে নিহত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি হবে। ঢাকায় অপহরণ করা এ ধরনের লোকের সংখ্যা অন্তত ১৫০ হতে পারে।
ইউপিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান হৃদ্রোগ চিকিৎসক ফজলে রাব্বী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান মুনীর চৌধুরী রয়েছেন। ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকা ধানমন্ডির বাইরে একটি ইটখোলাকে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও কচুরিপানার নীল-সাদা ফুল কর্দমাক্ত জলাশয়ে শোভা পাচ্ছে। স্থানটি লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ ঢাকার শত শত মানুষ মাটির বাঁধ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছে, তাদের অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দিষ্ট স্বজনদের।
বিশিষ্টজনদের অপহরণ করে তুলে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার সকালেই। পাঞ্জাবি সেনাদের কয়েকটি স্কোয়াড নির্দিষ্ট ঠিকানায় হাজির হয়ে নির্ধারিত পুরুষ ও নারীকে সশস্ত্র পাহারায় উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। তাঁদের সম্ভবত রায়েরবাজার ইটখোলায় এনে মাটির বাঁধের পাশে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে, যাতে তাঁরা হুমড়ি খেয়ে নিচের জলাশয়ে পড়ে যান।
ড. আমিনুদ্দিন বেঙ্গল রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান, অক্সফোর্ডের পিএইচডি। পাকিস্তানি সেনারা যখন তাঁকে তুলে নেয়, সেই মঙ্গলবার সকাল সাতটায় তাঁকে শেষবারের মতো দেখা যায়। নাজিউর রহমান বললেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাকেও যেতে হচ্ছে, খুঁজে দেখি।’ ততক্ষণে তিনিও উলের মাফলার দিয়ে নাক-মুখ পেঁচিয়ে নিয়েছেন।
গতকাল আমি কেবল তিন ঘণ্টা ঢাকায় ছিলাম, ততক্ষণে ইটভাটার এই খবর তেমন ছড়ায়নি। জনতা উত্তেজিত, তবে আচরণে অদ্ভুত কোমলতা। ভারতীয় সেনাদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গাড়িতে এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে।
সেদিনও অনেক গোলাগুলি হয়েছে, বিশেষ করে রাতের বেলায়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি তখনো বিস্ফোরণোন্মুখ। বাঙালিরা অভিযোগ করছে, বিহারি এই বিদেশিরা বহু বছর আগে মুসলমান হিসেবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, তারা বাঙালি হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের সাহায্য করেছে। আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম, এ কারণেই সেখানে বেসামরিক বিহারিদের হত্যা করা হয়। ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড যশোরের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে শতগুণ বেশি ভয়াবহ একটি ব্যাপার। কাজেই একধরনের প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাহারায় সেনানিবাসে বন্দী পাকিস্তানি সেনারা এখনো সশস্ত্র, যদি প্রয়োজন পড়ে! ঢাকা যখন জেনে যাবে পাকিস্তানি সেনারা কত পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তখন দেখা দেবে সত্যিকারের সংকট। যা-ই ঘটুক, পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সহানুভূতিপ্রবণ হওয়া বাঙালিদের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এ রকম একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এভাবে খেলাচ্ছলে অপ্রয়োজনে, উন্মত্তের মতো খুন করতে পারে, তা অবিশ্বাস্য।
যদি পাইকারি হত্যাকাণ্ডকে সংবাদপত্র গণহত্যা আখ্যায়িত করে, তা অবশ্যই ভয়ংকর; কিন্তু পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে জাতির সবচেয়ে যোগ্য, বুদ্ধিমান ও গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ ও নারী হত্যার মাধ্যমে যদি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, সেই ‘এলিটোসাইড’ এলিট হত্যা যে আরও বেশি ভয়ংকর।
গত মঙ্গলবারের অনেক আগেই পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। যেসব কর্মকর্তা এই পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরাও তা অবশ্যই জানেন। কাজেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ধসিয়ে দেওয়া। বহুদিন ধরেই অনুমান করা হচ্ছিল, পাঞ্জাব মরুভূমির রুক্ষ সেনারা বাঙালিদের প্রতি হিংস্র বর্ণবাদী ঘৃণা লালন করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষাও লালন করছে, যার প্রকাশ ঘটেছে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে।
ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ: এম এ মোমেন
দ্য সানডে টাইমস, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১১, পুনর্মুদ্রিত