সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে দলটি প্রথম ১৮ মাসের মধ্যে এক কোটি মানুষের জন্য নতুন কর্মের সংস্থান করবে। দেশের বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে শ্রমবাজারে নিয়োজিত করাই হবে যেকোনো সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ হিসাবে বিএনপি একটি সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।

দেশের ১০ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ১৯। আর দুই–তৃতীয়াংশ মানুষের বয়স ১৮ থেকে ৬০। এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে অবহেলাই করা হয়েছে বিগত সরকারের সময়। কর্মসংস্থানমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা না করে বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় খরচ বাড়িয়ে লুটপাটের পথ তৈরি করা হয়েছিল। গত বছরের জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক কিছুই নতুন করে শুরু করার আলাপ–আলোচনা চলছে। নতুন পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে আমাদের।

অনেকেই বিএনপির এসব পরিকল্পনাকে উচ্চাভিলাষী বলছেন। প্রশ্ন করছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব কি না। বিগত সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে, যা প্রায় আমাদের এক বছরের বর্তমান বাজেটের কাছাকাছি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও এখনো ভঙ্গুর অবস্থায় আছে, এ বিষয়টি স্বীকার করতেই হবে।

এ অবস্থায় বিএনপির বিভিন্ন প্রস্তাব আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে নতুন কর্মসংস্থানের বিষয়টি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করার আগে আমাদের মনে করতে হবে কৃষি খাত ছাড়া ঘন শ্রমভিত্তিক শ্রম সংস্থানের দুটি খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প ও বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা আসার পর এই তিনটি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। খাল খনন করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। তেল, সার সহজলভ্য করা হয়। কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি বিপণন ও কারিগরি খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।

ওই সময় দেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিকাশ ঘটতে শুরু করে সরকারের সহজ নীতির কারণে। নানাবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সারা দেশে কাজ শুরু করে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে উন্নয়ন সংস্থাগুলো কাজ শুরু করে। সরকারের উন্নয়নবান্ধব নীতি–কৌশলের কারণেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার বিকাশ শুরু হয় এবং গ্রামীণ জীবনে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পরিবার পরিকল্পনার প্রতি গ্রামীণ মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীতে এই দলটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে উন্নয়ন ও শ্রমবাজারে নতুন করে গতির সঞ্চার করবে, এমন আশা করার কারণ রয়েছে।  

জিয়াউর রহমানের আমলে দুটি উল্লেখযোগ্য খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প স্থাপন ও বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি শুরু করা। এই দুটি খাতে ধীরে ধীরে বিপুলসংখ্যক মানুষের শ্রমের সংস্থান হতে শুরু করে। বিপুলভাবে এই দুটি খাতের বিকাশ ঘটে খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর।

খালেদা জিয়া যখন দায়িত্ব নেন, তখন দেশে সচল পোশাকশিল্পের সংখ্যা ছিল ২৫০টির মতো। কিন্তু ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া দায়িত্ব ছাড়ার সময় দেশে সচল পোশাক কারখানার সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারের মতো। এই হিসাব পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতি বিজেএমইএর ওয়েবসাইটেই দেওয়া আছে। ওই সময় সরকার আমদানি ও রপ্তানি নীতি সহজ করে দেওয়ার কারণে পোশাক রপ্তানির কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিপুলসংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছিল এই পোশাক খাতে।

সার্বিকভাবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ থেকে ৩ শতাংশ। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪-৫ শতাংশে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে তা ছিল ৬ শতাংশ।

বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর দেশের উন্নয়ন নীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল শ্রমঘন শিল্প স্থাপন করা। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত শ্রমকে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া। এতে করে নতুন নতুন মানুষের কর্মের সংস্থান হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, মানুষজন এক শ্রমবাজার থেকে আরেক শ্রমবাজারে প্রবেশও করেছে। যেমন পোশাকশিল্পের বিকাশের কারণে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ শ্রমবাজার থেকে মানুষজন পোশাক কারখানার শহরের দিকে যেতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি শহুরে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ শুরু হয়। যার সরাসরি প্রভাব আমাদের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে লক্ষ করা যায়।

এই হচ্ছে বিএনপির অতীত সাফল্যের উদাহরণ। এবার দেখা যাক বিএনপি ভবিষ্যতের জন্য কী ভাবছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে শ্রমবাজারের নিয়োজিত করার কী পরিকল্পনা করছে।  

সার্বিক উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি এবার দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ শতাংশ। মূলত ১০টি খাতকে সার্বিক উন্নয়ন তথা কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এগুলো হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ম্যানুফ্যাকচারিং, আইসিটি ও ফ্রিল্যান্সিং, কৃষি, বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি, সেবা খাত, সবুজ জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং অন্যান্য।

প্রযুক্তি খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানের জন্য স্টার্টআপ এক্সিলারেটর ও ফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম চালু করার পরিকল্পনা বিএনপির রয়েছে। এই খাতে দুই লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে বিএনপি মনে করছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নতুন করে তিন লাখ মানুষের কর্মের সংস্থান করতে চায় বিএনপি। এ জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদান করবে বিএনপি সরকারে গেলে।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে অধিকতর পরিবেশবান্ধব করে এই খাতে তিন লাখ নতুন চাকরিজীবী ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। খুচরা ব্যবসা ও সেবা খাতে ১১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে। এই সময়ে মানসম্পন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষা দিয়ে ১৫ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাঠাবে দলটির সরকার।

দেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে ৫ লাখ মানুষকে এই খাতে নিয়োজিত করতে চায় দলটি। কৃষিতে উৎপাদনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত, সরবরাহশিল্পের শিল্পের নবতর বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে নতুন করে কৃষি খাতে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।

সব থেকে বেশি কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা রয়েছে শিল্প খাতে। করছাড়, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে শিল্প খাতে নতুন করে গতি সঞ্চার করতে চায় বিএনপি। এই খাতে সব থেকে বেশি, মানে, ২১ লাখ শ্রমিকের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে চায় দলটি।  

বিএনপির পরিকল্পনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে অনুধাবন করা যায় যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের থমকে যাওয়া উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে চায় দলটি। এতে জনগণের চাহিদা অনুসারে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। এর পাশাপাশি সৃষ্টি হবে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে নতুন নতুন চাকরির সুযোগ।

বিএনপির এই পরিকল্পনা মোটেও উচ্চাভিলাষী বা রাজনীতির কথার কথা মনে করার কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের পরিকল্পনা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য খুবই জরুরি। শুধু বিএনপিই নয়, অন্যান্য দলেরও এ ধরনের পরিকল্পনা থাকা জরুরি। বিএনপিই এসব পরিকল্পনা প্রকাশ করে অন্যদের থেকে এগিয়ে গেল। রাজনীতিতে নানা কথাবার্তা, তর্কবিতর্ক থাকবেই। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রতিটি দলেরই নিজস্ব দার্শনিক ভিত্তি থাকতে হবে, যাতে জনসাধারণ বুঝতে পারবে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে তারা কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, অতীতে এই দলটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে উন্নয়ন ও শ্রমবাজারে নতুন করে গতির সঞ্চার করবে, এমন আশা করার কারণ রয়েছে।  

ড.

মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ রমব জ র সরক র র ব এনপ র কর র ক র জন য এই খ ত র জন ত আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

রাশিয়ার কুরস্কে সেনা মোতায়েনের কথা নিশ্চিত করল উত্তর কোরিয়া

রাশিয়ায় সেনা মোতায়েনের কথা প্রথমবারের মতো নিশ্চিত করেছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির সরকারি সংবাদ সংস্থা কেসিএনএ আজ সোমবার জানিয়েছে, পিয়ংইয়ংয়ের সেনারা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণাধীন কুরস্ক সীমান্ত অঞ্চল পুনর্দখলে রাশিয়াকে সাহায্য করেছে।

এর কয়েক দিন আগেই উত্তর কোরিয়ার সেনাদের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করে রাশিয়া। যদিও দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনেক আগে থেকেই জানাচ্ছিল, পিয়ংইয়ং গত বছর কুরস্কে ১০ হাজারেরও বেশি সেনা পাঠিয়েছিল।

উত্তর কোরিয়ার কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশন কেসিএনএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর উপদলটি রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশ অনুযায়ী কুরস্ক এলাকা মুক্ত করতে অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে।’

কেসিএনএ জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত ছিল পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির অধীনে।

কিম বলেন, ‘ন্যায়বিচারের জন্য যারা লড়ছে, তারা সবাই মাতৃভূমির গর্ব এবং সম্মানের প্রতিনিধিত্বকারী।’

আরও পড়ুন কুরস্ক ‘পুনর্দখলে’ রাশিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সেনারা, প্রশংসায় মাতল মস্কো১৭ ঘণ্টা আগে

কিম আরও বলেছেন, যুদ্ধের বীরত্বগাথার স্মরণে রাজধানীতে শিগগিরই একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হবে। তিনি ‘শহীদ সেনাদের সমাধিফলক’ স্থাপনের কথাও উল্লেখ করেছেন। এতে প্রকাশ্যে নিশ্চিত করা হলো, যুদ্ধে উত্তর কোরীয় সেনারা নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাদের পরিবারের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখানো হবে এবং তাদের দেখভালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

আরও পড়ুনপুতিন একটা মহাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন?২৬ এপ্রিল ২০২৫

কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের মতে, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের দুঃসাহসী আক্রমণ প্রতিহত করে কুরস্ক অঞ্চল মুক্ত করার অভিযানে বিজয় হয়েছে।’

রুশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ গত শনিবার উত্তর কোরীয় সেনাদের ‘বীরত্বের’ প্রশংসা করে বলেছিলেন, তাঁরা ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর একটি দলকে পরাজিত করতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করেছে।

আরও পড়ুনইউক্রেনে রুশ যুদ্ধশিবির থেকে দুর্বিষহ জীবনের গল্প বললেন এই বাংলাদেশি তরুণ২৬ এপ্রিল ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ