রেলের হাসপাতালগুলো অবশেষে সাধারণ মানুষের জন্যও হচ্ছে কি
Published: 28th, April 2025 GMT
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম রেলওয়ের একটি হাসপাতাল পরিদর্শন করতে। সেখানে কোনো রোগী দেখতে না পেয়ে সবিস্ময় বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে রোগীর চাপে শয্যা খালি থাকে না। কিন্তু এই হাসপাতালে দেখি বেডের অভাব নেই, রোগীর অভাব।’
সিআরবি এলাকায় এই হাসপাতাল পরিদর্শন, গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও কিছু নির্দেশনা দেওয়ার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে কয়েক বছর আগের একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
সিআরবি এলাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন চট্টগ্রামের মানুষ। সেটা ২০২১ সাল। সাংস্কৃতিক কর্মী, নাগরিক সমাজসহ দলমত-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে এ আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন এবং দীর্ঘ দেড় বছর ধারাবাহিক অহিংস কর্মসূচি অব্যাহত রেখে সফল হয়েছিল, তা সত্যিকার অর্থেই প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি মানুষের অসীম মমতার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অতঃপর চট্টগ্রামবাসীর দৃঢ়তার কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে হাসপাতাল প্রকল্প বাতিল হয়।
পাহাড়-অরণ্য ও বৃক্ষরাজিশোভিত সিআরবিকে বলা হয় চট্টগ্রামের ফুসফুস। শহরজুড়ে অজস্র ইট-কাঠ-দালানের ভিড়ে এই একটি জায়গায় বুকভরে শ্বাস নিতে পারে মানুষ। এখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালের অবকাঠামো গড়ে তোলার অর্থই হচ্ছে অবাধ আলো–হাওয়া, দূষণমুক্ত পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা। শুরুর দিকে সরকারি কর্মকর্তাদের এ কথাগুলো নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা যথারীতি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির গৎবাঁধা বুলির বাইরে আর কোনো যুক্তিতর্ক মানতে নারাজ। এমনকি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য উপযুক্ত শহরের অদূরে বেশ কিছু খাসজমি দেখিয়ে দিয়েও তাঁদের নিরস্ত করা যায়নি।
এ প্রকল্পের বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য ছিল, হাসপাতাল নিশ্চয়ই আমাদের চাই, কিন্তু অক্সিজেনও তো চাই। হাসপাতাল তো যেকোনো জায়গায় নির্মাণ করা যায়। কিন্তু সিআরবির শতবর্ষী বৃক্ষরাজি, পাহাড়-টিলা আর কোলাহলমুক্ত পরিবেশ আর কোথায় পাওয়া যাবে? সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নানা মাত্রা ছিল। একদিকে সভা-সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক চলেছে, অন্যদিকে সিআরবি সাতরাস্তার মোড়ে মানববন্ধন, পাহাড়ের ঢালে গণসংগীত, নাটক ও চিত্রাঙ্কনের মতো প্রতিবাদী কর্মসূচিতে জড়ো হয়েছেন হাজারো মানুষ।
অনেকের ধারণা, প্রাইভেট-পাবলিক প্রপার্টির আওতায় এ হাসপাতাল নির্মাণের সঙ্গে সরকারদলীয় উচ্চপর্যায়ের লোকজন থেকে শুরু করে আমলাদের অনেকেরই লাভালাভের হিসাব জড়িত ছিল। তাই তাঁরা এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কারণ, এ আন্দোলনে দলমত-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। এমনকি সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরাও ধীরে ধীরে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন।
শুরু থেকেই একটি ঝাঁ-চকচকে অবকাঠামো, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির চিকিৎসা সরঞ্জাম ও দেশ-বিদেশের চিকিৎসকদের সমাবেশ ঘটানোর কথাও বলা হচ্ছিল। এ প্রকল্প বাতিল হওয়ার পর চট্টগ্রামবাসীর হঠকারিতা নিয়েও তখন কম আলোচনা হয়নি। চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হলেন এখানকার মানুষ, সেসব নিয়েও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এ কথা কখনো বলা হয়নি, গুণে-মানে সেই ‘অসাধারণ’ হাসপাতালে সেবা নিতে যাওয়ার সামর্থ্য আদৌ কজনের আছে!
বড় বিনিয়োগের হাসপাতাল দরকার, নাকি নগরবাসীর ‘ফুসফুস’ বাঁচানো দরকার, সেই বিতর্কের মধ্যে একটি কথা প্রায় চাপা পড়েই গেছে, সেটি হচ্ছে এখানে মোটামুটি বড় পরিসরের একটি হাসপাতাল আগে থেকেই আছে, যার যথার্থ ব্যবহার নেই।
উন্নত চিকিৎসাসেবার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শুধু চট্টগ্রামে নয়, বিভিন্ন জেলায় যেসব রেলওয়ে হাসপাতাল এ রকম প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সমঝোতা চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়া সহজ ও সুলভ হবে।অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের স্বপ্নে বিভোর সরকারি আমলাদের মনে কখনোই এ প্রশ্ন জাগেনি, জনসংখ্যাবহুল এ নগরে সুপরিসর একটি হাসপাতাল আছে, অথচ রোগী নেই কেন?
এই হাসপাতাল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২ হাজার ২০০ শয্যার হাসপাতালে দৈনিক তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার রোগী থাকে। অথচ রেলওয়ে হাসপাতালে রোগী প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ, এটিতে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্যদের চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সুযোগ নেই। এতে অসুবিধা হলো উভয়মুখী। একদিকে রেল বিভাগের লোকজন ছাড়া অন্যরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না, অন্যদিকে স্বল্প বরাদ্দের এই হাসপাতালে চিকিৎসকসহ অন্যান্য জনবল ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে রেল বিভাগের কর্মরতরাও এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন না।
দীর্ঘদিন পর এই সংকটের দিকে নজর দিয়েছেন রেলপথ উপদেষ্টা। হাসপাতাল পরিদর্শনকালে তাঁর পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা যে নেহাত লোকদেখানো ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া গেল পরবর্তী কার্যক্রমে। ২১ এপ্রিল রেলপথ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ–সংক্রান্ত একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এ দুটি মন্ত্রণালয়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় হাসপাতাল পরিচালিত হবে। শুধু রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, চিকিৎসাপ্রার্থী সব মানুষের জন্য এ হাসপাতাল উন্মুক্ত থাকবে।
উন্নত চিকিৎসাসেবার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শুধু চট্টগ্রামে নয়, বিভিন্ন জেলায় যেসব রেলওয়ে হাসপাতাল এ রকম প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সমঝোতা চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়া সহজ ও সুলভ হবে।
বেশি মানুষের সেবা পাওয়ার চেয়েও গুটিকয় মানুষের সুযোগ-সুবিধা ও ব্যবসায়িক লাভের বিষয়টিকে যে মন্ত্রী-আমলারা অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, সিআরবি এলাকায় বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ তারই একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকল।
এখানে উল্লেখ প্রাসঙ্গিক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দ্বিতীয় একটি ইউনিট তৈরির একটি প্রস্তাব ২০২২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এর জন্য বর্তমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাম্পাসেই স্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন প্রস্তাবটি ফাইলচাপা ছিল। সম্প্রতি এটি পুনর্মাজন করে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আগের মতো প্রকল্পটি দীর্ঘসূত্রতায় যেন না পড়ে, সেটাই এখন আমাদের কাম্য।
আসলে চট্টগ্রামের মতো জনবহুল শহরে সরকারি-বেসরকারি আরও বেশ কিছু হাসপাতাল গড়ে তোলা দরকার। তবে অত্যাধুনিক বেসরকারি চিকিত্সালয়ের পাশাপাশি দরিদ্র জনসাধারণেরও ভরসার জায়গা তৈরি করতে হবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ড ক ল কল জ ব যবস থ ব সরক র প রকল প উল ল খ র জন য অবস থ র লওয় র একট স আরব
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে বেইজিং: চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার উদ্ভূত পরিস্থিতির দিকে নিবিড়ভাবে নজর রাখছে চীন। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে এক ফোনালাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এ কথা বলেছেন। চীনের বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
শনিবার ও রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপে তাঁরা ভারত প্রসঙ্গে কথা বলেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার চীন, যুক্তরাজ্য ও ইরানের নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাদা করে কথা বলেছেন। এ সময় তাঁরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির ‘ভিত্তিহীন প্রচার ও একতরফা পদক্ষেপগুলোর’ প্রতি এসব নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করে ভারতের নেওয়া একতরফা পদক্ষেপের বিষয়েও কথা বলেন তাঁরা।
ইসহাক দার যুক্তরাজ্য ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন এবং ইসলামাবাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অবিচল সংকল্পের পাশাপাশি এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন।
সিনহুয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, দারকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর দেশ ভারত ও পাকিস্তানের পরিস্থিতির ওপর নিবিড়ভাবে নজর রাখছে।
ওয়াং বলেছেন, ‘অকৃত্রিম বন্ধু এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্ভরযোগ্য কৌশলগত সহযোগী হিসেবে চীন পাকিস্তানের বৈধ নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগকে পুরোপুরি উপলব্ধি করে এবং সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষায় পাকিস্তানকে সমর্থন করে।’
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রচেষ্টার প্রতি চীনের অবিচল সমর্থন থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন ইসহাক দার।
ওয়াং বলেছেন, এ ঘটনায় দ্রুত ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের পক্ষে তাঁর দেশ। চীন মনে করে, এ সংঘাত ভারত বা পাকিস্তান কোনো পক্ষেরই মৌলিক স্বার্থকে রক্ষা করবে না। এটা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও অনুকূল নয়।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আশা, ভারত ও পাকিস্তান দুই পক্ষই সংযম প্রদর্শন করবে এবং পরিস্থিতি শান্ত করতে একসঙ্গে কাজ করবে।