উপকূল রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ধস, প্লাবনের আশঙ্কা সুন্দরবন তীরবর্তী জনপদে
Published: 28th, April 2025 GMT
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মালঞ্চ নদীর চর দেবে গিয়ে উপকূল রক্ষা বাঁধের পাঁচ নম্বর পোল্ডারের সিংহড়তলী অংশে ভয়াবহ ধসের সৃষ্টি হয়েছে। শনিবার দুপুরে শুরু হওয়া ধস আজ সোমবার আরও গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এর আগে শুক্রবার রাতে আকস্মিকভাবে চুনকুড়ি ও সিংহড়তলী এলাকায় চর দেবে যাওয়ার পর থেকেই বাঁধে ধস শুরু হয়।
খবর পেয়ে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে কাজ করছেন।
ধস একেবারে জনবসতির কোল ঘেঁষে হওয়ায় গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নদীতে জোয়ারের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাঁধের অবশিষ্ট দুই থেকে আড়াই ফুট অংশ যে কোনো সময় নদীতে বিলীন হতে পারে। এতে সুন্দরবন তীরবর্তী কয়েকটি জনপদ লবণ পানিতে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মালঞ্চ নদীর ছয়টি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিলেও সিংহড়তলী অংশের অবস্থা সবচেয়ে সংকটাপন্ন। তারা জানান, দ্রুত বিকল্প বাঁধ নির্মাণ করা না হলে পরবর্তী জোয়ারে সাত থেকে আটটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।
স্বেচ্ছাসেবক আব্দুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, ‘মাত্র সাত-আট মাস আগে এখানে মাটির কাজ হয়েছিল। বাঁধের পাশে অতিরিক্ত মাটি নেওয়ায় বাঁধ অনেকটা খাড়া হয়ে ছিল। কয়েকদিন ধরে ফাটল দেখা দেয়ার পর শনিবার থেকে ধস শুরু হয়। পাউবো তাৎক্ষণিকভাবে জিওশিট চাপিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করলেও শনিবার রাতে সবকিছু ধসে যায়।’
স্থানীয় বনজীবীদের নেতা বাবলুর রহমান সমকালকে বলেন, শনিবার দুপুরে বাঁধের প্রায় ৩০ ফুট অংশ নদীতে ধসে পড়ে। রোববার সকালের জোয়ারে আরও এক দফা ধসের পর বাঁধের অবশিষ্ট উচ্চতা এখন মাত্র দেড় থেকে দুই ফুট। তিনি বলেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সিংহড়তলী, চুনকুড়ি, হরিনগর, যতীন্দ্রনগর, ছোট ভেটখালীসহ অন্তত সাতটি গ্রাম তাৎক্ষণিকভাবে প্লাবিত হতে পারে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য নীপা রানী সমকালকে বলেন, ছয় নম্বর ওয়ার্ডের অন্তত ছয়টি অংশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। সিংহড়তলীর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বসতবাড়ির পাশে ভাঙন দেখা দেয়ায় এলাকাবাসী উদ্বাস্তু হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অনেকেই ইতোমধ্যে একাধিকবার সর্বস্ব হারিয়েছেন।
ঘটনাস্থলে থাকা পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো.
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনী খাতুন সমকালকে বলেন, স্থানীয়দের সহযোগিতায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ভাটার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। পানি নামলে শত শত গ্রামবাসীকে নিয়ে ভাঙন রোধে পুনরায় কাজ শুরু করা হবে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ য মনগর
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের কোন ফুলের মধুর কত দাম
খুলনা নগরের কে ডি ঘোষ রোডের পাশে ভ্রাম্যমাণ একটি দোকানে বোতলভর্তি খলিশা, গরান, লিচু ও কালিজিরা ফুলের মধু সাজিয়ে রাখা। দোকানের মালিক মধু বিক্রেতা মাহবুবুর রহমান দাবি করলেন, তাঁর দোকানে সব কটিই একেবারে খাঁটি মধু, কোনো ভেজাল নেই। সুন্দরবন থেকে তাঁর নিজস্ব মৌয়ালদের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছেন খলিশা আর গরানের মধু। লিচু আর কালিজিরার মধু নিয়েছেন অন্য জায়গা থেকে।
মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছরগুলোর তুলনায় এবার মধুর দাম একটু বেশি। তাঁর দোকানে কেজিপ্রতি খলিশার মধু ১ হাজার ১০০ টাকা, গরানের মধু ১ হাজার টাকা, কালিজিরার মধু ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং লিচু ফুলের মধু ৭০০ টাকা।
মাহবুবুরের কথার সূত্র ধরে মধুর পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা ও সুন্দরবনে যাওয়া মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবনে এখন মধু আহরণ মৌসুম চলছে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ১ এপ্রিল শুরু হওয়া সুন্দরবনে মধু আহরণ চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত। তবে মধুর দাম এবার গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি। আবার একেকজন মধু বিক্রেতা একেক দামে বিক্রি করছেন। তবে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যাওয়া মৌয়াল আর মৌয়ালদের মহাজনদের কাছ থেকে কিছুটা কম দামে মধু কেনা যাচ্ছে।
মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ও গরান ফুলের মধু আসে। এরপর আসে কেওড়া ফুলের মধু। তারপর বাইন আর নানান মিশ্র ফুলের মধু। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে খলিশার মধু। চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাজারে খলিশা আর গরান ফুলের মধু আসতে শুরু করেছে।
আজ শনিবার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীর তীরে কামরুল ইসলাম নামের এক মৌয়াল বললেন, টানা ১৪ দিন সুন্দরবনে ঘুরে মধু পেয়েছেন ৮ মণ (৪০ কেজিতে ১ মণ)। এই মধুতে খলিশা আর গরান ফুলের মিশেল আছে। প্রতি মণ মধু ২৫ হাজার টাকায় পাইকারি দরে বিক্রি হবে।
আরেক মৌয়াল কামরুল ইসলাম বলেন, দু–এক দিনের মধ্যে আবারও সুন্দরবনে ঢুকবেন। তখন কেওড়া ফুলের মধু আনবেন। এ বছর কেওড়ার মধু ২৩ থেকে ২৪ হাজার টাকার মতো প্রতি মণ বিক্রি হবে। মৌসুমের শেষ দিকে যখন বাইন ফুলের মধু হয়, তখন একেকটি মৌচাকে ১৪ থেকে ১৫ কেজি মধু হয়। তবে ওই মধুর দাম কম। গত বছর বাইনের মধু মণপ্রতি ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবারও তেমনটাই হবে।
সম্প্রতি সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করে লোকালয়ে ফিরছেন কয়রার মদিনাবাদ গ্রামের মৌয়াল আবুল কালাম। তিনি বলেন, প্রথমবার যে মধু কেটে এনেছেন, এটি সবচেয়ে ভালো মধু। মধুর রং কিছুটা সাদা। একেবারে খাঁটি খলিশা ফুলের। এটা খুচরায় কেজিপ্রতি এক হাজার টাকা করে রাখা হচ্ছে। আর যে মধুটা কিছুটা লালচে ধরনের, সেটি গরান ফুলের। সেটি খুচরা বিক্রি করেন ৯০০ টাকায়।
তবে খুচরায় এবার ১ হাজার ২০০ টাকার কমে মধুর কেজি বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান কয়রা বাজারের মধু বিক্রেতা বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল। তিনি কয়রা উপজেলা সদরের থানা রোর্ডের পাশে একটি মুঠোফোন রিচার্জের দোকানে কয়েক বছর ধরে মধুও বিক্রি করছেন। বিকাশ চন্দ্র বলেন, ‘দাম বেশি হওয়ায় এবার বিক্রি কম। আমি নিজে মৌয়ালদের কাছ থেকে ৯০০ টাকা কেজি দরে মধু কিনেছি। এখন ১ হাজার ২০০ টাকার নিচে আর বিক্রি করব না।’
সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার আরেক খুচরা মধু বিক্রেতা মনিরুজ্জামান বলেন, সুন্দরবনের মধুর স্বাদ, রং ও গন্ধ অতুলনীয়। এর চাহিদা আছে দেশজুড়ে। সুন্দরবন থেকে খলিশা আর গরান ফুলের মধু সংগ্রহ এখন শেষ। এবার কেওড়া ফুলের মধু হবে। তাঁরা খুচরা বাজারে খলিশা আর গরানের মধু ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন।
সুন্দরবনের মধুর পাইকারি বিক্রেতা কয়রা উপজেলার রফিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর প্রথম ধাপের খলিশা আর গরানের মধু প্রতি মণ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। গত বছরের তুলনায় দাম প্রতি মণে এক হাজার টাকা বেশি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কেওড়া ফুলের মধু চলে আসবে, তার দাম মণপ্রতি ২৪ হাজার টাকা। গত বছর এই পরিমাণ মধুর দাম ছিল ২২ হাজার টাকা মণ। বাইন আর নানান মিশ্র ফুলের মধুর দাম পড়বে মণপ্রতি ১৮ হাজার টাকা। তবে বাইন ফুলের মধু মানুষ কিনতে চান না।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮ কুইন্টালে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। এ বছর সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কুইন্টাল। প্রসঙ্গত, ১ কুইন্টাল সমান ১০০ কেজি।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, গত বছর মধু আহরণ থেকে ৫০ লাখ ৩৯ হাজার ৮০০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এবার পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে ৪ হাজার ৪৬০ জন মৌয়াল ৬৭৫টি নৌকা নিয়ে মধু আহরণে সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি নিয়েছেন।